২০১৮ সালে দি অ্যাসোসিয়েশন ফর ফিজিওলজিক্যাল সাইন্স (এপিএস), লিডস বেকট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিজবার্ট স্টোয়েটের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যা মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজিক্যাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক দারিদ গ্যারীর সঙ্গে মিলে লেখা। নিবন্ধের নাম ‘সমতার বিজ্ঞাপিত ধোঁকা, বিজ্ঞান, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গণিত শিক্ষায় নারীর হাতেগোনা অবস্থান’।
তাঁদের গবেষণাপত্রে অধ্যাপকরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং অন্যান্য সহ-সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলিতে নারীর অপ্রতুল উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। জ্ঞানীয় ক্ষমতা, মিশ্র সংস্কৃতির পার্থক্য, শিক্ষাগত মনোবিজ্ঞান, বিজ্ঞান শিক্ষা, যৌন মননের পার্থক্যের উপর বাস্তবসম্মত অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা দেখিয়েছেন, যে দেশ এমনকি ইতিহাসে প্রথম মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়ার গৌরব অর্জন করেছে, সেই নিউজিল্যান্ডও এসটিইএম ফিল্ড সংক্রান্ত কলেজ ডিগ্রিতে সর্বোচ্চ লিঙ্গবৈষম্যের স্বীকার। অধ্যাপক স্টোয়েট ও গ্যারী জানাচ্ছেন, তাঁরা তাঁদের গবেষণা পদ্ধতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে বিজ্ঞান চর্চার নানা শাখা উপশাখায় মহিলাদের অবস্থান নির্ণয় করার জন্য বিজ্ঞান সাক্ষরতার ক্ষেত্রে বিশ্বের বৃহত্তম শিক্ষামূলক জরিপ পিআইএসএ (ওইসিডি, ২০১৬বি)-এর সহায়তা নিয়েছেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বলাই বাহুল্য, ভারতবর্ষের মত দেশ, যেখানে এমনকি বিজ্ঞান না পড়া পুরুষদের পর্যন্ত তাদের আলোয় আসা আত্মীয়স্বজন সারাজীবন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বিচার করে গঞ্জনা দেয় এবং বাড়িতে ইংরেজি কাগজ রাখাকে সামাজিক উন্নতির মাত্রা হিসাবে ভাবা হয়, সেখানে দু-একটা পায়েল তদভি, ডেল্টা মেঘাওয়াল, চুনী কোটাল তো ফুচকার ফাউ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে উমা চক্রবর্তী সম্পাদিত বই জেন্ডারিং কাস্ট–এর প্রথম কয়েক লাইন। উমা লিখছেন, যখন মন্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী উগ্র হিন্দু শক্তিগুলির প্রত্যক্ষ মদতে দিল্লিতে গন্ডগোল চলছে, তখন দেখা গেল এমনকি মেয়েরাও প্ল্যাকার্ড তুলেছে তারা “কোটার আইএএস, আইপিএসদের বিয়ে করতে চায় না”। তাহলে আজ সমস্ত ক্ষেত্রে মহিলাদের অর্ধেক আকাশ এবং মহিলাসহ সমস্ত প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের সমানাধিকারের লড়াইয়ের বিরোধী ঘৃণার স্রোতের প্রচারক যে আসলে কারা, তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
