লেনিন তাঁর রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থের সূচনাতেই লিখেছেন, সমস্ত বিপ্লবী চরিত্রকেই মৃত্যুর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত শক্তির তরফ থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু মৃত্যুর পরে – “…এইসব বিপ্লবীকে নিরীহ দেব-বিগ্রহে পরিণত করিবার, সাধু সিদ্ধপুরুষ রূপে ঘৃণা করিবার চেষ্টা হইয়া থাকে, নিপীড়িত শ্রেণীদের ‘সান্ত্বনা’র জন্য এবং তাহাদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই-সব বিপ্লবীর নামের সহিত একটা জৌলুস জুড়িয়া দেওয়া হয়; সেই-সঙ্গে তাঁহাদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে ছাঁটিয়া দিয়া তাহাকে নির্বীর্য করা খেলো করা হয়, তাঁহার বৈপ্লবিক তীক্ষ্ণতা ভোঁতা করিয়া দেওয়া হয়।” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যে ঐতিহাসিক চরিত্রের ক্ষেত্রে এই কথা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রযোজ্য, তিনি হলেন মহাত্মা গান্ধী।
সাধারণভাবে বিপ্লব বলতে আমাদের চোখের সামনে যা ভেসে ওঠে, সেই প্রকার কোনো সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সমর্থক গান্ধী ছিলেন না, একথা সত্যি। একই সঙ্গে, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আজ অবধি, এই দেশের শাসকশ্রেণি তাঁকে যেভাবে স্থিতাবস্থার প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেছে, তা-ও মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাধারার প্রতি অবিচার। তাঁর চিন্তা, তাঁর মত করে নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক; প্রতিক্রিয়াশীলতা বা স্থিতাবস্থার সমর্থকও তিনি নন। ঠিক এই কারণেই এ অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যাঁরা এই দেশের প্রতিষ্ঠিত শাসনকাঠামোর বদল চান, সেই প্রগতিশীলরাও, বিশেষ করে সাম্যবাদীরা, গান্ধীকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছেন। এমন নয় তাঁরা গান্ধীকে অশ্রদ্ধা করেন, কিন্তু অধিকাংশই মনে করেন মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাধারা থেকে তাঁদের কিছু নেওয়ার নেই এবং যে নতুন ভারতের তাঁরা স্বপ্ন দেখেন, সেখানে গান্ধীর ভাবনার কোনো সাদৃশ্য নেই। এই ভাবনা প্রতিষ্ঠিত গান্ধীর চিন্তাধারা সম্পর্কে কতকগুলি ভ্রান্ত, অথচ বহুল প্রচলিত ধারণার উপর। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক হল গান্ধীজীর অছি সংক্রান্ত ভাবনা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। শাসকগোষ্ঠী এই ধারণাকে তুলে ধরে সমাজবিদ্রোহের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে। এ অতি স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। সমস্যা হল, যাঁরা এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে, তাঁরাও একবারও অছি সংক্রান্ত ধারণায় গান্ধীজীর চিন্তার বিবর্তন অনুসরণ করতে আগ্রহী নন। বরং একে তাঁরা গান্ধীজীর প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রতিবিপ্লবী চরিত্রের অকাট্য প্রমাণ হিসাবে ধরে নেন। এই শোচনীয় পরিস্থিতির বদল একান্তই প্রয়োজন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মহাত্মা গান্ধী অছি সম্পর্কিত ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন ঈশোপনিষদের প্রথম স্তোত্র থেকে। এর অনুসরণে তিনি মনে করতেন, সমস্ত ধনই প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের। এর উপর কোনো ব্যক্তি মানুষের অধিকার নেই, একমাত্র সমষ্টির অধিকার আছে। সমাজের যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-জমিদার শ্রেণি বর্তমান, নিজেদের সঞ্চিত সম্পদের বা জমির উপর তাঁদের কোনো অধিকার নেই। তাঁরা সমষ্টির এই সম্পত্তির অছি বা trustee মাত্র। তিনি দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন এবং এই বৈষম্য যে চূড়ান্ত অন্যায্য এক শাসন কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত সেই সম্পর্কেও কোনো সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীর সঙ্গে তাঁর দ্বিমত ছিল না। কিন্তু গান্ধীজীর ভাবনার প্রধান উপাদানই ছিল অহিংসা। যদিও বিশ্লেষণে ও কাঙ্খিত লক্ষ্যে তাঁর সঙ্গে সমাজতন্ত্রীদের ও সাম্যবাদীদের কোনো তফাত ছিল না, পন্থায় তাঁদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে বিপুল ব্যবধান ছিল। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সম্পত্তির পুনর্বন্টন তিনি প্রাথমিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। বরং অহিংস প্রক্রিয়ায় ধনিক শ্রেণির মন পরিবর্তনের মাধ্যমে তাঁরা যাতে অছি হিসাবে নিজেদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সেই দিকেই গান্ধীজির প্রচেষ্টা ছিল। এই প্রচেষ্টাকে অনেক সময়েই সমাজতন্ত্রীরা দেশীয় ধনিক শ্রেণির প্রতি দুর্বলতার নিদর্শন বলে মনে করেন। গান্ধীজি কিন্তু সূচনা থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, আদৌ তাঁর ধনিক শ্রেণির প্রতি মনোভাব নরম নয়। তিনি ১৯৩০ সালে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন “The greatest obstacle in the path of non-violence is the presence in our midst of the indigenous interests that have sprung up from British rule, the interests of the monied man, speculators, scrip-holders, land-holders, factory owners and the like. All these do not always realise that they are living on the blood of the masses, and when they do, they become as callous as the British principals whose tools and agents they are.” এই বক্তব্য, বলাই বাহুল্য, কোনোভাবেই শ্রেণি সমঝোতার সমর্থক অথবা দেশীয় ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী ব্যক্তির নয়। ১৯৩৯ সালে হরিজন পত্রিকায় আমরা দেখি, গান্ধীজী লিখছেন “…I desire to end capitalism, almost, if not quite, as much as the most advanced socialist, or even communist. But our methods differ, our language differ.” এর পরেই তিনি একটি মোক্ষম মন্তব্য করছেন “My theory of ‘Trusteeship’ is makeshift, certainly no camouflage.”
এই “makeshift” কথাটা ভীষণ জরুরি। গান্ধীজীর trusteeship-এর তত্ত্বকে শাসকগোষ্ঠীর প্রশংসাতেই হোক কি সাম্যবাদীদের নিন্দাতেই হোক, অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রসঙ্গে তাঁর সমাধানের শেষ কথা বলে ধরা হয়। এই বক্তব্যই অকাট্য প্রমাণ, যে আদৌ তা নয়। আদতে এটি পুঁজিবাদ-জমিদারির সমস্যা ও অহিংসার প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত গভীর বিশ্বাসের যে সংঘাত তার সমাধানে গান্ধীজির প্রথম কথা। এই কথা তাঁর নিজেরও খুব পছন্দ ছিল, এমন একেবারেই নয়। কিন্তু উন্নততর বিকল্পের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত, পুঁজিবাদের বিলোপের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে অছিই ছিল তাঁর “makeshift” সমাধান। গান্ধী দ্বিচারী ছিলেন না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই যে হিংসা রয়েছে, এ তিনি কোনোদিন অস্বীকার করেননি, তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছেন “Exploitation is the very basis of violence”। অন্যত্র আবার বলেছেন পুঁজিবাদী সমাজে “…accumulation by private persons was impossible except through violent means.” এই হিংসার অবসানের জন্য পুঁজিবাদের অবসান ও সম্পদের পুনর্বন্টন দরকার এবং অহিংসভাবে এই পুনর্বন্টনের প্রথম অস্থায়ী ধাপ হবে অছি ব্যবস্থা — এই ছিল মহাত্মার ধারণা। কিন্তু আমরা দেখতে পাই তিনি যখন ক্রমে উপলব্ধি করলেন পুঁজিপতি-জমিদাররা বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী ত্যাগ করতে রাজি নয়, কোনো অহিংসার বাণীই তাদের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম নয়, তখন গান্ধীজী অছি সম্পর্কে ক্রমশ মত পাল্টাচ্ছেন। তিনি বলছেন “I would be very happy indeed if the people concerned behaved as trustees, but if they fail, I believe we shall have to deprive them of their possessions through the state with the minimum exercise of violence. That is why I said at the Round Table Conference that every vested interest must be subjected to scrutiny and confiscation ordered where necessary – with or without compensation as the case demanded.”
