সাতই নভেম্বর মুষ্টিবদ্ধ হাত, ইন্টারন্যাশনাল গাওয়া, লেনিনের ছবিতে মালা দেওয়া, অতীতের কিছু তথ্য আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া, এই যদি হয় রুশ বিপ্লবের তাৎপর্য এবং তারপরেই যদি হয় পার্টির ভোট কীভাবে বাড়ানো যায় অথবা গেরিলা যুদ্ধ ও সংখ্যালঘু বিপ্লবের প্রচার, তবে শাসক শ্রেণির সেই সব তাত্ত্বিকদের কথা, যে রুশ বিপ্লব যাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে, তার কোনো সমকালীন গুরুত্ব নেই, সেকথা যেন কিছুটা বাস্তব রূপ নেয়। কিন্তু এটাই রুশ বিপ্লবের উপরে শেষ কথা না।
শ্রমিক শ্রেণির স্বমুক্তি এবং বিপ্লবের ‘স্তর’
মার্কস-এঙ্গেলসের দিশাতে বারে বারে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল, তাঁরা উপর থেকে ছকে দেওয়া ‘কমিউনিস্ট’ বিপ্লব চান নি, তাঁরা লড়াই করেছিলেন এমন এক সমাজবিপ্লবের জন্য, যেখানে শ্রমিক শ্রেণি নিজের মুক্তির জন্য লড়বে এবং সমাজে সবচেয়ে শোষিত শ্রেণি হিসাবে, নিজেদের মুক্তির সংগ্রামের সাথী করে নেবে অন্য সব শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর ও সামাজিক স্তরের মানুষকে। অথচ এর পরের প্রজন্মে, কার্ল কাউটস্কি এবং গিওর্গি প্লেখানভের প্রভাবে, একটা বদ্ধমূল ধারণা গেড়ে বসেছিল। সেই ধারণা হল, রাশিয়ার মতো ‘অনগ্রসর’ দেশে, বিপ্লবে প্রধান, এমনকি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকে, কিন্তু বিপ্লব হবে অনিবার্যভাবে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব, তাই ক্ষমতা শেষমেশ যাবে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে। ১৯০৫-এর বিপ্লবের সময়ে এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্লেখানভের যুক্তির চূড়ান্ত ফল হল মেনশেভিকবাদ। মেনশেভিকরা মনে করলেন, বুর্জোয়া শ্রেণি যেহেতু বিপ্লবের স্বাভাবিক নেতা, তাই তারা যতদূর যেতে চায়, তার বেশি যাওয়া ক্ষতিকর। এর বিপরীতে, লেনিন মনে করেছিলেন যে বিপ্লবকে আরো গভীর অবধি যেতে হলে নেতৃত্ব দিতে হবে শ্রমিকদের, সঙ্গে নিতে হবে কৃষকদের, কিন্তু তিনিও মেনে নিলেন, এই বিপ্লব হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। মার্চ-এপ্রিল ১৯০৫-এ লেনিন একটি প্রবন্ধে লেখেন, যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার অসম্ভব, “যদি না আমরা আকস্মিক, ক্ষণস্থায়ী ঘটনার কথা বলি, কোনো স্থায়ী, ইতিহাসে নিজের দাগ রেখে যাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন বিপ্লবী ডিক্টেটরশিপের কথা নয়। এটা অসম্ভব, কারণ জনগণের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনপ্রাপ্ত একটি ডিক্টেটরশিপই একমাত্র টেঁকসই হতে পারবে (চিরন্তন নয় অবশ্যই, কিন্তু আপেক্ষিকভাবে)। কিন্তু রুশ প্রলেতারিয়েত বর্তমানে রাশিয়ার জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু। …ঐতিহাসিক বিকাশের বিষয়গত যুক্তি তাঁদের সামনে রাখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নয়, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যসমূহ”।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
১৯০৫ সালেই, শ্রমিক শ্রেণীর স্ব-সংগঠন এবং লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে ট্রটস্কি এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি স্বীকার করেন, সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বলবে, রুশ বিপ্লব একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। কিন্তু তিনি বলেন, বুর্জোয়া বিপ্লবের গণতান্ত্রিক উপাদান আদায় করতে হলে লাগবে প্রলেতারিয় প্রাধান্য এবং শ্রমিক শ্রেণি সেই প্রাধান্য পেলে নিজেদের দাবি আদায় করতে সবরকমভাবে লড়বেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তাদের কর্মসূচিকে যে দুভাগে বিভক্ত রেখেছিলেন, সেটা বিপ্লবী পরিস্থিতিতে অকেজো হয়ে পড়বে। ন্যূনতম কর্মসূচি বলা হত প্রস্তাবিত ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে’ শ্রমিক শ্রেণির দাবিকে। অন্যদিকে ছিল পূর্ণ, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি। কিন্তু যদি আট ঘন্টার শ্রম দিবস চালু করা বা বেকার সমস্যা সমাধানে আশু পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে বুর্জোয়া শ্রেণি বেঁকে বসে, তখন করণীয় কী হবে? সেক্ষেত্রে মালিকরা জবাব দেবে লক আউট-ক্লোজারের মাধ্যমে। তখন প্রশ্ন উঠবে, সরকার কি তাহলে বন্ধ কলকারখানা অধিগ্রহণ করবে?
