আবাস যোজনার দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য রাজনীতি সরগরম। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে এই দুর্নীতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে চলেছে। কেন্দ্রের নিয়ম না মেনে তৃণমূল যে বাড়ি দেওয়ার নামে চূড়ান্ত অনিয়ম করেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজ্যের শাসকদলের রাজকুমার বেশ কয়েকজন পঞ্চায়েত প্রধানকে পদত্যাগ করতে বলে ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। সংসদীয় রাজনীতিতে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল স্বাভাবিকভাবেই এই ইস্যুতে আসরে নেমেছে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার জন্য তাদের বাড়তি সুবিধা রয়েছে। আবাস যোজনায় বাড়ি পাওয়ার যোগ্যতা ইতিমধ্যেই মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কেবল পাকাই নয়, অনেক বিশালাকার বাড়ির মালিকের নামও যে তালিকায় উঠেছে, তাও আড়াল করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা শাসকদলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। অনিয়মের তালিকায় কয়েকজন বিজেপি নেতার নামও যুক্ত হয়েছে। তালিকায় নাম থাকা অনেকের যুক্তি, আবেদনের সময় নাকি তাঁদের কাঁচা বাড়ি ছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তাঁরা কেবল পাকা নয়, বিশালাকার বাড়ি কী করে বানালেন, আর্থিক মন্দার যুগে তাঁদের আর্থিক সমৃদ্ধির উৎস কী – সেসব প্রশ্নও উঠে আসতে বাধ্য। এদের অনেকেই আবার পঞ্চায়েতের পদাধিকারী। তাঁদের এই সমৃদ্ধি প্রকারান্তরে পঞ্চায়েতের দুর্নীতির অভিযোগকেই প্রমাণ করছে। বিজেপি পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ, তারাও দলবাজি, দুর্নীতি, এমনকি সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যুক্ত।

ক্ষোভের আঁচে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ অনেকখানি ম্লান হয়ে গেছে। “চুরি করেছে, তাই কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না” – এমন ভাষ্য অনেক সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করছেন। যা বিজেপিকে কিছুটা সুবিধে করে দিচ্ছে। যদিও মিডিয়ায় হম্বিতম্বি, হাস্যকর উক্তি, সরকার বদলে যাওয়ার ডেটলাইনের নাটুকেপনাতেই তাদের আন্দোলন প্রধানত সীমাবদ্ধ। আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজসহ পঞ্চায়েতের কাজে চরম অনিয়ম যেমন সত্য, তেমন কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কমে যাওয়ার অভিযোগও সত্য। ২০২২-২৩ কেন্দ্রীয় বাজেটে একশো দিনের কাজের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে বরাদ্দ ২৫% কমেছে। আইন সংশোধন করে সাধারণ মানুষের অধিকার কমাতেও কেন্দ্র সক্রিয় হয়েছে। তৃণমূলের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অতিকেন্দ্রীকরণের ঝোঁক, রাজ্যগুলির ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়ার অগণতান্ত্রিক নীতিকেও খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। দুঃখের কথা, সংসদীয় রাজনীতিতে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী দল উভয়ই সমদোষে দোষী। এই দুর্ভাগ্য যেমন রাজ্যবাসীর, তেমন সংসদীয় গণতন্ত্রের।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

কেন্দ্র-রাজ্য তরজায় আড়াল হয়ে যাচ্ছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অধিকারের প্রসঙ্গ, সাধারণ মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার, সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে গ্রামবাসীকে যা দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে সবই যেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। তারা গরিব মানুষকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করতে পারে, আবার দুর্নীতিবাজদের শিক্ষাও দিতে পারে। মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়া তো দূরের কথা, মতামত জানানোরও কোনো অধিকার নেই। অথচ পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ঠিক উল্টোটা হওয়ার কথা। সংবিধান, আইনের সঙ্গে বাস্তবের ফারাক শত যোজন।

