গত ২৬ জানুয়ারি পদ্ম সম্মানের তালিকা প্রকাশ হবার পর একটা নতুন উপলব্ধি হল। এই পুরস্কারগুলি বর্তমান সময়ে যাঁরা গ্রহণ করেছেন, তাঁরা এবং তাঁদের অনুগামীরা এখন ক্ষীণকণ্ঠ; বরং যাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদের রমরমা অনেক বেশি, অন্তত এই মুহূর্তে। তাই, যাঁরা এত বছর বিভিন্ন সময়ে, এবং বিভিন্ন কারণে, এই পুরস্কারগুলি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের নামগুলি খুঁজে দেখার নতুন করে উৎসাহ পাওয়া গেল।

দেখা যাচ্ছে, অন্তত জনা দুয়েক মানুষ আছেন যাঁরা একাধিকবার, অর্থাৎ দুবার, এই পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছেন। একজন ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার, দ্বিতীয় ব্যক্তি সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জনের ক্ষেত্রে কারণটা ব্যক্তিগত, হেমন্তবাবুর খুব সম্ভবত মনে হয়েছিল তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হচ্ছে না, অথবা হলেও সেটা হচ্ছে অনেক দেরিতে। তিনি প্রথমবার ফিরিয়ে দেন পদ্মশ্রী, এরপর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন পদ্মভূষণ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

রোমিলা থাপার কিন্তু দুবারই পরিষ্কার জানিয়ে দেন, যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা তাঁর যে বিষয়ে ব্যুৎপত্তি, সেই বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত কোনো সংস্থা তাঁকে সম্মান জানাতে মনস্থ করে, তাহলে সেই পুরস্কার তিনি অবশ্যই গ্রহণ করবেন। অন্য কোনো পুরস্কারের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই।

রোমিলার যুক্তিটি আকর্ষণীয়। সত্যিই তো, একজন মানুষ যে পেশার সঙ্গে যুক্ত, সেই পেশার বিদগ্ধজনেরা যখন তাঁকে পুরস্কৃত করবার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত বোধ করেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই যুক্তির খাতিরেই আগ্রহ হয় একটি ব্যাপার জেনে নিতে — সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় স্তরে যে সরকারি পুরস্কারগুলির মর্যাদা সবচাইতে বেশি, সেগুলি আমাদের রাজ্যের, অর্থাৎ বাংলার শিল্পীদের ঠিক কত ঘনঘন দেওয়া হয়েছে? যেহেতু এই মুহূর্তে যাবতীয় বিতর্কের হেতু বাংলার প্রবীণতম শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দেওয়া, সেহেতু আমাদের আলোচনা সঙ্গীতেই সীমাবদ্ধ থাক।

পুরস্কারগুলিকে দুভাগে বিভক্ত করলে সম্ভবত ভালো হবে — জাতীয় ফিল্ম পুরস্কার এবং সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। এই দুটি সরকারি পুরস্কারে মনোনীত হলে যে কোনো শিল্পীই স্বাভাবিকভাবেই গর্বিত বোধ করেন।

জাতীয় ফিল্ম পুরস্কারের মধ্যে সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য তিন ধরনের পুরস্কার আছে। সেরা সঙ্গীত পরিচালক, সেরা পুরুষ সঙ্গীতশিল্পী এবং সেরা মহিলা সঙ্গীতশিল্পী। তিনজনের হাতেই প্রতি বছর পুরস্কার তুলে দেন স্বয়ং দেশের রাষ্ট্রপতি। ফলত, এই পুরস্কারগুলির সামাজিক মূল্য অপরিসীম।

পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় চোখ বোলালে, একটু দুঃখ হয় বৈকি। গত পঞ্চাশ বছরের বেশি ধরে এই পুরস্কারগুলি দেওয়া হলেও, বিরাট সংখ্যক বাঙালি সঙ্গীতশিল্পীর কপালে বাংলা গানের জন্য এই পুরস্কার জুটেছে, এমন কথা মোটেই জোর দিয়ে বলা যাবে না।