“এই সব খুব স্পষ্ট করে দেখায় যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা একটি বিপ্লবী সরকারে ঢুকতে পারেন না, যেখানে তাঁরা আগাম শ্রমিক শ্রেণিকে প্রতিশ্রুতি দেবেন যে তাঁরা ন্যূনতম কর্মসূচীতে জমি ছাড়বেন না, আর বুর্জোয়া শ্রেণিকে প্রতিশ্রুতি দেবেন যে তাঁরা তার বাইরে যাবেন না। এরকম দ্বৈত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব”।
দুই স্তর তত্ত্বের বিপদ — ১৯১৭-র শিক্ষা
১৯১৭ সালে মেনশেভিকরা এবং তাঁদের প্রভাবে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি দলের বড় অংশ, এই দুই স্তর বিপ্লব এবং বুর্জোয়া নেতৃত্বের কথা মনে করেই প্রথমে অস্থায়ী সরকারে প্রবেশ করতেই অস্বীকার করলেন আর যখন প্রবেশ করলেন, সেটা হল বুর্জোয়া সম্পত্তি ও প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য। অন্যদিকে, বলশেভিক দলের মধ্যেও সমস্যা বেশ বড় আকারে দেখা দিল। ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হয় তলা থেকে, শ্রমিক বিক্ষোভ ফেটে পড়লে এবং সৈনিকরা তাতে যোগ দিলে। বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির রুশ ব্যুরোর যারা পেত্রোগ্রাদে ছিলেন, তাঁরা হলেন শ্লিয়াপনিকভ, পিওতর জালুতস্কি, এবং ভিয়াচেস্লাভ মলোটভ। শ্লিয়াপনিকভরা সাধারণ ধর্মঘটের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এবং শ্রমিকরা অস্ত্র চাইলে তাঁদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরাও লিফলেটের মাধ্যমে তৃতীয় দিনে লড়াইকে সমর্থন করেন। ১ মার্চে এক সাধারণ সভায় পার্টির ভাইবর্গ জেলা কমিটি ব্যাখ্যা করেন, নতুন যে শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধি পরিষদ বা সোভিয়েত গড়ে উঠেছে, সেই সোভিয়েত হবে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার। ৩ মার্চ পিটার্সবুর্গ কমিটি যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা ছিল ভাইবর্গ কমিটির চেয়ে অপেক্ষাকৃত মোলায়েম। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়, তারা “ [বুর্জোয়া দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া] অস্থায়ী সরকারের ক্ষমতার বিরোধিতা করবে না, পোস্তোল’কু, পোস্কোল’কু, তার কার্যক্রম শ্রমিক শ্রেণি ও ব্যাপক গণতান্ত্রিক মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়”। Postol’ku, poskol’ku, শব্দ দুটি এই সময়ে বলশেভিকদের একাংশ, মেনশেভিকদের সকলের, সোভিয়েতের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এই শব্দ ব্যবহার করার মানে, “যে পরিমাণে”, বা “যতদূর” এই অর্থ বোঝানো। সুতরাং, পিটার্সবুর্গ কমিটি বলল, যে পরিমাণে অস্থায়ী সরকার শ্রমিক শ্রেণি ও ব্যাপক গণতান্ত্রিক মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার করবে, তারা তার বিরোধিতা করবে না। নেতিবাচক শব্দচয়ন লক্ষণীয় — সমর্থন করবে, এমন বলা হল না। এইখানে মেনশেভিকদের সঙ্গে তফাৎ। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিবর্তন হল। কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং পার্টির পত্রিকা প্রাভদাতে প্রাধান্যের জায়গাতে চলে এলেন কামেনেভ ও স্তালিন। ১৫ মার্চ, ৯ নং প্রাভদাতে প্রকাশিত হল কামেনেভের স্বাক্ষরিত প্রবন্ধ — ‘গোপন কূটনীতি ছাড়া’। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, অন্য পক্ষ যখন যুদ্ধ চালাচ্ছে তখন একপেশেভাবে অস্ত্র নামিয়ে রাখার কথা বলা হবে দাসত্বের প্রস্তাব। কামেনেভ বলেন, বিপ্লবী রাশিয়াকে শান্তি আলোচনার জন্য মিত্রশক্তিকে বলতে হবে, কিন্তু ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীকে বিশৃঙ্খল করা বা “যুদ্ধ নিপাত যাক” এই ফাঁপা বুলি “আমাদের স্লোগান নয়”। এই কারণে তিনি সোভিয়েতের পক্ষ থেকে যে “সমগ্র পৃথিবীর জনগণের প্রতি আবেদন” প্রচার করা হয়েছিল এবং যার সম্পর্কে শ্লিয়াপনিকভরা সন্দিহান ছিলেন, সেই দলিলকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
