সিবিআই হেফাজতে লালন শেখের মৃত্যু ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার চিরাচরিত স্বৈরাচারী চরিত্রকে আরও একবার আলোচনায় নিয়ে এল। অবশ্য সত্যি কথা বলতে গেলে, নিয়ে এল কিনা আমরা জানি না, বলা দরকার – নিয়ে আসা উচিত ছিল। অপরাধী অপরাধ করেছে কিনা তা প্রমাণিত হয় আদালতে। যতক্ষণ সে অপরাধ প্রমাণিত না হচ্ছে ততক্ষণ আইন এবং সমাজের চোখে তার নির্দোষ হিসাবেই প্রতিপন্ন হওয়া উচিত। কিন্তু ভারতীয় ব্যবস্থা শুরু থেকেই উল্টো। পণ্ডিতরা তর্ক করতে পারেন, যে এটি তার ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার কিনা। কিন্তু এর কারণ যাই হোক না কেন, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের কণ্ঠ যে সোচ্চার হওয়া উচিত তা নিয়ে কারোরই সন্দেহ থাকা উচিত ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্র উল্টো পথে চলতে পারে তখনই যখন বৃহত্তর সমাজ তাকে সে পথে চলার অনুমতি দেয়। লালন শেখের ঘটনাতেও সেই একই ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘটনার পিছনে তৃণমূল এবং বিজেপির সেটিং কতটা কাজ করেছে অথবা করেনি এইসব নিম্ন-রাজনৈতিক তর্কসমূহ।
বগটুই গণহত্যা তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল তা নিঃসন্দেহে সত্য। বস্তুত, এটি বর্তমান পশ্চিমবাংলায় দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় বলে, দুর্নীতি উপর থেকে আসে (Corruption comes from above)। রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ লোকেরা যেখানে খোলাখুলি দুর্নীতিতে যুক্ত সেখানে পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে যে দুর্নীতির রমরমা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন দুর্নীতিরও রকমফের আছে। সুশৃঙ্খল দুর্নীতি নাকি বিশৃঙ্খল দুর্নীতি, দীর্ঘমেয়াদি দুর্নীতি নাকি স্বল্পমেয়াদি ধুমধাড়াক্কা দুর্নীতি ইত্যাদি প্রভৃতি। তৃণমূল পার্টির নিজস্ব চরিত্রের কারণেই তাদের দুর্নীতিও বেধড়ক, বিশৃঙ্খল। সবাই যেন সবকিছু আজকেই লুটেপুটে নেবে এমন ভাব। ফলে শুরু হয়েছে প্রবল দলাদলি। লুটেরা সবাই, তৃণমূল সবাই। সবার হাতেই তৃণমূলের ঝান্ডা, সবার মুখেই মা-মাটি-মানুষ স্লোগান। সুতরাং খুনখারাপি বেলাগাম। যে মারছে সেও তৃণমূল, যে মরছে সেও তৃণমূল। এমন অবস্থা। বগটুই কাণ্ড এরই উদাহরণ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তৃণমূল দলের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত সমস্ত স্তরের নেতাদের এই দুর্নীতির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। ফলে দুর্নীতির দায়ে একজন ধরা পড়লে অন্যজনেরও কীর্তিকাহিনী ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। সুতরাং খুনোখুনির ধারাবাহিকতা শুধুমাত্র পুলিশ হেফাজতের বাইরেই নয়, ভিতরেও চলার সমূহ আশঙ্কা। রাজনীতি যেখানে কোটি কোটি টাকা লুঠের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে, তার সঙ্গে যুক্ত হয় সেই লুঠের মাল ছিনিয়ে নেবার জন্য পক্ষ-বিপক্ষ সমাগম, তখন গোটা ব্যাপারটাই চোরাগোপ্তা অন্ধকারের প্যাঁচপয়জার হয়ে দাঁড়ায়। কে কখন কার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে আর কার বিরুদ্ধে যাচ্ছে তার হিসাব রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। খেলা কোথায় কখন ঘুরে যাচ্ছে কেউ জানে না। কে কখন ফুলে ফেঁপে উঠবে, আর কখন ফেঁসে যাবে বা খুন হয়ে যাবে কেউ জানে না। রাজনীতির সাথে অপরাধজগতের মধ্যে কোনো চৈনিক সীমান্ত থাকে না।
তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের রাজনীতির জনক। ফলে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল যে খুনোখুনিতে পর্যবসিত হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। লালন শেখের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন বলে খবর, যে সিবিআই লালন শেখকে নিয়ে যখন বাড়িতে আসে কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক খোঁজার জন্যে, তখন লালন শেখ নাকি স্ত্রীকে বলে “আমাকে শেষবারের মত দেখে নাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।” তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সিবিআই হেফাজতে লালনের রহস্যময় মৃত্যু ঘটে।