বামেদের আন্দোলনে সেই দাবি উঠে আসছে। আবাস যোজনাসহ পঞ্চায়েতের নানা দুর্নীতি নিয়ে বামেরা রাস্তায় নেমেছে। সাময়িক জড়তা কাটিয়ে গ্রামের বুথস্তরেও তারা কাজ করছে। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা কর্মীরাও আন্দোলনে নেমেছেন। বামেদের আন্দোলনের স্রোতে খোদ অমিত শাহও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।  পঞ্চায়েত ও ব্লক ডেপুটেশনগুলিতে সাধারণ মানুষের তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। কর্মসূচিগুলিতে বাম কর্মীদের যান্ত্রিক অংশগ্রহণ নয়, লড়াইয়ের মেজাজ দেখা যাচ্ছে। শাসকদল, পুলিশ প্রশাসনের আক্রমণেও তাঁরা পিছপা হচ্ছেন না। বেশ কয়েকটি স্থানে প্রবল বিক্ষোভে গ্রামসভার বৈঠক পর্যন্ত ভেস্তে গেছে। যে গ্রামসভার বৈঠকগুলিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাস্তবে অসম্ভব ছিল, সেগুলিই প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠছে। বামেদের আন্দোলনে গ্রাম সংসদ, গ্রামসভার বৈঠক নিয়ম মেনে করার দাবি তোলা হচ্ছে। যে দাবি আসলে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের দাবি।

দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। সেই সীমাবদ্ধতা, কেবল এই দেশে নয়, বিশ্বের নানা দেশেই প্রমাণিত সত্য। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় এসে কীভাবে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে গুরুত্বহীন, এমনকি বদলেও ফেলা যায় তা আজ ভারতে দেখা যাচ্ছে। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, প্রতিনিধি প্রত্যাহার করার অধিকার (right to recall) ইত্যাদি দাবি নানা দেশের সঙ্গে এই দেশেও উঠছে। দাবিটা অবশ্য নতুন নয়। সদ্য স্বাধীন দেশেই বামেদের একাংশের পক্ষ থেকে সেই দাবি উঠেছিল। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতা সে দাবির যাথার্থ্যই প্রমাণ করেছে। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের স্বীকৃতি। ১৯৯২ সালের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী সেই লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যা পঞ্চায়েতকে তৃতীয় স্তরের সরকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমলাতন্ত্রকে কিছুটা হলেও গৌণ করে সাধারণ মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ গুরুত্ব পেয়েছে। রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল এই সংশোধনীর অনুপ্রেরণা।

রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনও তার অনুসারী। আইন অনুসারে পঞ্চায়েতের কাজে মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম সংসদ, গ্রামসভা, পাড়া বৈঠক, সামাজিক নিরীক্ষা ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তৃণমূলের আমলের সরকারি বইগুলিতেও সেই কথা বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন বিভাগের গ্রাম পঞ্চায়েত পরিকল্পনা: রচনা ও রূপায়ণের নির্দেশিকা-য় বলা হয়, জনসাধারণই পঞ্চায়েতের উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল কর্মকর্তা। নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সরকারি কর্তারা সহযোগিতার ভূমিকা পালন করবেন (পৃ: ১১)। সরকারি পরিভাষায় একে বলা হচ্ছে সহভাগী উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। ২০১৮ সালে রাজ্য সরকার নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। নাম গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য ও পদাধিকারীদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে পাঠোপকরণ, ২০১৮। অর্থাৎ বিগত পঞ্চায়েত ভোটে নির্বাচিতদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যেই এই পুস্তিকা। প্রথম খন্ডে গ্রাম সভা, গ্রাম সংসদ, সামাজিক নিরীক্ষা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। রাজ্যের  পঞ্চায়েত আইন অনুসারে গ্রাম পঞ্চায়েতের একেকটি বুথের সমস্ত ভোটার নিয়ে একেকটি গ্রাম সংসদ গঠিত হয়। বছরে কমপক্ষে দুটি গ্রাম সংসদের সভা করা আবশ্যক। মে মাসে বার্ষিক ও নভেম্বর মাসে ষান্মাসিক সভা। প্রয়োজনে বিশেষ গ্রাম সংসদ সভা করার সুযোগ রয়েছে। এই সভাগুলিতে সেই বুথের সব ভোটারের অংশগ্রহণের অধিকার আছে। গ্রাম সংসদের বার্ষিক সভায় বিগত আর্থিক বছরের বাজেট, বিগত এক বছরের হিসাব, পঞ্চায়েতের কাজের মূল্যায়ন, বিভিন্ন প্রকল্পে যাঁরা সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের তালিকা, চলতি বছরের কাজ ও পরের বছরে কী কী কাজ হবে সেসব আলোচনা করতে হয়।  গ্রাম সংসদের ষান্মাসিক সভায় পরবর্তী আর্থিক বছরের খসড়া পরিকল্পনা, বিগত ছ মাসের হিসাব, বিভিন্ন প্রকল্পে সুফলভোগীদের তালিকা ইত্যাদি পেশ করে গ্রামবাসীদের এগুলি নিয়ে আলোচনার সুযোগ দিতে হয়। কেবল পঞ্চায়েতের মাতব্বররা এখানে তথ্য জানাবেন না, সাধারণ মানুষ মতামত দেবেন। তাঁদের মতামত ও অনুমোদন গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটারদের নিয়ে গ্রামসভা। প্রত্যেক বছরের ডিসেম্বর মাসে গ্রামসভা করা আবশ্যক। একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের সব ভোটার সেই সভায় যোগ দিতে পারবেন। গ্রামসভায় গ্রাম সংসদের সভার আলোচ্য বিষয়গুলি নিয়ে তাঁরা মতামত দিতে পারবেন। এই সভার সিদ্ধান্ত পঞ্চায়েতে পেশ করতে হবে। গ্রামসভায় পরের বছরের পঞ্চায়েতের বাজেট, সার্বিক পরিকল্পনা, অডিট রিপোর্ট, আয়-ব্যয়ের হিসাব, কাজের হিসাব, বিভিন্ন প্রকল্পে কারা সুবিধা পেয়েছেন তাঁদের তালিকা গ্রামবাসীদের সামনে অবশ্যই পেশ করতে হবে। আইন অনুযায়ী গ্রামবাসীরা এগুলি নিয়ে মতামত জানাতে পারবেন এবং তাঁদের মতামত লিখে রাখতে পঞ্চায়েত বাধ্য।