এ কোন গান্ধী? এই গান্ধীকে আমাদের চেনানো হয় না, আমরা চেনার চেষ্টাও করি না। তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বলছেন, যদি ধনিক শ্রেণী অছি হতে রাজি না হয় তাহলে তাদের সম্পত্তি রাষ্ট্র কর্তৃক অধিগ্রহণ করতে হবে, তেমন হলে কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়া। একথা সত্যি, তিনি তখনো ন্যূনতম হিংসার আশ্রয় নিতে হবে বলছেন। কিন্তু সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে, আঙুল বেঁকাতে তাঁর আর কোনো দ্বিধা নেই। ১৯৪০ সালে তিনি হরিজন পত্রিকায় লিখছেন, ধনিক শ্রেণি যদি দরিদ্র জনতার প্রতি অছি হিসাবে কর্তব্য পালন করতে অস্বীকৃত হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ বা আইন অমান্য আন্দোলনে নামতে হবে। তিনি বলেন দরিদ্রের সহায়তা ছাড়া ধনী অর্থ সঞ্চয় করতে পারে না। সংখ্যাগুরু দরিদ্র জনতা যদি মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অসহযোগিতা করে, আন্দোলনে যায়, তাহলে তাদের প্রতিহত করার ক্ষমতা কারোর নেই। তিনি আরও লেখেন “…Not merely by verbal persuasion. I will concentrate on any means (non-violence etc.). Some have called me the greatest revolutionary of my time. It may be false, but I believe myself to be a revolutionary, a non-violent revolutionary. My means are non-cooperation. No person can amass wealth without cooperation, willing or forced, of the people concerned.”
শুধু মুখের কথায় যে তাঁর আর আস্থা থাকছে না, অছি সম্পর্কে গান্ধীজির ভাবনা যে বদলাচ্ছে, তা চমৎকার বোঝা যায় ১৯৪২ সালের জুন মাসে, আগস্ট আন্দোলনের প্রাক্কালে সাংবাদিক লুই ফিশারকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে। এই সাক্ষাৎকার অতীব জরুরি, তাই এর পাঠ প্রয়োজন
I (Louis Fischer-A week with India,) asked, “What is your programme for improvement of the lot of peasantry?” “The peasants would take the land,” he replied, “We would not have to tell them to take it. They would take it.”
“Should the landlords be compensated ?” I asked/
“No,” he said, “that would be fiscally impossible.”
“You see,” he smiled, “our gratitude to our millionaire friends does not prevent us from saying such things. The village would become a self-governing unit living its own life.”
Another interview given two days later runs thus:
“Well,” I asked, “how do you expect your impending civil disobedience movement ? What shape will it take ?”
“In the village,” explained Gandhiji, “the peasant will stop paying taxes. They will make salt despite official prohibition…Their next step will be to seize land.”
“With violence ?” I asked.
“There may be violence, but then again the landlord may co-operate.”
“You are an optimist,” I said.
“They might co-operate by fleeing,” Gandhi replied.
“Or,” I said, “they might organise resistance?”
“There may be fifteen days of chaos,” Gandhi speculated, “but I think we could soon bring that under control.”
“You feel then that it must be confiscation without compensation?” I asked/
“Of course,” Gandhi agreed, “It would be financially impossible for anybody to compensate the landlords.”