এখানে যে বিষয়টি অধিকতর ভয়ানক তা হল এই দলীয় খুনোখুনি শুধু যে বাইরে চলছে এমন নয়, তার বিস্তৃতি ঘটেছে সিবিআই হেফাজতের মধ্যেও। উপরন্তু রাজ্য সরকারের অধীন পুলিসের হেফাজতে লালনের মৃত্যু হয়নি, হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সিবিআই হেফাজতে। রাজনীতির ‘অন্ধকারায়ন’ কতদূর হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা ভেবে দেখার বিষয়। প্রথম থেকেই ভারতীয় স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গাঙ্গী অংশ হল হেফাজতে হত্যা। জিজ্ঞাসাবাদের নামে অত্যাচার এবং তার পরিণতিতে মৃত্যু অথবা পরিকল্পনামাফিক খুন করা আমাদের রাষ্ট্রজীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক কর্মীদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা হামেশাই দেখা যায়। আর অপরাধী সন্দেহে ধৃত ব্যক্তি যদি সাধারণ দুষ্কৃতি বা দুর্নীতিবাজ হয়, তাহলে এই ঘটনার বিরুদ্ধে মুখ খোলার মত লোকের সংখ্যা খুব বেশি হয় না। কখনো কখনো তা সমাজের এক অংশের অনুমোদনও পেয়ে থাকে। আমাদের মনে থাকতে পারে, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে হায়দরাবাদে এক তরুণী ডাক্তারের গণধর্ষন ও হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত চার যুবককে তেলেঙ্গানার সাইবারাবাদ পুলিস হেফাজতে থাকাকালীন রাত্রিবেলায় এক সেতুর নিচে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনা জনতার এক অংশের সমর্থন পেয়েছিল। এমন ঘটনা বহু রয়েছে। আর এইরকম প্রতিটি ঘটনাতে আসলে শক্তিশালী হয় স্বৈরাচার – সেকথা গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখনো অনুধাবন করতে সমর্থ নয়।
আরো পড়ুন পুলিসের কি মানবাধিকার নেই নাকি?
কিন্তু বিরোধী রাজনীতির লোকেদের দায়িত্ব এক বিরোধী রাজনীতি নির্মাণ করা। তাঁরা সাধারণ মানুষের মত আচরণ করতে পারেন না। বরং তাঁদের দায়িত্ব হল জনতার মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক প্রতর্ককে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। অথবা সমস্যা আরও গভীরে। খবরে প্রকাশ, গতবছর সারা দেশে পুলিস হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ২৫৪৪টি। দলমত নির্বিশেষে সব ধরনের রাজ্য সরকারের অধীনেই এ জিনিস ঘটে চলেছে। সর্ভারতীয় তালিকায় সব থেকে উপরে আছে উত্তরপ্রদেশ (৪৫১) আর তারপরেই পশ্চিমবঙ্গ (২৫৭)। কংগ্রেসশাসিত রাজ্যেও এই ঘটনা ঘটছে, বাম শাসনাধীন কেরালাতেও একের পর এক পুলিস হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, বিরোধী দল থাকলেও আসলে কোনো বিরোধী রাজনীতি নেই। কোনো বিরোধী মতাদর্শ নেই। বিরোধী রাজনৈতিক প্রতর্ক নেই। এই অবস্থায় রাজনীতির নামে গোটা সমাজেই যে নিম্নমানের খেয়োখেয়ি আর দোষারোপ চলবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
খবরে প্রকাশ, লালন শেখের মৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিস সাতজন সিবিআই অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ পুলিসের হাতে গত দশদিনে চারজন হেফাজতে ‘খুন’ হয়েছেন। সে ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ পুলিস নীরব। তারা এই ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে দিয়ে নিজেদের দায় সেরে ফেলেছে। পুলিস হেফাজতে মৃত্যুর সর্বভারতীয় পরিসংখ্যানে কেন পশ্চিমবঙ্গের স্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ – তা নিয়েও রাজ্য সরকারের কোনো বক্তব্য নেই। জনতারও মাথাব্যথা নেই। যে যখন নিজে ভুক্তভোগী হয় তখন সে সোচ্চার হয়, কিন্তু সমাজ চুপ করে থাকে। এইভাবেই আমাদের সমাজ চলছে, রাজনীতি চলছে। এমন উর্বর জমিতে যে ফ্যাসিবাদেরই চাষ হবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।