রুথ মনোরমা ‘দলিত মহিলা, নিপীড়িতের মধ্যে নিপীড়িততম’ শীর্ষক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, ১৯৭৭ থেকে ৭৮ — মাত্র এই এক বছরে দলিত মহিলাদের খুন, ধর্ষণ, হিংসা ইত্যাদি অপরাধ কিভাবে ৩৬% থেকে ৬৭% হয়ে গেছে। মনে রাখতে, হবে ওই সময়টা ভারতের ইতিহাসের অন্ধকারতম সময় জরুরি অবস্থার অন্তিম ভাগ। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের প্রতি ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জনসঙ্ঘ থেকে এক বিষাক্ত শক্তি — ভারতীয় জনতা পার্টির আত্মপ্রকাশের আদিকাল।
গবেষক কুমুদ পাওরে আমার সংস্কৃত পাঠের বয়ান প্রবন্ধে বলেছেন, যেহেতু শিক্ষাকে মোটামুটি বহুকাল ধরেই দেশ নির্বিশেষে সামাজিক গতিময়তা, বৌদ্ধিক বিস্তার ইত্যাদির প্রধান উপকরণ হিসাবে মানা হয়, তাই যাদের এমনিতেই নিজ অবস্থান সম্পর্কিত আত্মোপলব্ধির অধিকার দিতে সমাজ রাজি নয়, তাদের পড়াশুনার জগতে প্রবেশের টিকিট দিতেও রাজি নয়। আর ভারতের মতো দেশ, যেখানে দেশের প্রাচীনত্বকে জানার সবথেকে বড় উপকরণ হল সংস্কৃত, সেখানে সংস্কৃতকে নিছক সমৃদ্ধ ভাষা ও ইতিহাস সম্পৃক্ততার উপকরণ থেকে হিন্দুত্বের মূল কথক হিসাবে রূপান্তরিত করাটা একান্তই জরুরি হয়ে পড়েছিল। তা না হলে ইতিহাস বদলে দেওয়ার সুপরিকল্পিত খেলার সূচনা করা মুশকিল হত।
সারা বিশ্বের মত শুধু লিঙ্গ বা গায়ের রংয়ের কারণে বৈষম্য নয়, ভারতে শূদ্র এবং শূদ্রদেরও নীচের তলার হিসাবহীন জনগোষ্ঠী যে বংশপরিচয়ের কারণেও আজন্ম শোষিত হয়ে চলেছে, তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। ফলে জাতি, বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে নারীই জন্ম অপরাধের দায়ে যুগে যুগে শোষণের ধারাবাহিকতার সবথেকে বড় বলি হয়ে আসছে। তাই মহিলারা শুধু প্রান্তিক লিঙ্গই নয়, প্রান্তিক নাগরিক গোষ্ঠীও বটে। এখন তো আবার নিজেকে নাগরিক বলার জোরের উপর, বলা ভাল, স্বাভাবিক নিশ্চিন্ততার উপরও আঘাত নেমে আসছে। যদিও সেই আঘাতের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ের নেতৃত্বে সেই মহিলারাই।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, কীভাবে বিউবনিক প্লেগ থেকে শুরু করে স্প্যানিশ ফ্লু হয়ে আজকের এই তিন অধ্যায়ের কোভিড মহামারী অবধি সবথেকে বেশী মৃত্যুহার মহিলাদেরই। বাড়ির বাইরের যাতায়াতে সারা পৃথিবীতে মহিলাদের থেকে পুরুষদের অধিকার ও গতিবিধি বেশি থাকলেও রাস্তার দুর্ঘটনা কীভাবে মহিলাদের প্রাণ বেশি কেড়ে নিচ্ছে তা-ও দেখানো হয়েছে। কীভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরেও মহিলারা নিজেদের অধিকারের দাবিতে লড়ছেন, কীভাবে দুই মহাযুদ্ধের প্রতিদিনের খবর সে সময় যারা কিশোর ছিল তারা বেশি জানতে পারত তখনকার কিশোরীদের তুলনায়।
মজার ব্যাপার হল, এই যে সমানাধিকারের পাঠ বা লিঙ্গ জ্ঞানতত্ত্ব, সেখানেও ধীরে ধীরে মহিলা এবং প্রান্তিক লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের হঠিয়ে দখলদারি শুরু করেছে পুরুষ। তবু লড়াই হবে, বারুদ গন্ধের সব শহরে উথাল পাথাল আগামীর সব লড়াইয়ের অগ্রণী ফ্রন্টে থাকবেন গ্রাম শহরের সমস্ত মুক্তিকামী জনতা।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।