গ্রাম সংসদ ও গ্রামসভার বৈঠকে যাতে সব গ্রামবাসী যোগ দিতে পারেন তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের। গ্রাম পঞ্চায়েতকে অন্তত সাতদিন আগে সভার নোটিস জারি করে, মাইক প্রচার, লিফলেট বিলি, দেওয়াল লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের কাছে সভার খবর জানাতে হবে। সঠিকভাবে প্রচার না করে চুপিসাড়ে সভা করা আইনসম্মত নয়। (পৃ: ২৩-২৫)

গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজের তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য সামাজিক নিরীক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক গ্রামবাসী এই নিরীক্ষায় মতামত জানানোর, পরিকল্পনা করার অধিকারী। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, জাতীয় সামাজিক সহায়তা প্রকল্প, খাদ্যবন্টন (রেশন) প্রকল্পের জন্য সামাজিক নিরীক্ষা হবে। সামাজিক নিরীক্ষার জন্য পাড়া বৈঠক এবং বিশেষ গ্রামসভা করতে হবে। জনশুনানি সভাও হবে। এইসব প্রকল্পের সুফল কারা পেয়েছেন ও ভবিষ্যতে কারা পাবেন সেসব তথ্য জেনে, মতামত দিয়ে পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের আইনি অধিকার প্রত্যেক গ্রামবাসীর রয়েছে। (পৃ:৬৭-৭০)

মনে করার কোনো কারণ নেই, তৃণমূল সরকার এইসব অধিকার দিয়েছে। প্রধানত তারা ক্ষমতায় আসার আগেই গ্রামবাসীরা এই আইনি অধিকারগুলি পেয়েছেন। আইন অনুসারে বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধে পাওয়ার জন্য মানুষকে সরকার বা শাসকদলের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কথা নয়। বরং প্রশাসনেরই সাধারণ মানুষের মতামতের উপর নির্ভর করে চলার কথা। কোনো সরকারি প্রকল্পই প্রশাসন বা শাসকের ভিক্ষার দান নয়। অথচ আইন বইয়ের পাতাতেই থেকে যায়। পঞ্চায়েতের মাথারা এসব আইন বিলক্ষণ জানেন। নিয়ম করে তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হয়। প্রশিক্ষণের নামে মোচ্ছব কম হয় না। মাতব্বররা আইন যেমন বোঝেন, তার থেকেও ভালো বোঝেন আইনের ফাঁকগুলো। খাতায় সব সভা হয়ে যায়, অনেকক্ষেত্রেই মানুষ ঠিকমত জানতেও পারেন না। জানলেও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ বাস্তবে নেই। সেখানেও প্রতিবাদ করা মানেই বঞ্চনার শিকার। তাই শাসকদলের নেতারা বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, তাঁদের সুরে সুর না মেলালে কিচ্ছু মিলবে না। এত বিতর্কের মধ্যেও জনৈকা পঞ্চায়েত প্রধান প্রকাশ্য সভায়, শাসকদল না করলে বাড়ি পাওয়া যাবে না বলে হুমকিও দিয়েছেন। অথচ আইন অনুসারে উল্টোটাই হওয়ার কথা। মানুষের মত নিয়েই মাতব্বরদের চলার কথা।

