দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
বিহারের চলমান যুব আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কতখানি আলোড়ন তৈরি হয়েছে আমি জানি না। তবে খুব সামনে থেকে আন্দোলনটিকে দেখে মনে হচ্ছে, এটির মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার যাবতীয় মশলা মজুত রয়েছে। অভূতপূর্ব এর ব্যাপ্তি। এক কোটিরও বেশি চাকরিপ্রার্থী, তাঁদের পরিবারবর্গকে ধরলে প্রায় ৪-৫ কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন অন্য চাকরিপ্রার্থীরা। সব মিলিয়ে এক যুবসমাজের এক বিরাট অংশ ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত এবং মরিয়া। বিহারের সর্বত্র প্রতিবাদের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। এত বড় আন্দোলন হওয়াতে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা হয়ত ঘটছে, কিন্তু সার্বিকভাবে এটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। অত্যন্ত পরিণত রাজনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় রাখছেন যুবকরা। সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে ১৯৭৪ সালের সেই ঐতিহাসিক যুব ছাত্র আন্দোলনের মতো অভিঘাত তৈরির যাবতীয় মশলা মজুত রয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেই উচ্চতায় পৌঁছবে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু আমাদের মত লোকজন, যারা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাদের আশাবাদী হয়ে ওঠার মত যথেষ্ট উপাদান রয়েছে এতে।
আমাদের দল সিপিআইএমএল লিবারেশনের ছাত্রযুবরা আন্দোলনের সামনের সারিতে রয়েছেন। বিহারের শেষ বিধানসভা নির্বাচনে আমাদের দলের বেশ কয়েকজন তরুণ কমরেড নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁরা সামনে থেকে প্রতিবাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চাকরিপ্রার্থীদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে বিহার বনধের ডাক দিয়েছে ছাত্র সংগঠন আইসা। আমরা লিবারেশনের পক্ষ থেকে সেই ডাক সমর্থন করেছি। পরে রাষ্ট্রীয় জনতা দল সহ মহাগঠবন্ধনও বনধ সমর্থন করেছে। সব মিলিয়ে লড়াইয়ের মঞ্চ প্রস্তুত। লাল পতাকা সেই লড়াইয়ের কেন্দ্রে রয়েছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আসলে বিহারে কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শেষ বিধানসভা নির্বাচনে এই প্রশ্নটি আমরা, বিরোধীরা তুলে ধরেছিলাম। পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশেও বেকারত্ব নিয়ে ক্ষোভ বিপুল। ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার পরিবেশ গড়ে তুলে বিজেপি জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে আড়াল করতে চাইছে। খানিকটা সফলও হয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলন প্রমাণ করছে, মানুষ তার বুনিয়াদি সমস্যাগুলোকে নিয়ে চিন্তিত। বারুদের স্তুপ ছিল, দরকার ছিল একটা দেশলাইয়ের।
এই আন্দোলনের শুরুটা কিন্তু খুব রাজনৈতিক ছিল না। ১৫ জানুয়ারি রেলের নন-টেকনিক্যাল পপুলার ক্যাটিগরির পরীক্ষার প্রথম ধাপ বা সিবিটি-১ (কম্পিউটার বেসড টেস্ট)-এর ফলাফল প্রকাশ করে রেলের নিয়োগ বোর্ড। দুম করেই জানানো হয় সিবিটি-২ পরীক্ষা শুরু হবে ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিক্ষোভের সূত্রপাত হয় তারপরেই। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, ২০১৯ সালে ওই পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি যখন প্রকাশিত হয়েছিল, সে সময়ে শুধু সিবিটি-১-এর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ফলপ্রকাশের পরে সিবিটি-২-এর কথা ঘোষণা করেছে রেল, যা নিয়মবিরুদ্ধ। এর পিছনে রেলের আধিকারিকদের দুর্নীতি ও অনিয়ম রয়েছে — এই অভিযোগে সরব হয়ে পথে নামেন পরীক্ষার্থীরা। বিহার হয়ে সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আমাদের কমরেডরা দ্রুত প্রতিবাদরত চাকরিপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়ান। গোটা বিহার উত্তাল হয়ে ওঠে। আমাদের জোরদার সংগঠনের জায়গা আরার হাজার হাজার যুবক যুবতী আন্দোলনে শামিল হয়। গয়া, পাটনা, জেহানাবাদ, ভাগলপুর, সাসারাম — সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়ায়।
উত্তরপ্রদেশেও আগুন জ্বলছে। প্রয়াগরাজ সহ কয়েকটা জায়গায় বিরাট বিরাট বিক্ষোভ হয়েছে। প্রয়াগরাজে পুলিশ ছাত্রদের হোস্টেলে ঢুকে ঘরের দরজা ভেঙে পিটিয়েছে। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। কিছুদিন পরেই উত্তরপ্রদেশে ভোট। তাই বিজেপিও দ্রুত এর ক্ষতি সামলাতে নেমেছে। তড়িঘড়ি তিনজন পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু এসব করে আর লাভ হচ্ছে না।
এই লেখার ফাঁকে দেখছি, খবর পাচ্ছি, হাজার হাজার যুবক বিহার জুড়ে মিছিল করছেন বনধের সমর্থনে। আমি নিশ্চিত, পুলিশ দমনপীড়ন করলে তাঁরা রুখে দাঁড়াবেন। পশ্চিমবঙ্গেও নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি রয়েছে, কর্মসংস্থানের দাবিতে প্রতিবাদ রয়েছে। তাকে বড় আন্দোলনের চেহারা দিতে হবে। বিজেপি প্রধান বিরোধী দল। তারা কিছু করবে না, তাদের করার নৈতিক অধিকারও নেই। এই দায়িত্ব বামপন্থীদের। আশা করি, বাংলাতেও আমরা, বামপন্থীরা এই দায়িত্ব পালন করব। এই রকমের আন্দোলন গড়ে তুললেই বিরোধী হিসাবে জায়গা ফিরে পাওয়া সম্ভব, বিজেপিকে আরও কোণঠাসা করা সম্ভব।
২০২০ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসে এনআরসি-এনপিআর বিরোধী ঐতিহাসিক প্রতিবাদের ছবি এঁকেছিল শাহীনবাগ। ২০২১ সালে কৃষক আন্দোলনকারীরা রাজধানী দখল করে নিয়েছিলেন। আর ২০২২ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসে প্রতিবাদের আগুন জ্বেলে দিলেন চাকরিপ্রার্থী যুবকরা। এই হল আমাদের দেশ। ফ্যাসিবাদকে এক ইঞ্চি জমিও এই দেশের সাধারণ মানুষ ছেড়ে দেবেন না। যে সাধারণতন্ত্রকে লুঠ করা হয়েছে, এই রকম গণআন্দোলনের ঢেউ তাকে পুনরুদ্ধার করবে।
লেখক সিপিআইএমএল লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। মতামত ব্যক্তিগত।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।