সোভিয়েতের ইস্তাহার সম্পর্কে প্রাভদায় ১৪ মার্চ সম্পাদকীয় লেখেন স্তালিন। সরাসরি যুদ্ধবিরোধী স্লোগানের বিরোধিতা করে তিনি লেখেন, “সরাসরি স্লোগান, ‘যুদ্ধ নিপাত যাক’, বাস্তব পন্থা হিসাবে একেবারে অকেজো, কারণ… তা যুযুধান শক্তিদের উপর বাস্তব প্রভাব ফেলার মত কিছু দেয় না”। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের আহ্বানকে অভ্যর্থনা জানাতে হয়। তিনি সেইসঙ্গে বলেন, জার্মান জনগণ তাঁদের শাসকদের উচ্ছেদ করবেন, এটা যেহেতু নিশ্চিত নয়, তাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য কবে সফল হবে তাও নিশ্চিত নয়। তাই স্তালিনের সমাধান হল, অস্থায়ী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের সভাতে ও মিছিলে শান্তি আলোচনার দাবি তুলতে হবে, যে আলোচনার ভিত্তি হবে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি। অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে “চাপ দিয়ে” যুদ্ধ বন্ধ করতে বলার পরামর্শের অর্থ, অবশ্যই, ঐ সরকারকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। শ্লিয়াপনিকভ ভালই বুঝেছিলেন, এই সম্পাদকীয় রুশ ব্যুরোর নীতির তুলনায় অনেকটা নরম, অনেকটা শ্রেণি সমঝোতার দিক ঘেঁষা। তাই তার স্মৃতিচারণে তিনি লেখেন, ১৪ মার্চ, প্রথম এই নতুন নেতৃত্বের হাতে প্রাভদা প্রকাশিত হওয়ার পর টাউরিদে প্রাসাদে (অস্থায়ী সরকার এবং সোভিয়েত, উভয়েরই দপ্তর) শোনা গেল, নরমপন্থী, বিচক্ষণ বলশেভিকরা উগ্রপন্থীদের উপর জয়ী হয়েছেন।
যুদ্ধ চালু রাখতে হবে, এই বিষয়ে মধ্য-বাম মেনশেভিক সেরেতেলির সঙ্গে কামেনেভের বা স্তালিনের বিরাট তফাত ছিল না। আমার বক্তব্য এই নয় যে কামেনেভ মেনশেভিক ছিলেন। আমার বক্তব্য এই, যে দুই স্তর বিপ্লবের তত্ত্ব মেনে নেওয়ার ফলে এবং যুদ্ধ থামানোকে বিপ্লবী দলের প্রথম শ্রেণির কর্তব্য হিসাবে দেখতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে, বাস্তব শ্রেণিসংগ্রামের মুখে কামেনেভের এই দোদুল্যমানতা দেখা দেয়।
আজকের যুগে যে কোনো দেশে বিপ্লব হলে, সবক্ষেত্রে মহাযুদ্ধ চলছে, এমন অবস্থা থাকবে না অবশ্যই। কিন্তু ঐ দুই-স্তর বিপ্লব পিঠে ভার হয়ে থাকলে রণনীতির ভুল হতে বাধ্য।
১৯ মার্চ, প্রাভদা অফিসে লেনিনের দূত হিসাবে হাজির হলেন আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই। তিনি প্রাভদার তথা পার্টির পেত্রোগ্রাদে উপস্থিত সব নেতার জন্য দিলেন লেনিনের পাঠানো চিঠি। প্রথম চিঠিটি কিছুটা কেটেছেঁটে প্রকাশিত হয় প্রাভদায়। দ্বিতীয়টি সাত বছর অপ্রকাশিত হয়ে বসে থাকে। প্রথম চিঠিতে লেনিন বলেন, ফেব্রুয়ারি বিপ্লব গুচকভ-মিলিউকভদের ক্ষমতায় এনেছে ‘এখনকার মতো’। কিন্তু বুর্জোয়া সরকার রুশ জনগণের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এই সরকারের পাশে উঠে এসেছে এখনো পর্যন্ত স্বল্প বিকশিত এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রমিক সরকার, যা শ্রমিক শ্রেণির এবং শহর ও গ্রামের সব গরীব জনতার স্বার্থ ব্যক্ত করছে। এই পরিস্থিতিকে তিনি চিহ্নিত করেন দ্বৈত ক্ষমতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে। “যে বলে যে শ্রমিকদের জারতন্ত্রী প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বার্থে নতুন সরকারকে সমর্থন করতে হবে (এবং আপাতত এ কথা বলছে পত্রেসভ, গোভঝদেভ, চেঙ্খেলিরা, এবং সবরকম পিছলে যাওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও, চখেইদঝে) তারা শ্রমিকদের প্রতি বেইমান, শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের প্রতি বেইমান, শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতিও তাই”।
