পশ্চিমবঙ্গে আমার মত ভদ্রলোকেদের কাজ হচ্ছে ভোটের দিন মারামারি খুনোখুনি হলে “কোথায় চলেছি আমরা!”, “এই হিংসার কি কোনো শেষ নেই?”, “এই মৃত্যুগুলোর দায়িত্ব সব দলকে নিতে হবে”, “এতগুলো মায়ের কোল খালি হয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেবে কে?”, “এভাবে ভোট করার কী দরকার?”, “দলহীন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা উচিত”, “আর কোনো রাজ্যে এভাবে ভোট হয় না। দেশের কাছে পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হয়ে গেল” ইত্যাদি বিশুদ্ধ বাংলা বাক্য ব্যবহার করা। শেক্সপিয়র আর শঙ্খ ঘোষ উদ্ধৃত করা। সম্পূর্ণ ভদ্রলোকচালিত বাংলার সংবাদমাধ্যম স্বভাবতই একই কাজ করে। কিন্তু ভোটের ফল বেরিয়ে গেলেই আমাদের বাংলার শব্দভাণ্ডার নেহাত অপর্যাপ্ত বোধ হয়। তখন আমাদের ছেলেবেলার আমীর খানের হিট ছবির শরণ নিতে হয় – জো জিতা উয়ো হি সিকন্দর। এমনটাই চিরকাল দেখে আসছি। তবে এবার ভোটগণনার দিনে যা দেখলাম, তাতে বিনীতভাবে সকলকে অনুরোধ করছি, নিজেদের একটু আপডেট করুন।

আমীর ইতিমধ্যে বুড়িয়ে গেছেন। পুরনো লোকেরা এখনো গল্প শোনান, বাহাত্তরের ভোট কীরকম ভয়ঙ্কর হয়েছিল। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেল সদ্য, এখনো অত পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটলে হবে? বাঙালিদের অতীতচারী জাতি হিসাবে বিস্তর বদনাম। সে বদনাম ঘোচানোর সুযোগ এবারের নির্বাচন পর্ব আমাদের দিয়েছে। এবারের ভোটের ফলকে বর্ণনা করুন বাজিগর ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ দিয়ে “হার কর জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কহতে হ্যাঁয়।” রাজ্যের প্রাক্তন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেখুন চারদিকে বাজিগরের ছড়াছড়ি। বিরোধী দলের প্রার্থীরা জিতেও হেরে যাচ্ছেন, শাসক দলের প্রার্থীরা হেরেও জিতে যাচ্ছেন। টিভি খুলে চ্যানেল ঘুরিয়ে গেলে দেখা যাচ্ছে কোথাও জয়ী প্রার্থী জয়ের শংসাপত্র নিতে গেলে তাঁকে বলা হচ্ছে “আপনি তো হেরে গেছেন”; কোথাও আবার শাসক দলের প্রার্থী হেরে যাচ্ছেন দেখে তাঁর এজেন্ট গণনাকেন্দ্র থেকে ব্যালট তুলে নিয়ে সোজা চম্পট দিচ্ছেন। কোথাও আবার কয়েক ভোটে হেরে যাওয়া প্রার্থী বিপক্ষের ভোট পাওয়া কিছু ব্যালট তুলে নিয়ে কচমচিয়ে খেয়ে ফেলে ফের গণনা করাচ্ছেন। গণনার তত্ত্বাবধানে থাকা আধিকারিকরা সে গণনা হতেও দিচ্ছেন, তারপর জেতা প্রার্থী হেরে যাচ্ছেন, হারা প্রার্থী জিতে যাচ্ছেন। কোথাও আবার বিরোধীদের ভোট পাওয়া ব্যালটের ডানা গজাচ্ছে। তারা জানলা দিয়ে গণনাকেন্দ্রের বাইরে এসে পড়ে এদিকে ওদিকে নালা নর্দমায় ভিড় জমাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো যে একেবারে রুচিহীন এবং তাদের যারা ভোট দেয় তারাও যে রুচিহীন তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ হয় না। উড়ে গিয়ে জুড়ে বসার কি আর জায়গা নেই? নর্দমায় বসতে হবে? এর প্রতিবাদে কোনো শিল্পীর একটা কাক সিরিজ আঁকা উচিত, যেখানে দেখা যাবে কাকেরা ব্যালট খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

খাওয়া বলতে মনে পড়ল। সুকুমার রায় ‘খাই খাই’ বলে অত লম্বা একখানা কবিতা লিখলেন, তাতে নানাবিধ খাওয়ার মধ্যে যুদ্ধে যে গুলি খায় তার কথা পর্যন্ত লিখলেন, ব্যালট খাওয়ার কথাটাই লিখলেন না? তাঁর সময়ে কি ব্যালট খাওয়া চালু ছিল না? সত্যজিৎ রায় ধরণীর বাসিন্দা সুকুমারের পৌত্র সন্দীপের থেকে এ বিষয়ে অবিলম্বে বাইট নেওয়া উচিত কোনো চ্যানেলের। সুকুমার যদি নাও লিখে থাকেন, অবিলম্বে সম্পাদনা করে ব্যাপারটা ঢুকিয়ে দেওয়া উচিত। উন্নয়নের ধাক্কায় ইতিহাস বদলে যেতে পারে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের রাশ রানি রাসমণির হাত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, আর কবিতার কটা লাইন বদলাতে পারে না? আমাদের কবি মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় লিখে দিলেই হয়

খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে –
খাওয়াব ব্যালট খাওয়া, ভোট কয় যাহারে।

এমনি এমনি কি আর কবীর সুমন সুকুমারকে প্রফেট বলেছেন? তিনি লাগসই করে সবই লিখে রেখে গেছেন, এক-আধটা শব্দ এদিক ওদিক করে দিলেই আজকের জন্যে আর নতুন করে কবিতা লিখতে হয় না। এই সুবিধাটা আজকের সদাব্যস্ত কবিরা কেন নেন না বুঝি না। তাঁরা তো সুকুমারের মত নিষ্কর্মা নন, তাঁদের তো অনেক দায়িত্ব। এই কমিটি সেই কমিটির দায়িত্ব সামলানো, নতুন নতুন পুরস্কার তৈরি করা, সিনেমার গান লেখা, সিনেমায় অভিনয় করা, সিনেমা বানানো, সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুকে কোন ঘটনাটা (অবশ্যই ‘অরাজনৈতিক’ ঘটনা) ট্রেন্ডিং তা খেয়াল করে সেই নিয়ে পোস্ট করা, প্রয়াত বিখ্যাতদের কবে কার জন্মদিন আর কে কবে মারা গেলেন সেসব খেয়াল রাখা – এতসব কাজ করে নতুন কবিতা লেখা কি কম ঝক্কির? তার চেয়ে সুকুমারকে ব্যবহার করলেই হয়। না, এতে আমার কোনো স্বার্থ নেই। কবিতা এবং কবিরা আমার খুব পছন্দের, অনেক বাঙালিরই পছন্দের। ছোটবেলায় কবি হতে চায়নি এমন ভদ্রলোক বাঙালি কজনই বা আছে? তাই কবিদের ভার লাঘব করতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করব। সেই উদ্দেশ্যে বললাম আর কি।

আরো পড়ুন পঞ্চায়েত: দুর্নীতি আর তরজায় ব্রাত্য ভোটারের অংশগ্রহণ

এমনিতে আর পাঁচজন ভদ্রলোকের মত আমিও নেহাতই ছাপোষা নিরীহ লোক। আমিও উন্নয়নের পক্ষে। আমার মোটা চশমা দেখে কেউ কেউ ভুল করে মাস্টারমশাই বলে বটে, কিন্তু আমি তো আর সত্যি সত্যি মাস্টারমশাই নই। সুতরাং আমাকে কারোর বলে দিতে হবে না “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি, মাস্টারমশাই।” আমি এমনিতেই চারপাশে যা হয় তার অনেককিছু দেখতে পাই না। চোখের পাতা আছে বন্ধ করার জন্যে, নইলে তো সৃষ্টিকর্তা ও জিনিসটা মানুষকে দিতেনই না। আমি সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে থাকি। তবে কিনা ভোটে রিগিং-টিগিং হলে চোখ বন্ধ করে নেওয়ার অভ্যাস ছিল, গণনার দিনও যে অনেককিছু দেখতে নেই সেটা জানা হয়নি এই ধেড়ে বয়সেও। তাই কিছু কিছু জিনিস চোখে পড়ে গেছে। সে কি আর আমার দোষ? সে হল চোখের দোষ। অন্যের চোখ হলে গেলে দিতাম একেবারে। উন্নয়ন না দেখে কেবল শকুনের মত ভাগাড় দেখা! অমন চোখ থাকার থেকে না থাকা ভাল।

একটাই অসুবিধা। হচ্ছে কী, এত আবর্জনা জমে গিয়ে এত বড় এলাকা জুড়ে গেছে যে উঁচু করে ফেন্সিং দিলেও চোখে পড়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু মনে করবেন না। সবটাই অভ্যাসের ব্যাপার। এও ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে। লেখাপড়া জানা ভদ্রলোক বলে কথা, আমাকে জব্দ করা অত সোজা নয়। অভ্যাস করে উঠতে পারে না গণ্ডগ্রামের অশিক্ষিত লোকগুলো, তাই তারা লড়ালড়ি করতে গিয়ে মরে। বাড়িতে চোর ঢুকলে চেঁচামেচি না করে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকাই যে সঠিক পথ সেটা ওই গোঁয়ারদের বোঝাবে কে? যা নিবি নিয়ে যা বাপু, মারামারিতে কাজ নেই। কারণ যুগ যতই বদলাক, সার কথাটি বদলায় না। সেটি কিন্তু ওই “জো জিতা উয়ো হি সিকন্দর”।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।