প্রতিবার সন্তোষ ট্রফির আসর বসলেই, তা সে দেশের যে প্রান্তেই হোক, এক প্রয়াত আদ্যোপান্ত বামপন্থী মানুষের কথা বারবার মনে পড়ে।

ভদ্রলোক (যদিও এই শব্দটি নিয়ে তাঁর আজীবন আপত্তি ছিল) ছিলেন তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মন্ত্রে ঘোরতর বিশ্বাসী, যাবতীয় ভৌগোলিক সীমানা অগ্রাহ্য করে দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে হবে সাম্যবাদের বীজ – এই অঙ্গীকার নিয়েই কাটিয়েছিলেন জীবনের পঁচাত্তরটা বছর। ব্যতিক্রম একটাই; বছরের মধ্যে দিন পনেরো তিনি হয়ে পড়তেন অতীব সংকীর্ণমনা, প্রাদেশিকতায় ভরপুর। সন্তোষ ট্রফির খেলা শুরু হলেই তিনি বেমালুম ভুলে যেতেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের যাবতীয় নির্দেশ। বাংলার খেলা থাকলে তিনি দুপুর থেকেই চাপা টেনশনে, সন্ধ্যায় ফলাফল জানতে উন্মুখ। আর যদি শেষ অবধি বাংলার অধিনায়কের হাতে ট্রফি ওঠে (যা সৌভাগ্যবশত তখন প্রায়শই ঘটত), তাহলে তো কথাই নেই। মুখের হাসি দেখলে মনে হবে এইমাত্র বুঝি শীত প্রাসাদের পতন ঘটেছে, প্রশান্ত সাগরতীরে শ্রমিক পতাকা উড্ডীন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তবে এটা কিন্তু নেহাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটু জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক ফুটবলপ্রেমীর মুখ থেকেই অনুরূপ গল্প শোনা যায়। কারণ সন্তোষ ট্রফি বরাবরই ছিল ভারতীয় ফুটবলের ভক্তদের চোখে দেশের এক নম্বর প্রতিযোগিতা। এই ট্রফি জিতবে যারা, তারাই দেশের সেরা বলে প্রতিপন্ন হবে। বহু বছর এই প্রতিযোগিতা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দর্শকদের মন ভরানো ফুটবল উপহার দিয়েছে।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী গত ২ মে (সোমবার) মলপ্পুরমে সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে টাইব্রেকারে বাংলাকে হারিয়ে কেরালার জয় মাঠে বসে দেখেছেন ২৬,০০০ মানুষ। এমনটা শুধু ফাইনালেই ঘটেছে তা নয়, টুর্নামেন্টের প্রায় প্রত্যেক ম্যাচেই দর্শক সংখ্যা ছিল দেখার মত। সংবাদমাধ্যম হতচকিত, খবরের কাগজগুলো মলপ্পুরমের মানুষের ফুটবলপ্রেম নিয়ে রিমের পর রিম লিখে ফেলেছে। টেলিভিশন ক্যামেরা প্যান করে দর্শকদের বারবার দেখিয়েছে মাঠে কত মানুষ এসেছেন। তবে এর আরেকটা দিক আছে যা আলোচনার যোগ্য। ২০২১-২২ মরসুমের সন্তোষ ট্রফির সাফল্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিল, যা-ই করা হোক না কেন, আন্তঃরাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপের জনপ্রিয়তা কমানো যায় না। ১৯৯৬-৯৭ মরসুমে জাতীয় স্তরে ক্লাবগুলোর লিগ চালু করার পর থেকে সন্তোষ ট্রফির গুরুত্ব হ্রাস করার জন্য সবরকম চেষ্টা করা হয়েছে। ইউরোপিয় ফুটবল সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞানী ভারতের বহু ফুটবল বিশেষজ্ঞ দাবি করে এসেছেন যে ক্লাবগুলোই ফুটবলের উন্নতির মূলে, তাই তাদেরই যে কোনো মূল্যে উৎসাহিত করা উচিত। সন্তোষ ট্রফি সেকেলে ভাবনার প্রতীক, ওটাকে যত তাড়াতাড়ি বাতিল করা যায় তত ভাল।