অর্থাৎ, লেনিন কিন্তু অনিবার্য কোনো বুর্জোয়া বিপ্লবের স্তর, যা দীর্ঘকাল থাকবে, যে কথা তিনি ১৯০৫ সালে এবং কামেনেভ ১৯১৭-তেও বলেছিলেন, সেই যুক্তি রাখছিলেন না। রাশিয়াতে ফিরে তিনি পার্টির কাছে পেশ করেন তাঁর প্রসিদ্ধ এপ্রিল থিসিস। লেনিনের দলিলে প্রথম থিসিসে বলা হল, যুদ্ধের চরিত্র পালটায়নি, যুদ্ধ এখনও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। তিনি বললেন, বিপ্লবী যুদ্ধ, প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ, তখনই সমর্থনযোগ্য, যখন ক্ষমতা যাবে শ্রমিক শ্রেণি ও দরিদ্রতম কৃষকদের হাতে, যখন শুধু মুখে না, কাজে অন্য দেশ দখলের লক্ষ্য ত্যাগ করা হবে, এবং যখন সরকার ধনতন্ত্রের সব স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়বে।
থিসিস ১: “রাশিয়াতে বর্তমান মুহূর্তের বৈশিষ্ট্য হল যে বিপ্লবের প্রথম স্তর, যখন বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা পেয়েছিল শ্রমিক শ্রেণির সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার জন্য, তা থেকে দ্বিতীয় স্তরে উত্তরণ, যা ক্ষমতা দিতে বাধ্য প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের দরিদ্রতম স্তরের হাতে”। দেখা যাচ্ছে, লেনিন মেনশেভিকদের সঙ্গে তো একমত ননই, তিনি এমনকি ১৯০৫-০৭-এর বলশেভিক দিশার সঙ্গেও একমত না।
থিসিস ২: অস্থায়ী সরকারকে কোনোরকম সমর্থন নয়। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রাভদা এই সরকারের কাছে দাবি করছে, এরা যেন অন্য দেশ দখল করবে না বলে। পুঁজিবাদী সরকারের কাছ থেকে এমন দাবি করা অর্থহীন।
থিসিস ৩: এখানে লেনিন সরাসরি সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে উন্নততর গণতন্ত্র হিসাবে উপর থেকে তলা পর্যন্ত সোভিয়েতদের ভিত্তিতে সাধারণতন্ত্রের দাবি করলেন এবং বললেন যে সোভিয়েত থেকে পার্লামেন্টের দিকে যাওয়া হবে পিছু হঠা।
থিসিস ৪: সামাজিক উৎপাদন এবং দ্রব্য বন্টনকে সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
অর্থাৎ, লেনিন সরাসরি প্রলেতারিয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে, প্রলেতারিয় গণতন্ত্রের উন্নততর রূপ হিসাবে, জোর দিলেন সোভিয়েতের উপর।
প্রলেতারীয় বিপ্লব এবং স্বাধীন প্রলেতারীয় গণতান্ত্রিক সংগঠন
দীর্ঘ ইতিহাসের বিবরণ এখানে সম্ভব নয়, কিন্তু তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাস যথেষ্ট আছে, যা পড়লে দেখা যায়, সোভিয়েত, ফ্যাক্টরি কাউন্সিল ইত্যাদি নানা গণসংগঠনের মাধ্যমেই গোটা ১৯১৭ সাল ধরে শ্রমিক শ্রেণি ও তাদের মিত্ররা সংগঠিত হয়েছিলেন। অক্টোবর মাসে, যখন বলশেভিকরা অভ্যুত্থান করবেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে, তখন এর গুরুত্ব বোঝা যায়। ১০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বহুদিন ফিনল্যান্ডে আত্মগোপন করে থাকার পর ফেরেন লেনিন। লেনিন বক্তব্য রাখেন অভ্যুত্থানের পক্ষে। কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ আপত্তি জানান। তাঁরা বলেন, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তাব ভ্রান্ত। সংবিধান সভা নির্বাচনে বলশেভিকরা এক তৃতীয়াংশ বা আরো বেশি আসন পেতে পারেন। সংবিধান সভা এবং সোভিয়েত, এ হবে একটা মিশ্র ধাঁচের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ তাঁরা প্রস্তাব করলেন, বুর্জোয়া গণতন্ত্র এবং প্রলেতারিয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো একত্রিত হোক। তাঁরা দাবি করলেন, বিশ্ব প্রলেতারিয় বিপ্লব এত ধীরে এগোচ্ছে, যে রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণি এককভাবে ক্ষমতা দখল করলে অনিবার্যভাবে পরাস্ত হবে।
