আলতামিরার গুহাবাসীরা কি প্লেনে চড়ে দেশ দেশান্তরে যেতে পারত? না। তারা কি কম্পিউটার ব্যবহার করত? না। তারা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করাতে পারত? তাও নয়। তারা কি একটা বোতাম টিপে কয়েক হাজার মাইল দূরের জনপদ ধ্বংস করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিল? মোটেই না। তারা কি ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষের মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়ার উপায় জানত? একেবারেই না। কিন্তু তারা বাইসন আঁকতে পারত। সে বাইসন দেখতে অর্থ আর সামর্থ থাকলে আজও সারা পৃথিবীর মানুষ ছুটে যায়। মানুষের আর কিছুই থাকে না, শিল্পটুকুই থেকে যায়। যতদিন না আমাদের এই গ্রহটা মহাবিশ্বের অনিবার্যতায় জীবজগৎহীন জড়পিণ্ডে পরিণত হচ্ছে, ততদিন আর সব কিছু বদলে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। থেকে যাবে আমাদের শিল্প।

সেইজন্যেই সাফল্যের চেয়েও শিল্প আমাদের চোখ টানে বেশি, স্মৃতির বেশি জায়গা অধিকার করে। দিয়েগো মারাদোনা তাই অনেকের চেয়ে কম গোল করে, অনেকের চেয়ে কম ট্রফি জিতেও বহু মানুষের হৃদয়সম্রাট হয়ে রয়েছেন। ক্লাবের হয়ে লিওনেল মেসির চেয়ে বেশি খেতাব ভবিষ্যতে জিততেই পারেন কোনো ফুটবলার, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোই তো খুব পিছিয়ে ছিলেন না। মেসির চেয়ে বেশি গোল হয়ত কিলিয়ান এমবাপেও করে ফেলবেন। কিন্তু যেসব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন দেড় দশকের বেশি সময়, কাতারের ফুটবল মাঠে যেসব ছবি এঁকেছেন গত একমাস – সেগুলো দিয়েই স্মৃতির মণিকোঠায় মেসির জায়গা পাকা হয়ে গেছে, মারাদোনার মতই। আর কে না জানে স্মৃতির কোনো লেবেল লাগে না, শিল্পে কোনো GOAT হয় না, কোনো র‍্যাঙ্কিং চলে না। এমন কোনো সঙ্গীতরসিক আছেন কি যিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান শুনতে ভালবাসেন বলে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গান শোনেন না, হিসাব করেন দুজনের মধ্যে কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ? আমাদের স্মৃতি তো নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগামী ভিড়ে গাদাগাদি ট্রেনের কামরা নয়, যেখানে উত্তমকুমারের চকিত চাহনির পাশে জায়গা হবে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীপ্তির। পথের পাঁচালী পড়ে কাঁদলে পুতুলনাচের ইতিকথা-র নির্লিপ্তিতে মুগ্ধ হওয়ার জায়গা থাকবে না – এত সীমিত নয় মানবিক আবেগ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আর যদি শিল্প জয়যুক্ত হয়? কাল তেমন এক রাত ছিল।

বার্সেলোনার জার্সিতে তিনি যত ফুল ফুটিয়েছেন ইউরোপের মাঠে মাঠে, আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সিতে লাতিন আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, রাশিয়ায় – সব সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছিল অপূর্ণতা। রত্নখচিত মুকুটে যে কোহ-ই-নূর না থাকলে আর সবই বৃথা মনে হয়। শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মনে হয় তা নয়, মেসির মুখ দেখলে বোঝা যেত তাঁর নিজেরও মনে হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হারের পর সর্বত্রগামী হয়েছিল মেসির অশ্রুসিক্ত ছবি।

মেসি
যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে — ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর মেসি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