সেরা সঙ্গীত পরিচালকদের তালিকা দেখলে মনে হয়, একবিংশ শতাব্দীতে বরং কপাল খুলেছে বাংলা ছবির। সঙ্গত কারণেই পুরস্কৃত হয়েছেন নীল দত্ত, কবীর সুমন, ময়ূখ ভৌমিক, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রতিভাবান সঙ্গীত বিশারদরা। এর পূর্বে চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা তালিকায় খুঁজে পাই শুধু সত্যজিৎ রায় অথবা আনন্দশঙ্করকে; অর্থাৎ নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, রবীন চট্টোপাধ্যায় অথবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত কিংবদন্তীদের কপালে কোনোদিনই এই পুরস্কার জোটেনি।

একই কথা বলা যায় পুরুষ এবং মহিলা কণ্ঠশিল্পীদের ক্ষেত্রেও। বাংলা ছবির জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (দুবার), মান্না দে, অনুপ ঘোষাল, রুপম ইসলাম, রূপঙ্কর, ইত্যাদিরা; কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের প্রবাদপ্রতিম বাঙালি শিল্পীদের অনেকেই, যেমন শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, এঁরা কোনোদিনই বিবেচিত হননি। যেমন মহিলা শিল্পীদের মধ্যে পুরস্কৃত হননি প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, নির্মলা মিশ্ররা। ১৯৭০ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, এর প্রায় তিরিশ বছর বাদে যোগ হয় জয়শ্রী দাশগুপ্তের নাম। তবে পরবর্তীকালে আমাদের গর্বিত করেছেন শ্রেয়া ঘোষাল, নীলাঞ্জনা সরকার, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, ইমন চক্রবর্তীর মত বাংলা ছবির গায়িকারা।

না, এর মধ্যে কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ আছে, এমন কথা বলবার মোটেই চেষ্টা করা হচ্ছে না। বরং মেনে নিতে হয় এটাই বাস্তব। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কার তালিকার দিকে তাকালেও একটু মন খারাপ হয়ে যায়। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কথা ছেড়ে দেওয়া যাক, অন্যান্য ধরনের গান বা লঘু সঙ্গীতের জন্য এই এত বছরে পুরস্কার পেয়েছেন এমন বাঙালি শিল্পীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তিমিরবরণ, রাইচাঁদ বড়াল, অনিল বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অমর পাল, সলিল চৌধুরী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য অর্ঘ্য সেন, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় এবং মোহন সিং। আমাদের বহু প্রিয় শিল্পীকে এই তালিকায় না দেখতে পেয়ে আমরা কিছুটা মুষড়ে পড়ি বৈকি।

এখন মুশকিল একটাই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পদ্ম সম্মান নিয়ে যেমন দিকে দিকে লোকজন “গর্জে” উঠছেন, তেমনটা কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে ঘটেনি। যাঁরা বাংলা গানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁদেরও কোনোদিন শ্যামল অথবা প্রতিমার জন্য আফসোস করা তো দূরের কথা, বিস্ময়টুকুও প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য আন্দোলন করা তাদের কাজ নয়। কিন্তু অন্য যাঁরা আজ চোখের জল ফেলছেন, লোককে নিয়মিত ধমকাচ্ছেন, চমকাচ্ছেন, তাঁরা কী করছিলেন? নাকি ওই ব্যাপারে প্রতিবাদ করলে পদ্ম সম্মানের মত প্রচার পাওয়া যায় না, তাই এই নীরবতা?

একজন শিল্পীকে তো দেখা গেল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুঃখে একেবারে শ-কার ব-কারে নেমে এসেছেন। ভাল। আসলে গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক আবহে রুচির নিম্নগামিতা রীতিমত গর্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শিল্পী এই বিশেষ সময়ের উচ্চকিত বাই-প্রোডাক্ট, তাঁর কাছ থেকে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। নিজের সমর্থনে তিনি সমালোচকদের কিছু শক্ত শক্ত ইংরেজি বই পড়ে নিতে বলেছেন। শুধু ভুলে গেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদের সঙ্গে মহিলাদের বিশেষ অঙ্গের বর্ণনাযুক্ত বাক্যবন্ধের কোনো যোগ নেই। উপকার করলেন তিনি তাঁদেরই, যাঁরা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে অপমান করবার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল। এই শিল্পীকে আবার জ্ঞান দিয়েছেন এমন একজন, যাঁর কণ্ঠরোধ করবার জন্য একসময় বাংলার পুলিশ প্রিজন ভ্যানকে তবলার মত ব্যবহার করত।

এককথায় যাকে বলে নরক গুলজার। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কি এমনটাই চেয়েছিলেন?

মতামত ব্যক্তিগত। 

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.