কোভিড অতিমারীর সময়ে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) আয়োজিত হয়েছে। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন গুরুত্ব সহকারে আই লিগের আয়োজনও করেছে এই সময়ে, যাবতীয় বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে সন্তোষ ট্রফি স্থগিত রাখা হয়েছিল। শেষবার এই প্রতিযোগিতা হয়েছিল ২০১৮-১৯ মরসুমে লুধিয়ানায়। আজকাল সন্তোষ ট্রফি খেলাও হয় একগুচ্ছ বিধিনিষেধ মেনে। কোনো রাজ্য আইএসএল বা আই লিগে খেলা ফুটবলারদের দলে রাখতে পারে না, বেশ কয়েকজন অনূর্ধ্ব-২১ ফুটবলার দলে রাখাও বাধ্যতামূলক। অবস্থা এমন যে ৩২ বারের চ্যাম্পিয়ন বাংলা তাদের ইতিহাসে এবারই প্রথম এমন ফুটবলারকে নিতে বাধ্য হয়েছিল যিনি কখনো কলকাতা লিগে পর্যন্ত খেলেননি। একে প্রতিষ্ঠিত ফুটবলাররা সন্তোষ ট্রফিতে খেলতে পারেন না, তার উপর সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের অফিসিয়াল মার্কেটিং পার্টনাররা টেলিভিশন কভারেজের ব্যাপারে পাত্তা দেন না। তবুও সন্তোষ ট্রফিকে শক্তিহীন করে দেওয়া যায়নি। হিসাব বলছে অবিশ্বাস্য হলেও সেদিন ফেসবুক লাইভে ফাইনাল ম্যাচ দেখেছেন দু লক্ষের বেশি মানুষ।

২০০৪ সালে যখন দিল্লিতে সন্তোষ ট্রফির আসর বসল, তখনকার কথা ছবির মত মনে পড়ে। দিল্লি ছিল সাদামাটা দল এবং গোড়ার দিকেই প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নিয়েছিল। বাংলাও অপ্রত্যাশিতভাবে প্রথম রাউন্ডেই হেরে যায়। ফলে আয়োজকরা মাঠে লোক হবে কিনা তা নিয়ে রীতিমত চিন্তায় ছিলেন। তারপর যা ঘটল, তা অবিস্মরণীয়। পাঞ্জাব বনাম মণিপুরের সেমিফাইনাল খেলার জন্য টিকিটের অভূতপূর্ব চাহিদা তৈরি হল। কেরালা বনাম পাঞ্জাব ফাইনালের আগে তো দিল্লি সকার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা আম্বেদকর স্টেডিয়ামে বাড়তি পুলিস প্রহরা চাইতে বাধ্য হলেন। নইলে লোকের চাপে গেট ভেঙে পড়বে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন। আই এম বিজয়ন খেলা দেখতে এসে বসার জায়গা অবধি পাননি। শেষ অবধি গোয়ার এক সাংবাদিকের সাথে একটা চেয়ারে ভাগাভাগি করে তাঁকে বসতে হয়েছিল।

কিন্তু আসল খবর সেটাও নয়। পাঞ্জাবকে হারিয়ে কেরালা খেতাব জিতল, হাজার হাজার কেরালা সমর্থক গ্যালারিতে সেই জয় উদযাপন করলেন, পরদিন এক জাতীয় দৈনিকে হেডিং হল, দিল্লি ফুটবলের সুপার সানডে। পাঁচদিন পরে দিল্লির বিখ্যাত টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপ শুরু হল এবং প্রথম দিনেই কেরালার একটি ক্লাব ১-৩ গোলে হেরে গেল। সেই টিমে সদ্য সন্তোষ ট্রফি জয়ী দলের আধ ডজন ফুটবলার ছিলেন। সে খেলা দেখতে কিন্তু ২০০ লোকও হয়নি।

আসলে এতে কোনো রহস্য নেই। কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে ক্লাব ফুটবল ব্যাপারটা এত বছরেও সারা ভারতে তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বরং সন্তোষ ট্রফি সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের অনেক বেশি উদ্বুদ্ধ করত। কারণ অধিকাংশই নিজের রাজ্যের সঙ্গে যতটা একাত্ম বোধ করেন, কোনো ক্লাবের প্রতি ততটা টান অনুভব করেন না। দুর্ভাগ্যক্রমে, ভারতীয় ফুটবলের হর্তাকর্তাবিধাতারা খেলাটা চালান ধার করা ভাবনা দিয়ে। তাঁরা বোঝেন না, অন্য দেশে, বিশেষ করে ইউরোপে, ক্লাব ফুটবলের সংস্কৃতিই আসল কারণ সেখানে অনেকগুলো জনতার ক্লাব আছে যেগুলোর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। একশো বছরের বেশি বয়সী ওই ক্লাবগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতে হাতে গোনা কয়েকটি ক্লাবকে বাদ দিলে অন্য সব ক্লাবই হয় ফ্র্যাঞ্চাইজ, নয় সরাসরি কর্পোরেট হাউস পরিচালিত। ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোকে ভক্তরা নিজের করে নিতে বহু বছর সময় নেবেন। সেক্ষেত্রে অল্প আয়াসেই মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহে খেলাটাকে আরও ছড়িয়ে দিতে পারে এমন একটা প্রতিযোগিতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রয়োজনটা কী?