১০ অক্টোবর লেনিন যখন অভ্যুত্থানের পক্ষে প্রস্তাব এনেছিলেন, তখন অভ্যুত্থান বলতে কী ভেবেছিলেন? ৯ তারিখে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত যে সামরিক বিপ্লবী কমিটি গঠনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা আদৌ আলোচিত হয়েছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। লেনিনের বক্তব্যের যে সংক্ষিপ্তসার পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, তিনি বলছেন, রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য পরিপক্ক। এখন কথা বলতে হবে ‘টেকনিক্যাল’ দিক সম্পর্কে, অর্থাৎ সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়ে। লেনিনের প্রস্তাব ছিল, “আঞ্চলিক কংগ্রেস ও মিনস্কের প্রস্তাবকে নির্ণায়ক কাজের সূচনাবিন্দু হিসাবে ব্যবহার করা যায়”। আঞ্চলিক কংগ্রেস মানে ১১ অক্টোবর থেকে সোভিয়েতদের উত্তরাঞ্চল কংগ্রেস, যাতে ছিলেন পেত্রোগ্রাদসহ অনেকগুলো বড় সোভিয়েতের প্রতিনিধিরা। ১১ থেকে ১৩, তিনদিন এই সম্মেলন বসেছিল। আর মিনস্কের প্রস্তাব মানে, মিনস্কের শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রস্তাব (যা সভেদর্লভ রিপোর্ট করেন), যে তাঁরা স্থানীয় প্রতিবিপ্লবী ফৌজকে নিরস্ত্র করে পেত্রোগ্রাদে বিপ্লবী সৈন্য পাঠাতে পারবেন। কিন্তু ১০ রাতের পার্টির সভা, যেখানে ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়, ১১ থেকে একটা সোভিয়েত কংগ্রেসকে অভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে যাবে — এই চিন্তা অসম্ভব চিন্তা ছিল।
১৬ অক্টোবর একটি সভা হয়, যাতে ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা, পিটার্সবুর্গ কমিটির কার্যনির্বাহী কমিশন, সামরিক সংগঠন এবং পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত, ট্রেড ইউনিয়ন, ফ্যাক্টরি কমিটি, পেত্রোগ্রাদ আঞ্চলিক কমিটি ও রেলকর্মীদের মধ্যে পার্টিনেতারা। লেনিনের প্রস্তাব এই সভায় পায় ১৯ ভোট। বিপক্ষে পড়ে দুটি ভোট, ভোটদানে বিরত থাকেন চারজন। কিন্তু জিনোভিয়েভের প্রস্তাব, যে ২০ তারিখ সোভিয়েত কংগ্রেস বসুক, বলশেভিকরা তাকে বলবেন সংবিধান সভা শুরু হওয়া অবধি থেকে যেতে, পেল ছটা ভোট, এবং তিনজন ভোটদানে বিরত থাকলেন। বিপক্ষে পড়ে ১৫ ভোট। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ অভ্যুত্থানের পক্ষে হলেও, এই সময়েও অন্তত নজন লেনিনের মতের সঙ্গে পুরো একমত ছিলেন না।
এই সভাতে ট্রটস্কি উপস্থিত ছিলেন না। কারণ ঠিক ঐ সময়েই তিনি পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতে সামরিক বিপ্লবী কমিটি গঠনের কাজ শেষ করছিলেন। ফলে লেনিন ও কামেনেভ-জিনোভিয়েভের রণনীতিগত তর্ক সামনে এলেও, লেনিন ও ট্রটস্কির কৌশলগত পার্থক্য স্পষ্ট হল না।
কামেনেভ ও তাঁর সমর্থকরা পার্টির পত্রিকায় তাঁদের ভিন্ন মত প্রকাশ্যে বলার অধিকার চাইলেন। অভ্যুত্থানের মতো বিষয়ে পার্টি তাতে রাজি ছিল না। তখন কামেনেভ ম্যাক্সিম গোর্কির পত্রিকা নোভায়া ঝিঝন-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি সরাসরি লিখলেন না, যে পার্টি অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তিনি লিখলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে সোভিয়েত কংগ্রেসের আগে এবং তার থেকে স্বাধীনভাবে কোনো সশস্ত্র অভ্যুত্থানের উস্কানি দেওয়া অনুমোদনযোগ্য নয় এবং এমনকি শ্রমিক শ্রেণিরও বিপ্লবের জন্য মারাত্মক পদক্ষেপ”। কামেনেভের নোভায়া ঝিঝন-এর প্রবন্ধের ফলে, ১৮ অক্টোবর সোভিয়েতে ট্রটস্কিকে প্রশ্ন করা হল, সোভিয়েত কি অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করছে? না-ই যদি করছে, তাহলে শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত লালরক্ষীদের হাতে কেন বন্দুক তুলে দেওয়া হচ্ছে?