এই কথোপকথনেই স্পষ্ট, মহাত্মার চিন্তাধারার কি বিপুল পরিবর্তন হয়েছিল অছি প্রসঙ্গে। এই একই ব্যক্তি প্রাথমিকভাবে সম্পত্তি পুনর্বন্টন প্রসঙ্গে সবরকম হিংসা পরিত্যাগ করার কথা বলেছিলেন, অহিংসার মাধ্যমে পুঁজিপতি-জমিদারদের মন বদলানোর কথা বলেছিলেন। যখন দেখলেন তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না, তিনি একটু কঠোর হলেন, অছি হতে নারাজ হলে রাষ্ট্রের মাধ্যমে ন্যূনতম হিংসার প্রয়োগ ঘটিয়ে পুনর্বন্টনের কথা বললেন, সবাই ক্ষতিপূরণ পাবে এমন নয়, বললেন ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে।
আগস্ট আন্দোলনের প্রাক্কালে আমরা দেখছি তিনি সুস্পষ্টভাবে বিনা ক্ষতিপূরণে, গায়ের জোরে কৃষক কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের কথা বলছেন। কৌতুকসহ এও জুড়ে দিচ্ছেন, জমিদাররা পালিয়ে গিয়ে সহায়তা করতে পারেন। ভূমি বন্টন প্রসঙ্গে গান্ধীজির এই সময়ে মতের কতটা বদল এসেছিল তা তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হরিজন পত্রিকার একটি প্রবন্ধ থেকে বোঝা যায়। উনি লিখছেন “Land will be owned by the state. I presume the reins of the Government will be in the hands of those who have faith in this ideal. A majority of Zaminders will give up their land willingly. Those who do not do so will have to be do under legislation,”
অর্থাৎ আমরা দেখছি পূর্বে অছি সম্পর্কে তাঁর যে “makeshift” ধারণা ছিল, তা থেকে তিনি অনেকটা সরে এসেছেন, জমির রাষ্ট্রায়ত্তকরণে তিনি আস্থা রাখছেন এবং যদিও আশা রাখছেন অধিকাংশ জমিদার সরকারের হাতে জমি স্বেচ্ছায় তুলে দেবে, যারা দেবে না তাদের হৃদয় পরিবর্তনে আর আস্থা রাখছেন না। আইনের জোরে রাষ্ট্র তাদের থেকে জমির দখল নেবে, একথা সোজাসুজি বলছেন। তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে সমাজতন্ত্রীদের কার্যত কোনো তফাতই থাকছে না। বরং তিনি সমাজতন্ত্রীদের থেকে একধাপ এগিয়ে প্রস্তাব রাখছেন। এ দেশের সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীরা শুধু ভূমি সংস্কারের কথাই বলেছেন, যার মূল কথা ভূমির পুনর্বন্টন। গান্ধীজি বলছেন জমির রাষ্ট্রায়ত্তকরণের ও সমাজের অছি হিসাবে রাষ্ট্রের হাতে সেই সম্পত্তি রাখার কথা, যা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে করা হয়েছিল। অবশ্যই একথা বলা দরকার, উক্ত দেশগুলিতে যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছিল, তা গান্ধীজি কখনোই সমর্থন করতেন না। তিনি মানুষের সৎ চরিত্রের প্রতি আস্থা রাখতেন এবং তখনো আশা রেখেছিলেন জমিদাররা স্বেচ্ছায় জমি ত্যাগ করবে। কিন্তু তা না করলে আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জমি অধিগ্রহণের নিদানও দিয়েছিলেন, যার সঙ্গে অছি প্রথা প্রসঙ্গে তাঁর প্রাথমিক বক্তব্যের সুগভীর পার্থক্য রয়েছে।
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান ছিল, তা ছিল হিংসার প্রশ্নে। এছাড়া, তিনি এমনকি শ্রেণি সংগ্রাম প্রসঙ্গেও পরবর্তীকালে তাঁর অবস্থান নরম করেছিলেন। অতুল্য ঘোষ লিখেছেন, কংগ্রেস সোশালিস্টদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গান্ধী জানান, তিনি “অহিংস শ্রেণীসংগ্রামের বিরোধী নহেন”। দুঃখের বিষয়, অছি প্রশ্নে তাঁর অবস্থানকে সাম্যবাদীরা একপ্রকার শ্রেণি সমঝোতার বাইরে আর কোনোভাবে দেখার প্রচেষ্টা করেননি এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজির বিবর্তন নিয়েও আলোচনার চেষ্টা করেননি। প্রখ্যাত আরসিপিআই নেতা পান্নালাল দাশগুপ্তের মত কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া সাম্যবাদীদের গান্ধী প্রসঙ্গে এই অতিসরলীকৃত মূল্যায়ন শাসকশ্রেণিকে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ও গণরাজনীতির জনকের উপর একচেটিয়া অধিকার দান করেছে এবং মহাত্মার চিন্তার সবরকম বৈপ্লবিক উপকরণ ছেঁটে ফেলে তাঁকে স্থিতাবস্থার ও রক্ষণশীলতার প্রতীকে পরিণত করেছে।
