গণআন্দোলন দমনে পুলিশি দমনপীড়ন নতুন কিছু নয়। প্রতিটি দেশেই শাসক পুলিসকে দমনপীড়নের হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করে। আমাদের দেশ, রাজ্য কোথাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। অতীতে নকশাল দমনে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের পুলিশের ভূমিকা, রুনু গুহনিয়োগীর বীভৎস অত্যাচার, অর্চনা গুহর উপর নির্যাতন, তারও আগে তেভাগা কৃষক আন্দোলনে ইলা মিত্রের উপর পুলিশি নির্যাতন ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। হাল আমলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিসের বর্বর ভূমিকা হামেশাই দেখা যাচ্ছে। দিল্লীর শাহীনবাগে, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিসি অভিযান, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, আসাম বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশের অত্যাচার দেখে আঁতকে উঠেছি। বছরখানেক আগে আসামে নিরীহ ভূমিহীনদের উপর পুলিসের গুলি এবং লাশের বুকের উপর দাপিয়ে সাংবাদিকের পৈশাচিক উল্লাস দেখে হতবাক হয়েছি। ভেবেছিলাম মানবাধিকার কোথায়?

আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, আমরা নিজেদের এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছি, আমাদের রাজ্যে এমন হয় না। সত্যিই কি তাই? স্মৃতি দুর্বল বলেই হয়ত মনে পড়ে না। আবার বর্তমান সরকারের আমলে গণআন্দোলনে পুলিসি আক্রমণের তাজা উদাহরণ তুলে ধরলে অনেকেই বাম আমলে মাধাই হালদারের মৃত্যু, এসইউসিআই, নকশালপন্থী ছাত্রনেতাদের হাসপাতালের বেডে হাতকড়া পরিয়ে রাখা, রাজাবাজার সাইন্স কলেজের অধ্যাপকের পুলিসি হেফাজতে মৃত্যু, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালনা প্রভৃতি ঘটনা তুলে আনেন। ওই ঘটনাগুলো তুলে আনা অপ্রাসঙ্গিক নয়। প্রশ্ন অন্য জায়গায়। পশ্চিমবঙ্গের সচেতন নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ বাম আমলে গণআন্দোলনে পুলিসি জুলুমের বিরুদ্ধে যাঁরা সোচ্চার হতেন, তাঁরা আজ হঠাৎ নির্বাক হয়ে গেলেন কেন? বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনই বা কোথায় হারিয়ে গেল? এই হিরণ্ময় নীরবতার কারণ কী?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তৃণমূল সরকারের আমলে পুলিসের দলদাস ভূমিকা নতুন নয়, বরং বিগত সরকারের আমলের চেয়ে পুলিস বর্তমানে সরকারি দলের হয়ে আরও বেশি একপেশে কাজ করছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জেলাগুলোতে থানার পুলিস সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এক পা চলতে পারে না। এগারো বছর ধরে বাংলার রাজপথে পুলিস গণআন্দোলনের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ করে চলেছে। পুলিসের হাতে থাকার সময়ে বাম ছাত্রনেতা সুদীপ্ত গুপ্তের মৃত্যু হয়, বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেত্রী মধুজা সেনরায় সহ আটজন ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আটক মহিলা নেত্রীদের প্রয়োজনীয় স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আমরা দেখেছি, নবান্ন অভিযানে ধর্মতলায় সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণকে পুলিশ কীভাবে লাঠিপেটা করেছে। তৃণমূল আমলে প্রতিদিন পুলিস সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের উপর আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়েছে। পুলিসের মারে মইদুল ইসলাম মিদ্যা মারা গেছে। মীনাক্ষী মুখার্জি, দীপ্সিতা ধর সমেত একাধিক ছাত্রনেতাকে নবান্ন অভিযানে রাস্তায় ফেলে লাঠিপেটা করা হয়েছে।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খানের বাড়িতে ঢুকে পুলিস তাকে খুন করেছে বলে অভিযোগ। আনিস হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনরত মীনাক্ষীসহ সুজন ভট্টাচার্যদের পুলিস যেভাবে নিগ্রহ করেছে তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। পুলিস যাদের আটক করেছিল, তাদের বিবস্ত্র করে শুধু অন্তর্বাস পরিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছিল – এমনটাই অভিযোগ। আমরা ভিডিওতে দেখেছি মীনাক্ষী খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোর্টে হাজিরা দিতে গেছেন। জেলার সর্বোচ্চ পুলিস আধিকারিকের অফিসে তাঁকে যেভাবে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাতে যে কোনো সভ্য মানুষের লজ্জা পাওয়ার কথা। এমন অজস্র উদাহরণ তুলে আনা যায়।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে দুর্নীতি নিয়ে সারা রাজ্য উত্তাল হয়েছে। অধিকাংশ জায়গায় এই প্রকল্পের প্রকৃত লক্ষ্য যারা, সেই গরীব গৃহহীন প্রান্তিক মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। বদলে জায়গা পেয়েছেন শাসক দলের প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্য, নেতা নেত্রী এবং তাঁদের সম্পন্ন আত্মীয়স্বজন অনুগামীরা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি নেতাদের নামও উঠে আসছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বামপন্থীদের নেতৃত্বে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। গত ২৯ ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার ব্লকে সিপিএমের আন্দোলন কর্মসূচি ছিল। সেখানে আন্দোলনকারীদের পুলিস বেধড়ক লাঠিপেটা করে। সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে এক মাঝবয়সী মহিলাকে পুলিস লাঠিপেটা করছে, প্রকাশ্যে মহিলার শাড়ি টেনে খুলে নিচ্ছে। জানা গেছে ওই আন্দোলনকারীর নাম আরজুনা বিবি, বাড়ি নন্দকুমার ব্লকের শীতলপুর গ্রামের গিরিরচক গ্রামে।