ট্রটস্কির উত্তর এক দিকে বিপ্লবী মেজাজকে সংহত করল, অন্যদিকে প্রতিপক্ষের চোখে ধুলোও দিল। তিনি বললেন, সোভিয়েতের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করা হয় এবং কোনো গোপন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। সোভিয়েতের সভাপতি হিসাবে তিনি তো বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির আলোচনা প্রকাশ্যে বলতে বাধ্য ছিলেন না। কিন্তু শুধু এইটুকু বলে থেমে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারত। কারণ মনে হত, ট্রটস্কি অভ্যুত্থান হবে না, এই মতই প্রকাশ করছেন। তাই তিনি বলেন, যদি সোভিয়েতকে সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে শ্রমিক ও সৈনিকরা সাড়া দেবেন। তিনি বলেন, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত প্রতিবিপ্লবের মোকাবিলা করতে ক্রমাগত লালরক্ষীদের সংগঠিত করবে। তাঁদের অস্ত্রে সজ্জিত করবে। এটা গৌণ বিষয় ছিল না। ট্রটস্কি বুঝেছিলেন, শ্রমজীবী জনতা বুর্জোয়া ন্যায়বোধে উৎসাহী নয়, কিন্তু তাঁদের নিজস্ব ন্যায়বোধ আছে। তাই সোভিয়েত কংগ্রেসের আগে কোনো অভ্যুত্থান ডাকতে হলে, সেটা পার্টির নামে বা আক্রমণের নামে না করে, করা দরকার প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকে। এই কারণে, লেনিন ও ট্রটস্কির মধ্যে, অভ্যুত্থানের দাবি নিয়ে মতভেদ না থাকলেও, পদ্ধতি নিয়ে ছিল। বহু বুর্জোয়া ইতিহাসবিদ এর কারণ হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন লেনিনের তথাকথিত স্বৈরতান্ত্রিক মেজাজকে। এর চেয়ে অনেক সরল ব্যাখ্যা হল, ট্রটস্কি সোভিয়েতে প্রতিদিন অংশ নিতেন, তিনি পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সভাপতি ছিলেন। তাই শ্রেণির মেজাজ তাঁর কাছে যত স্পষ্টভাবে আসছিল, জুলাইয়ের গোড়া থেকে আত্মগোপনে থাকা লেনিনের কাছে তা আসছিল না।
কেন্দ্রীয় কমিটির ২০ তারিখের সভায় জোভির আনা প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সংশোধনী আনেন, যে যাঁরাই অভ্যুত্থানের জন্য কাজ করতে চান তাঁদের সোভিয়েতের তৈরি সামরিক বিপ্লবী কমিটিতে গিয়ে পার্টির উপস্থিত সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
অর্থাৎ, পার্টির উদ্যোগটা হবে রাজনৈতিক কেন্দ্রীকরণের, কিন্তু পার্টি শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারত কেবল সোভিয়েতের মাধ্যমে, নিজের একক প্রয়াসে না। আমরা যদি এই শেষ পর্বে ট্রটস্কির ভূমিকা দেখি, তাহলে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ২১ তারিখ সকালে সামরিক বিপ্লবী কমিটির সেনা ছাউনি সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণ দেন ট্রটস্কি। তাঁর বক্তব্য ও অন্য বলশেভিক-বাম সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিদের বক্তব্য ছিল, সামরিক বিপ্লবী কমিটিকে সমর্থন করা হোক, ক্ষমতা দখলের জন্য সোভিয়েতদের সমর্থন করা হোক। সম্মেলন প্রস্তাব গ্রহণ করল, আসন্ন সোভিয়েত কংগ্রেস যেন “ক্ষমতা নেয়”। অর্থাৎ আধা-প্রতিপক্ষ থেকে সেনা ছাউনিকে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের সমর্থকে পরিণত করা হয়। চতুর্থ ডন কসাক রেজিমেন্ট জানায়, তারা প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। অর্থাৎ যে কসাকদের উপর প্রতিবিপ্লব ভরসা করেছিল, তাদের মধ্যে ফাটল ধরেছে।
এই অবধি যে আলোচনা, তাতে আমরা তিনটি প্রসঙ্গ দেখতে পেয়েছি। প্রথমত, শ্রমিক শ্রেণির নিজের মুক্তির জন্য লড়াই করার মত বিষয়গত পরিবেশ যদি থাকে, তা হলে শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার মত পরিস্থিতিও থাকতে পারে, যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগাম অঙ্ক কষে নয়, স্বাধীন প্রলেতারিয় সংগ্রাম করেই বোঝা যাবে। এই লড়াই কেবল স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী মেজাজ দিয়ে জয়ী হতে পারে না, কিন্তু পার্টি ও শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক হতে হবে দ্বান্দ্বিক। পার্টি যদি শ্রেণির থেকে শিখতে, শ্রেণির স্বাধীন কণ্ঠকে মেনে নিতে পারে, তবেই নেতৃত্ব দিতে পারবে। তাই রুশ বিপ্লব পরবর্তী কমিউনিস্ট নামধারী বিপ্লবগুলোর থেকে স্বতন্ত্র। বলশেভিকরা বিপ্লব করেননি, করেছিল শ্রমিক শ্রেণি। এককভাবে বলশেভিকরা নেতৃত্বও দেননি। বস্তুত, তাঁরা অভ্যুত্থানের পর মার্তভ নেতৃত্বাধীন মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদীদের এবং নাটানসন, স্পিরিদোনভা, ক্যামকভদের নেতৃত্বাধীন বাম সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি দলের সঙ্গে জোট গড়ার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন, কারণ তাঁরা মনে করতেন, এঁরা বিপ্লবী আন্দোলনের অঙ্গ। দ্বিতীয় দল কয়েক মাসের জন্য সোভিয়েত সরকারে ছিলেন এবং যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আর স্তালিন জমানা থেকে দুই স্তর বিপ্লবের মেনশেভিক ভাষ্য বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপর চাপানোর ফলে, শ্রমিক শ্রেণিকে বারে বারে ধাক্কা খেতে হয়েছে। কখনো মস্কোর চাপে, যেমন ১৯২৫-২৭ পর্বে দ্বিতীয় চীন বিপ্লবে, কখনো চীনের অনুপ্রেরণায়, যেমন আইদিতের নেতৃত্ব ইন্দোনেশিয়াতে, যখন সুকর্ণর নেতৃত্বে বিপ্লবের বর্তমান স্তর — এই কথা বলে, বিশ্বের সে সময়ের বৃহত্তম (এবং মনে রাখা ভাল, চীনপন্থী) কমিউনিস্ট দল প্রায় বিনা যুদ্ধে ধংস হয়ে যায়। পাঁচ লক্ষ কমিউনিস্ট কর্মীর মৃত্যু হয়।
বিপ্লবের পথ
১৯১৭ আজ থেকে ১০৪ বছর আগের কথা। তাই হুবহু রাশিয়ার পথ না চীনের পথ — এই তর্ক ক্রমেই অবান্তর। কিন্তু এক অর্থে নয়ও বটে। বিপ্লবের পথ মানে কী? আমরা দেশে দেশে অনেক সময়ে যে তর্ক দেখি তা হল — সংসদীয় পথ না সশস্ত্র পথ? রুশ বিপ্লবের বাস্তব ইতিহাস কিন্তু ঠিক এই বৈপরীত্য দেখায় না। লেনিন এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মনে করেছিলেন, রাশিয়াতে যা পরিবেশ, তাতে হয়ত শান্তিপূর্ণভাবেই সোভিয়েতদের পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হবে। জুলাইয়ের পর তিনি মত পাল্টান। কিন্তু প্রথমটা নিছক সংসদীয় পথ ছিল না, বরং সংসদীয় ব্যবস্থাকে পেরিয়ে উন্নততর সোভিয়েত গণতন্ত্রের দিকে তাকানো ছিল। আর সেই লক্ষ্যে পৌছনোর জন্য জোর পড়েছিল গণ জমায়েতের উপর, প্রলেতারিয় ক্ষমতার ব্যবহারের উপর, কোনো গেরিলা ফৌজের উপর নয়। ১৯০৫ সালের বিপ্লব এবং ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, দুবারই দেখা গিয়েছিল, প্রলেতারিয় ক্ষমতার এক উচ্চতর রূপ হল সাধারণ ধর্মঘট। রোজা লুক্সেম্বুর্গ এবং ট্রটস্কি ১৯০৫ সালেই ধর্মঘট নিয়ে গভীর আলোচনা করেছিলেন। আর অক্টোবর অভ্যুত্থান ব্যাপক গোলাগুলির লড়াই ছিল না। অবশ্যই, পরে গৃহযুদ্ধে গোলাগুলির অভাব ঘটেনি। কিন্তু প্রাথমিকভাবে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও সোভিয়েত ক্ষমতা দখলের জন্য অল্পই রক্তক্ষয় হয়েছিল। তার কারণ সোভিয়েত ক্ষমতার প্রতি শ্রমিক ও সৈনিকদের আনুগত্য। দ্বৈত ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে সেখান থেকে প্রলেতারিয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। আজকের দিনে এই প্রসঙ্গ নতুন করে ভাবতে হবে। কীভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রাধান্যের ক্ষয়সাধন করে দ্বৈত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হবে, কীভাবে সেখান থেকে প্রলেতারীয় প্রাধান্যে পৌঁছনো যাবে — পরিস্থিতির আলোকে তা নির্দিষ্টভাবে ভাবার কথা ১৯২১ থেকে ১৯২৩ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক, ১৯২৮ থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ট্রটস্কি, ইতালিতে গ্রামশি — অনেকেই তুলেছেন। রুশ বিপ্লব কার্বন কপি বা জেরক্স কপি করা যাবে না, কিন্তু শিক্ষা নিতে হবে। এক ধাক্কায় পুরনো শাসকের উচ্ছেদ এবং সম্পূর্ণ নতুন প্রলেতারিয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবে না, কোনো না কোনোভাবে দ্বৈত ক্ষমতা থেকেই এগোতে হবে।
বিশ্ববিপ্লব ও আন্তর্জাতিকতাবাদ
রুশ বিপ্লবের গোড়া থেকে লেনিন, এবং সাধারণভাবে বলশেভিক নেতারা, মনে করেছিলেন রুশ বিপ্লবের ভবিষ্যৎ বিশ্ববিপ্লবের সঙ্গে জড়িত। ১৯১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ট্রটস্কির একটি পুস্তিকা পার্টির পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। তাতে ‘রুশ বিপ্লবের চরিত্র’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লেখেন, যে রুশ বিপ্লব একটি বুর্জোয়া বিপ্লব, এই সাধারণীকরণ বেশীদূর এগোতে দেবে না, কারণ বুর্জোয়া শ্রেণি বিপ্লবের দায়িত্ব পালনে অক্ষম। শ্রমিক শ্রেণিকে স্বাধীন উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু নিঃসঙ্গভাবে নয়, বরং কৃষক জনতা ও শহরের অন্য দরিদ্র জনতার নেতৃত্বে থেকে। আর, পরের অধ্যায়ে তিনি মার্তভের মত মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সঙ্গে তর্ক করে লেখেন, রাশিয়াতে স্বয়ংসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লব একটি স্বতন্ত্র বিপ্লব হিসাবে সম্ভব নয়, কারণ রুশ বিপ্লব ঘটছে বিশ্ব ধনতন্ত্রের এক পরিণত অবস্থায়। তাই, তিনি শেষ করেন “হয় নিরন্তর বিপ্লব, না হয় নিরন্তর গণহত্যা! এই হল লড়াই, যা চলছে মানুষের ভবিষ্যতকে নিয়ে!”