এই শতাব্দীর শুরুর দিকে গোয়ার ডেম্পো স্পোর্টস ক্লাব দারুণ দল ছিল। তারা সমস্ত ঘরোয়া টুর্নামেন্ট জিতেছিল, এমনকি জাতীয় ফুটবল লিগ (এনএফএল) আর আই লিগও জিতেছিল একাধিকবার। ২০০৪-০৫ মরসুমে যখন প্রথমবার ঘরের মাঠে তারা খেতাব জিতল, তখন ক্লাইম্যাক্স লরেন্স, ক্লিফোর্ড মিরান্ডা খচিত ডেম্পোর খেলা দেখতে যত দর্শক মাঠে এসেছিলেন সেই সংখ্যাটা মোটেই বলার মত নয়। অথচ ২০০৮-০৯ মরসুমে যখন গোয়া দল চেন্নাই থেকে সন্তোষ ট্রফি জিতে ঘরে ফিরল, তখন তাদের অভিনন্দন জানাতে যে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল এবং বিরাট শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল, তা দেখলে বহু পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদও হিংসা করতেন।

ভারতের ফুটবল প্রশাসকরা গুচ্ছ গুচ্ছ ভুল ধারণা নিয়ে চলেন। সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের খেলাটা থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য এইসব ধারণার বশবর্তী হয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো অনেকাংশে দায়ী। আধুনিক ফুটবল কেবল একটা খেলা নয়, একটা ব্যবসা – এটি একটি বারংবার আওড়ানো মন্ত্র, যা অনেকটাই এক ভিত্তিহীন বিশ্বাসপ্রসূত। সফলভাবে ফুটবল চালানোর জন্য কর্পোরেটদের নিয়ে আসতেই হবে – এটি আর একটি বহুলপ্রচলিত আপ্তবাক্য, যা এ দেশের ফুটবল কর্তারা কিছু না বুঝেই বারবার আউড়ে থাকেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে প্রাথমিকভাবে ফুটবল হল বিশুদ্ধ আবেগ, যা কিনা সঠিক জায়গায়, সঠিকভাবে না থাকলে ‘বিজনেস’, ‘কর্পোরেট’ ইত্যাদি শব্দগুলো স্রেফ মূল্যহীন হয়ে যায়; পুরো ফুটবল কাঠামোই ভেঙে পড়ে যদি মানুষের হৃদয় অধিকার না করা যায়। ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গেলে ব্যবসা তো মার খাবেই। সাধারণ মানুষের যাতে উৎসাহ নেই, কর্পোরেটও তা নিয়ে আগ্রহী হবে না।

যে জনতা মলপ্পুরমের স্টেডিয়ামে প্রতিদিন এসেছে তাদের একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল উপভোগ করা আর শেষপর্যন্ত স্থানীয় দলের জয় দেখা। স্টেডিয়ামের কৃত্রিম আলো কত আধুনিক এবং দামি, কর্পোরেট বক্সে কতজন চিত্রতারকা বসে আছেন বা টেলিভিশন কভারেজ কতটা ভাল, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধারাভাষ্যকাররা কতটা পরিশীলিত ইংরেজিতে কথা বলেন – এসবে ওই দর্শকদের কিছু এসে যায় না। ফুটবলের স্বার্থে ওগুলোর একেবারেই প্রয়োজন নেই তা নয়, কিন্তু ফুটবলের জন্য খাঁটি আবেগ তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

গত কয়েক বছরে ভারতীয় ফুটবল কৃত্রিমতায় ঢেকে গিয়েছিল। মলপ্পুরমের সন্তোষ ট্রফি এক ঝলক তাজা বাতাসের মত এসে কৃত্রিমতার কুয়াশা কিছুটা হলেও সরিয়ে দিল।

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

আইএসএলে দুই বড় ক্লাব: মোক্ষলাভ, নাকি মহাপ্রস্থান পর্বের সূচনা?

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.