সাম্প্রতিককালে এই একইরকম প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া আরেক ঐতিহাসিক চরিত্র, মার্কিন দেশের সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মার্টিন লুথার কিংয়ের চিন্তার বৈপ্লবিক উপাদান সেই দেশের বামপন্থীরা পুনর্মূল্যায়ন করছেন। এ দেশেও একইভাবে মহাত্মার চিন্তাধারার সাম্যবাদীদের তরফ থেকে পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে। শুধু অছি নয়, তাঁর সামগ্রিক ভাবনারই। দীর্ঘকাল তাঁর ভাবনার ব্যাখ্যা ও সেই সম্পর্কে জনতার ধারণার রাশ থেকেছে এই দেশের কায়েমি স্বার্থের হাতে। এমনকি ‘গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র’ নামের আড়ালে এই শতকের শুরুতে নব্য উদারনীতিবাদের বিজয়রথও চালানো হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসা এই ধারা আজও অব্যাহত। এই ঐতিহ্য মেনেই আজ তিরিশে জানুয়ারি যে আততায়ীর হাতে মহাত্মা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন, সেই নাথুরাম গডসের ভক্তবৃন্দই ‘মন মে বাপু’ টি-শার্ট পরিধান করে ভক্ত সেজে আবির্ভূত হবে। ব্যক্তি গান্ধীকে হত্যা করলেই হয় না, বারবার হত্যা করতে হবে তাঁর মতাদর্শকেও।
একথা সত্য যে মহাত্মার মতাদর্শ অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধী, এ তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন, সারাজীবন তিনি শিখতে শিখতে এগিয়েছেন এবং শেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা সংশোধন করেছেন। এই দিক থেকে দেখলে সাম্যবাদীরা কেন অছি সংক্রান্ত তাঁর প্রাথমিক মতামতকে কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠীর মত শেষ কথা বলে ধরে নিয়ে এগোবে? তিরিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সমগ্র চল্লিশের দশক ধরে মহাত্মার চিন্তাধারায় ক্রমশ যে বৈপ্লবিক বদল এসেছে, তার সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়নি। তাঁর সমস্ত বক্তব্যের ও চিন্তাসূত্রের সঙ্গে সাম্যবাদীরা, এমনকি প্রগতিশীলরা সহমত হবেন না, আদর্শগত ভাবে সততার পরিচয় দিলে হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু তাঁর সঠিক মূল্যায়ন না করলে, সাম্যবাদীদের তরফে মহাত্মার মূল্যায়নে যে ঐতিহাসিক ভ্রান্তি ছিল তার সংশোধন হবে না এবং তাঁর মতাদর্শ শাসকগোষ্ঠীর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে যাবে অনন্তকাল।
তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাই প্রশ্ন থাকল, এই ভ্রান্তি সংশোধনের প্রচেষ্টায় কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে ভাষ্যের লড়াইয়ে নামতে সাম্যবাদীরা প্রস্তুত, নাকি পূর্বের মতই তাঁরা মহাত্মাকে শাসকগোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দিয়ে শুধু দূর থেকে সম্মান জানিয়ে সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্ব রাখতে আগ্রহী?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।