সেই কাজ করলে আবাস যোজনা নিয়ে এত ক্ষোভ জন্মাত না, কেন্দ্রও মাতব্বরির সুযোগ পেত না। এখন আবাস যোজনাকে দুর্নীতিমুক্ত করার নাম করে মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ আরও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক, পুলিস, কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা সমীক্ষা করছেন। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের জোর করে এই কাজে যুক্ত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাঁরা অনেকক্ষেত্রেই মানুষের ক্ষোভের শিকার হচ্ছেন। ক্ষোভ প্রশমনে আসরে হাজির সরকারি কর্তা আর পুলিস। সামাজিক নিরীক্ষা, পাড়া বৈঠক, ‘সহভাগী উন্নয়ন’ – এসবই দুই সরকার অস্বীকার করছে। যারা অনিয়মের জন্য দায়ী তাদের শাস্তি হচ্ছে না। উল্টে সেই সুযোগে মানুষের আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

একশো দিনের কাজেও একই চিত্র। এক বছরেরও বেশি সময় রাজ্যে কাজ বন্ধ। অনেকেরই মজুরি বকেয়া রয়েছে। চলছে কেন্দ্র-রাজ্য তরজা। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন অনুসারে নাম নথিভুক্ত করার জন্য আবেদন করলে পরিবারগুলি জব কার্ড পাবে। প্রত্যেক পরিবার একটি জব কার্ড পেলেও সেই পরিবারের যেসব সদস্যের নাম কার্ডে থাকবে তাদের সকলের কাজ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। জব কার্ড পিছু বছরে একশো দিনের কাজ দিতে প্রশাসন বাধ্য। নির্দিষ্ট ফর্মে বছরের যে কোনো সময়ে কাজের জন্য দাবি করা যায়। কাজের জন্য অনেকে মিলে যৌথভাবেও দাবি জানানো যায়। আবেদনের ১৫ দিনের মধ্যে কাজ দিতে হবে। ১৫ দিনের মধ্যে কাজ না দিতে পারলে আবেদনকারীর বেকার ভাতা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বেকার ভাতার জন্য ব্লকের প্রোগ্রাম অফিসার হিসাবে বিডিওর কাছে অথবা গ্রাম পঞ্চায়েতে আবেদন জানানো যায়। সেই পঞ্চায়েতে কাজ না থাকলে ব্লকের মধ্যে কাজ দিতে হবে। কাজের জায়গায় বিশুদ্ধ পানীয় জল, প্রয়োজন হলে প্রাথমিক চিকিৎসা, মহিলা শ্রমিকের ক্ষেত্রে ছয় বছরের কম বয়সী সন্তানদের রাখার জন্য ক্রেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সামাজিক নিরীক্ষার জন্য পাড়া বৈঠকের পাশাপাশি গ্রাম সংসদ ও গ্রামসভাতেও গ্রামবাসীর সামনে এই প্রকল্পের প্রতিবেদন পেশ করতে পঞ্চায়েত বাধ্য। পরিকল্পনা রূপায়ণে সাধারণ মানুষ অংশ নিতে পারবেন। কোন কাজ হবে, কীভাবে কাজের বন্টন হবে সে নিয়ে মতামত জানানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক কাজ বেছে নেওয়ার অধিকারও তাঁদের রয়েছে। গ্রামবাসীদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা নথিবদ্ধ করতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত করে তার নিষ্পত্তি করতে পঞ্চায়েত ও ব্লক বাধ্য।

বাস্তবে জব কার্ড পেতেই মাতব্বরদের উপর নির্ভর করতে হয়। বাবা, ছেলের নামে পঞ্চায়েতে আলাদা আলাদা কর দিতে হয়। কিন্তু জব কার্ডের বেলায় একই পরিবার দেখিয়ে একটাই কার্ড মেলে। এমন নজির প্রচুর। আবেদনের পর কাজ তো পরের কথা, আবেদনও করা যায় মাতব্বরদের মর্জিমাফিক। বেকার ভাতার কথা অধিকাংশ মানুষই জানেন না। নিজেদের মত জানানো বা অভিযোগের প্রশ্নই নেই। তার চেয়ে কাজ না করে কয়েকদিনের মজুরি পেলেই অনেক। ব্যাঙ্কে মজুরির টাকা আসার পর একটা অংশ মাতব্বরদের দিতেই হয়। এভাবেই কাজের অধিকার সংক্রান্ত আইন অনিয়ম ও দলবাজির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আইন অনুসারে কেন্দ্র-রাজ্য কোনো সরকারই এভাবে কাজ বন্ধ রাখতে পারে না। সরকার বা পঞ্চায়েতের মাতব্বররা অনিয়ম করলে জব কার্ডধারীরা বঞ্চিত হবেন কেন?