১৯১৮ সালে ৭ মার্চ ব্রেস্ট লিটভস্ক চুক্তি প্রসঙ্গে লেনিন বলেন “জার্মানিতে বিপ্লব না হলে আমরা ধ্বংস হব”। ২৩ এপ্রিল তিনি লেখেন “আমাদের অনগ্রসরতা আমাদের সামনে ঠেলে দিয়েছে এবং আমরা অন্যান্য দেশের অভ্যুত্থানকারী জনতার মহাশক্তিধর সমর্থন পাওয়া অবধি টিঁকে থাকতে না পারলে ধ্বংস হব”।
১৯২১ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় বিশ্ব কংগ্রেসে লেনিন বলেন “আমাদের কাছে এই কথা স্পষ্ট ছিল যে বিশ্ববিপ্লবের কাছ থেকে সাহায্য না এলে, প্রলেতারিয় বিপ্লবের বিজয় অসম্ভব। বিপ্লবের আগে এবং তারপরেও, আমরা মনে করেছিলাম যে সেই [বিশ্ব]বিপ্লব ঘটবে হয় তখনই অথবা অন্তত অল্প দিনের মধ্যে, অন্য অনগ্রসর দেশগুলিতেও, আর অনেক উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতেও, অন্যথায় আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্তি ঘটবে। এই বিশ্বাস সত্ত্বেও আমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে এবং যে কোনো মূল্যে, সোভিয়েত ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কারণ আমরা জানি, আমরা কেবল আমাদের জন্য কাজ করছি না, বরং বিশ্ববিপ্লবের জন্য কাজ করছি”।
কেন এই নিবিড় সম্পর্ক? অংশত সেটা সে সময়ের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি। কিন্তু অংশত। বাকিটা মৌলিক মার্ক্সবাদী তত্ত্ব, যা স্তালিনবাদী আমলাতান্ত্রিক প্রতিবিপ্লব ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। ধনতন্ত্রই এমন একটি ব্যবস্থা, যা একটি দেশে টিঁকতে পারে না, যাকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে হয়। ধনতন্ত্রের প্রভাব, তার শোষণ, পৃথিবীজোড়া। তাই ধনতন্ত্র উচ্ছেদ, ধনতন্ত্রের চেয়ে উন্নততর সমাজ গড়া, সারা পৃথিবী জুড়ে ছাড়া সম্ভব না। আর সেই কারণে, জাতীয়তাবাদ কাটাতে হলে, কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বাস্তবে আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে হলে, আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিতও হতে হবে।
শেষ কথা, একটি অনগ্রসর দেশে বুর্জোয়া শ্রেণি প্রতিবিপ্লবের দিকে চলে গেলে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে হবে শ্রমিক শ্রেণিকে, এবং তার ফলে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বেই নতুন ধরণের রাষ্ট্র কায়েম হবে। কিন্তু ধনতন্ত্রের সঙ্গে শ্রেণি সংগ্রাম চলতে থাকবে। আর অনগ্রসরতা এক জায়গায় (প্রাথমিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে) সুবিধা এনে দিলেও, অর্থনীতি পরিবর্তনে, সামাজিক সম্পর্ক রূপান্তর ইত্যাদিতে সমস্যা বাড়াবে।
আমরা যদি ভারতের কথা ভাবি, তাহলে বুঝতে হবে, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, জাতিবাদ, লিঙ্গ-অসাম্য, এগুলো মৌলিক অসাম্যের কিছু দিক। শ্রেণি ঐক্য গড়ার পথেও এরা বাধা। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে আমরা লড়াই করি এই বিশেষভাবে অত্যাচারিতদের জন্য কিছু সংরক্ষণ, কিছু সুযোগের জন্য। কিন্তু আমূল পরিবর্তনের অর্থ হতে হবে এঁদের পরিস্থিতিরও আমূল রূপান্তর। একটি দেশের, বিশেষত একটি দেশ যার মধ্যে নানা রকম অনগ্রসরতা আছে, তার অর্থনীতির প্রসার ছাড়া ওই কাজ সফল হতে পারে না। তাই বিপ্লবের ছড়িয়ে পড়া বিপ্লবের সাফল্যের জন্য জরুরি। ছড়িয়ে না পড়লে নানা বিপদ আসে। লেনিন, ট্রটস্কি, বুখারিন, জোর দিয়েছিলেন সরাসরি ধনতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিপদের উপর। তাঁরা বোঝেননি, বিপ্লব রক্ষণশীল হয়ে যেতে পারে, বিপ্লবীদের একাংশ আমলাতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারেন এবং একটা সাময়িক ভারসাম্যের ফলে আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। রুশ বিপ্লবের এই শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এ নিয়ে স্বতন্ত্র ও দীর্ঘ আলোচনা দরকার।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।