অত্যন্ত গরীব ওই মহিলার ঘর বলতে নোনা ইটে কাদার গাঁথনি দেওয়ালে ত্রিপলের ছাউনি। তাঁর নামও আবাস যোজনায় ঠাঁই পায়নি। ঘরের দাবিতে মিছিলে গিয়েছিলেন, বিনিময়ে জুটেছে পুলিসের লাঞ্ছনা।

একজন মহিলাকে এভাবে পুলিস মারতে পারে? আরেকটা ভিডিওতে দেখা গেছে সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিকে পুলিস পার্টি অফিস থেকে অপরাধীর মত টানতে টানতে ভ্যানে তুলছে। একটা রাজনৈতিক দলের নেতা হওয়ার সাথে সাথে নিরঞ্জন সিহি পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি, তাতেও পুলিশ বিন্দুমাত্র রেয়াত করেনি।

আরো পড়ুন সিবিআই হেফাজতে লালনের মৃত্যু: সেটিংই বড় কথা নয়

নন্দকুমারের গণআন্দোলনে পুলিসি নির্যাতন নিয়ে একটা রাজনৈতিক দলের মুখপত্র ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো প্রিন্ট মিডিয়া খবর প্রকাশ করেনি, কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও চোখে পড়ল না। নাগরিক সমাজও সম্পূর্ণ নির্বাক। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, মানবাধিকার সংগঠন – কারোর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। শাসকের ভয়ে নাকি মজ্জাগত আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে আমরা প্রতিবাদ করতে ভুলে গেলাম কে জানে! এর ফলে আন্দোলন করতে গিয়ে আরজুনা বিবিরা বারবার আক্রান্ত হবেন। তারপরে একদিন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিজের মত করে আঘাত ফিরিয়ে দেবেন। সে আঘাত গণতন্ত্রের পক্ষে হবে ভয়াবহ। আমাদের প্রতিবাদহীন হিরণ্ময় নীরবতা বাংলাকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.