স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে গ্রামীণ সম্পদ সৃষ্টির অঙ্গীকারও আজ অবহেলিত। এর মাধ্যমে, গ্রামের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলিকে সাহায্য করা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পণা গ্রহণের বিপুল সম্ভাবনা ছিল। তার মধ্য দিয়ে গ্রামবাসীদের রুজির জন্য ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়া কিছুটা হলেও আটকানো যেত। এক্ষেত্রেও মানুষের অংশগ্রহণের পরিবর্তে সরকার ও শাসকদলের মাতব্বরিই প্রধান বাধা। অধিকাংশ গোষ্ঠীই ঋণ লেনদেনের কাজেই যুক্ত, উৎপাদনমূলক কাজে অংশ নিচ্ছে না। সঙ্ঘ ও মহাসঙ্ঘগুলিও শাসকদল নিয়ন্ত্রিত। সরকারি এমনকি দলীয় সভায় গোষ্ঠী সদস্যাদের উপস্থিত থাকা একপ্রকার বাধ্যতামূলক।

পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, অনিয়ম ও মাতব্বরির সুযোগ নিয়েই তার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ‘সহভাগী উন্নয়ন’-এ সাধারণ মানুষ কর্মকর্তা নন। মাতব্বররাই বাস্তবে সব করছেন। সাধারণ মানুষ বাস্তবে কেবল অনুগ্রহপ্রার্থী। তাই যখন দুর্নীতি, অনিয়ম রুখতে সরকারি কর্তাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখন মানুষ বিশেষ আপত্তি করেন না। শাসকদলের রাজকুমার (যিনি রাজ্য প্রশাসনে যুক্তই নন) পঞ্চায়েত প্রধানকে পদত্যাগের আদেশ দিলে প্রশ্ন তোলেন না, বরং অনেকেই খুশি হন। চোখের সামনে দেখা দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতাবানের শাস্তি অনেক বেশি উপভোগ্য। পঞ্চায়েতে যদি সত্যি মানুষের অংশগ্রহণের, কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ থাকত, তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধি এমনভাবে পদ ছাড়তে বাধ্য হতেন না। মানুষের বদলে সরকারি ও শাসকদলের কর্তারাও মাতব্বরির সুযোগ পেতেন না।

আরো পড়ুন একশো দিনের কাজ: কেন্দ্রের বঞ্চনা, রাজ্যের দুর্নীতির যুগলবন্দী

বামফ্রন্টের আমলে সব কিছু মোটেই ঠিকমত চলতো না। দলের মাতব্বরি পঞ্চায়েতের উদ্দেশ্যকে অনেকখানিই ব্যর্থ করেছে। যা হতে পারত গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত, যা গড়ে তুলতে পারত বামেদের পাকাপোক্ত জনভিত্তি, তাই বাস্তবে মানুষের ক্ষোভের অন্যতম কারণ হয়েছিল। বর্তমানে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় শাসকদলই মতাদর্শগতভাবে গণতন্ত্রের বিস্তার চায় না। সুশাসনের নামে গণতন্ত্রের পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত করে আমলাতন্ত্র ও কর্পোরেটতন্ত্রের ভিত মজবুত করাই তাদের মতাদর্শ। এই মতাদর্শ নয়া উদারনীতির। তাই পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য তরজায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বা ‘সহভাগী উন্নয়ন’ স্থান পায় না।

সেই কাজটা বামেদেরই করতে হবে। দুই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যে আইনি অধিকার মানুষকে দিয়েছে তা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলাও আজ বড় কাজ। সেই কাজ তৃণমূল স্তরে এক সচেতন রাজনৈতিক সমাজ গড়তে পারে। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে সমষ্টিগত সচেতনতার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে। পঞ্চায়েতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে সেই স্তরে উন্নীত করার মধ্যেই রয়েছে বামেদের আগামীদিনে জনভিত্তি পুনর্গঠনের চাবিকাঠি।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.