পৃথিবীর মানচিত্রে আর্জেন্টিনার একেবারে অন্য প্রান্তে থাকা ফুটবলে অনুন্নত দেশ ভারতের বাসিন্দা আমরা বিশ্বকাপ দেখি স্রেফ আনন্দের খোঁজে। আমরা প্রাক্তন উপনিবেশ, আমরা তৃতীয় বিশ্ব। স্বভাবতই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন সফল ইউরোপের চেয়ে বেশি ঝুঁকে থাকে শিল্পী লাতিন আমেরিকার দিকে। ভারতে যখন থেকে বিশ্বকাপ লাইভ দেখা যায় তখন থেকেই নিখুঁত জার্মানি, ইতালি বা লড়াকু চেক রিপাবলিক, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের আবেগকে বেশি উস্কে দেয় ক্যামেরুন বা নাইজেরিয়া। আজও কি বেশ কাছের মানুষ মনে হয় না রজার মিল্লাকে? এ দেশে যারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা স্পেনের সমর্থক তাদের মনও তো আসলে কেড়ে নিয়েছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান, ইনিয়েস্তার মত বল প্লেয়াররা – ছবি আঁকার নৈপুণ্যে। মানুষ হিংসুটে, মানুষ দাঙ্গাবাজ, মানুষ অকারণে মানুষকে অপমান করে। আইজ্যাক আসিমভ যথার্থই লক্ষ করেছিলেন, মানুষ একমাত্র জীব যারা অন্য জীবকে খাঁচায় পোরে। তবু তো মানুষ যে আনন্দ দেয় তার আনন্দ কামনা করে। খেলার মাঠে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেন শিল্পী ফুটবলাররা। তাই তাঁদের প্রতি পক্ষপাত থাকবেই। বহু মানুষ তাই চেয়েছিলেন, মেসির হাতে যেন একবার বিশ্বকাপটা ওঠে। য়োহান ক্রয়েফ কখনো বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেননি, জর্জ বেস্টের সে সুযোগই ছিল না। সে দুর্ভাগ্য যেন মেসির না হয়।

হয়নি। কাল সেই উদ্দাম হাওয়ার রাত ছিল। অন্তত গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে ৩৫ বছরের মেসি প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে গোল করলেন, মাঠজুড়ে খেললেন। মাঝমাঠে নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে বল পেলেন মেসি, মেসি থেকে জুলিয়ান আলভারেজ, আলভারেজ থেকে ম্যাক অ্যালিস্টার, ম্যাক অ্যালিস্টার থেকে আংহেল দি মারিয়া – ছবির মত গোল হল। আশি মিনিট একতরফা খেলা হওয়ার পর মেসির এক হাত যখন বিশ্বকাপে, তখন ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটো গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফেরালেন এরপর যিনি বিশ্বের অবিসংবাদী সেরা ফুটবলার হয়ে উঠবেন, সেই এমবাপে।

মেসি
খেলা ভাঙার খেলা — ফ্রান্সের দ্বিতীয় গোল করছেন কিলিয়ান এম্বাপে। ছবি: টুইটার

তারপর অতিরিক্ত সময়ের শেষ প্রান্তে ফের গোল দিয়ে মেসি যখন উচ্ছ্বাসে ভাসছেন, ভাবছেন সোনার পরী এবার তাঁর হাতের মুঠোয়, তখনই সামান্য ভুলে পেনাল্টি। হাওয়া ঘুরে গেল আবার। তারপর যদি বনস্পতির বিরাট ছায়া না দিতেন সোনার দস্তানার অধিকারী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, হয়ত প্যারিসেই উড়ে যেত সোনার পরী।

মেসি
কী মহা সমারোহে — অতিরিক্ত সময়ে অবধারিত গোল বাঁচালেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। ছবি: টুইটার

নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল, এ যুগের সেরা ফুটবল শিল্পীর মুকুটে কোহ-ই-নূর বসিয়ে দেওয়ার ফাইনাল।

আরো পড়ুন এখন চোখের জলেই মাপতে হবে মারাদোনাকে

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই। সেই তিনি, যিনি ২০১০ সালে মেসির দলের কোচ হয়েও এমন অস্থির পদচারণা করতেন সাইডলাইনে যে মনে হত নিজেই নেমে পড়বেন। যিনি গত বিশ্বকাপেও গ্যালারিতে ছেলেমানুষের মত হাসতেন, কাঁদতেন, চিৎকার করতেন আর্জেন্টিনার ম্যাচে। যিনি ভিআইপি, তবু ভিআইপি নন। যাঁর সঙ্গে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ফুটবল খেলতে না জানা একজন সাধারণ আর্জেন্টিনা সমর্থকের কোনো তফাত থাকত না, উদ্বিগ্ন সঙ্গীসাথীরা পিছন থেকে জামা ধরে টেনে রাখতেন – পাছে মানুষটা টাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রায় একা দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর যিনি জীবদ্দশায় আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে পেলেন না, আমূল বদলে যাওয়া ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্ব ফুটবলে ২০ বছর পর লাতিন আমেরিকার বিশ্বজয়ের রাতে সেই আকাশলীন দিয়েগোকে বলতে ইচ্ছে করছিল

ফিরে এসো মারাদোনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার…

মেসি
আমি তোমাদেরই লোক। ছবি: টুইটার

 

 

 

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.