কবীর সুমন

প্রজাতন্ত্র দিবস একটা অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এই তারিখে আমাদের দেশের সংবিধান কায়েম হয়েছিল। সেই দিক থেকে দেখলে এই দিনটি আমাদের জাতির প্রথম সোপান। যদি এই দেশকে মানতে হয়, তাহলে ২৬ জানুয়ারির গুরুত্ব অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ঠিক সেই জায়গা থেকেই এই বছরের প্রজাতন্ত্র দিবস আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে আমার। ভারত এখনো একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষকরাই এই দেশের ভিত্তি। তাঁরাই ভারতের চালিকাশক্তি, আমাদের অন্নদাতা। আমার মনে হয়, আগামীতেও আরো অনেক দিন ভারত কৃষিপ্রধান দেশই থাকবে। সেই কৃষকরা এখন রাস্তায় নেমে এসেছেন। প্রজাতন্ত্র দিবসে তাঁরা রাজধানী অবরোধ করে রেখেছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আমি দেখছি, আমার দেশের কৃষকরা নতুন করে প্রজাতন্ত্রের উপর তাঁদের অধিকার দাবি করছেন। এটা একটা আশ্চর্য বিষয়।

দেশে বড় কৃষক যেমন আছেন, তেমন কোটি কোটি গরীব, ছোট কৃষকও আছেন। আমাদের বাংলায় যেমন বড় জোত প্রায় নেই, অধিকাংশই ছোট কৃষক। আবার পাঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যে একাধিক ট্র্যাক্টরের মালিক কৃষকরা রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার এই দুই ধরনের কৃষকেরই বিরোধিতায় উঠে পড়ে লেগেছেন। এমন একটা কৃষি আইন ওঁরা তৈরি করলেন, যা কেবলমাত্র বড় পুঁজিপতিদেরই স্বার্থরক্ষা করবে। আমার এই ভারতকে আর কোন দেশ বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটা একটা বড়লোকদের ক্লাব যেন। আদানি-আম্বানিদের জিমখানা ক্লাবে পরিণত করা হয়েছে ভারতকে। আমার ৭৩ বছর বয়স হল। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আমার মনে হচ্ছে, যদি প্রজাতন্ত্রে থাকতে হয়, যদি ভারতের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে কৃষকদের সঙ্গে না থেকে কোন উপায় নেই।

আমি ৫ বছর সাংসদ ছিলাম৷ যদিও আমি যেমন লোক, তাতে আমার কোনকালেই সাংসদ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়ে গিয়েছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে-পায়ে ধরে আমায় প্রার্থী হতে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু সাংসদ হয়ে আমার বড্ড মুশকিল হয়েছিল। আমি তো চিরকালের বিরোধী লোক, কিন্তু সংসদে আমায় বসতে হল শাসক জোটের পক্ষে। আমি মাঝেমধ্যেই অস্বস্তিতে পড়তাম। ধরুন, কোন একটা বিল আমি সমর্থন করতে পারছি না, কিন্তু আমাকে হাত তুলে সমর্থন দিতে হত। আমি অবসন্ন বোধ করতাম। আমার মনে হত, আমি তো কেবল যাঁরা আমায় ভোট দিয়েছেন, তাঁদের সাংসদ নই। যাঁরা আমায় ভোট দেননি, আমার বিরোধিতা করেছেন, আমি তাঁদেরও সাংসদ। আমি গাছগুলির সাংসদ, আমার সংসদীয় ক্ষেত্রের গরুগুলির সাংসদ, কুকুরদেরও সাংসদ। আমার কর্তব্য হল কোন একটি বিলে সমর্থন বা বিরোধিতার আগে আমার এলাকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের মত নেওয়া। কিন্তু তা কি আমি পেরেছি? পারিনি। সেই সুযোগই পাইনি। একদিন বিভিন্ন দলের সাংসদরা বসে কথা বলছিলাম। আমি জানতে চাইছিলাম, বুঝতে চাইছিলাম, এই দেশটায় কি আদৌ গণতন্ত্র আছে? এক বন্ধু একটু মজা করেই আমায় বললেন, “You are taking India too seriously!” তখন হেসে ফেলেছিলাম, কিন্তু প্রশ্নটা আমার মনে রয়ে গিয়েছিল।

আমি এখন খানিকটা কোবাড গান্ধীপন্থী৷ কোবাড গান্ধী সিপিআই (মাওবাদী) দলের নেতা ছিলেন। তবে এখন সম্ভবত উনি হিংসার পথ থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। সে যাই হোক, কোবাড একবার বলেছিলেন, “আর্থসামাজিক ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রেখে এমন কোন সরকারকে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, যে মানুষকে সম্মান দেবে।” এই কথাটি আমি মর্মে মর্মে সত্য বলে মনে করি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি সমর্থন করি। তিনি প্রচুর ভুল করেন। কিন্তু এমন অসাধারণ কর্মী আমি আগে কখনো দেখিনি৷ মমতা ডেলিভার করতে জানেন। কাজ করতে জানেন। আমি এত দেশ ঘুরেছি, এত মানুষ দেখেছি, কিন্তু মমতার মতো আদ্যন্ত কর্মী আমি আর কাউকে দেখিনি৷ শুনেছি নবীন পট্টনায়কও নাকি এমনই একজন কর্মী। তবে আরো একজনের কথা আমি বলব। তিনি দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। সিপিআইএমএল লিবারেশন দলের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর কথাবার্তায় আমি এক বড় পরিসরের নেতার সন্ধান পাচ্ছি।

এই বছরের প্রজাতন্ত্র দিবস আমাকে নতুন আশার সন্ধান দিচ্ছে। কৃষকদের এই লড়াই কিন্তু কারও অঙ্গুলিহেলনে চলছে না৷ ঠিক যেমন শাহীনবাগের বোনেদের প্রতিরোধ কারো ইশারায় গড়ে ওঠেনি। আমি দেখছিলাম জামা মসজিদের সামনে বিপুল জনসমুদ্র হিল্লোল তুলছে। সংখ্যালঘু যুবকদের হাতে হাতে নেচে উঠছে আম্বেদকরের ছবি। এই তো আমার দেশ! এই হল আমার ভারত! আমি একটি নতুন শক্তির উত্থান দেখতে পাচ্ছি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মূল ভিত্তি এই শক্তি।

আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলির সঙ্গী হিসেবে যে গানগুলিকে পেয়েছিলাম, তার একটি হল আজাদ-হিন্দ ফৌজের মার্চিং সং- “কদম কদম বাঢ়ায়ে যা”। সেই গানের সুর যেমন ছিল আশ্চর্য সুন্দর, তেমনই চমৎকার একটি কথাও পেয়েছিলাম – কৌমি নিশান। আমাদের সবার নিশানের কথা বলা হয়েছিল সেই গানে। আমাদের কৌমের পতাকার কথা বলা হয়েছিল। এই ‘সবাই’ মিলেই তো আমাদের দেশ, আমাদের বাংলা। শিবাজীর ডানহাত ছিলেন একজন মুসলিম। ওয়াহাবি তিতুমীর যখন কৃষক বিদ্রোহ গড়ে তুললেন তাঁর ডান হাত ছিলেন একজন হিন্দু। বাংলাকে রাজভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন হুসেন শাহ। এই দেশে কি আদৌ বিভাজনের রাজনীতি জিততে পারে? কখনো সম্ভব?

অনুলিখন – অর্ক ভাদুড়ি

চিত্র সৌজন্য : ফেসবুক এবং Wikimedia

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.