বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই কুরুক্ষেত্র, হিসার, পানিপথ, কার্নাল রণসাজে সেজেছে। হরিয়ানার কনকনে জবুথবু শীতের ভোরে, কুয়াশার চাদর ভেঙে আশা কর্মীরা রওনা দিচ্ছেন আম্বালার পথে। ম্যাটাডোর থেকে জিপ, কেউ কেউ চেপেছেন পাঞ্জাব লরিতে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আম্বালার সকাল ভাল করে শুরু হওয়ার আগেই, সকালের চায়ের দোকানে নাস্তা আর চায়ের সন্ধানে আসা মানুষজনের ভিড় জমার আগেই ঘিরে ফেলতে হবে গোটা আম্বালা শহর। এই আম্বালাতেই থাকেন হরিয়ানার মনোহরলাল খট্টরের বিজেপি সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজ। অনিল ভিজের বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করতে হবে আজকেই — শপথ নিয়েছিলেন গোটা হরিয়ানার আশা কর্মীরা।
কেন্দ্রের মোদী সরকার হোক বা রাজ্যের সরকার, কোনো সরকারই মানতে চান না ‘Accredited Social Heath Activist’ সংক্ষেপে ‘ASHA’ কর্মীরা শ্রমিক। যেমন কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গনওয়াড়ি বা মিড ডে মিলের মত প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিক বলে মানতে চায় না। ইন্ডিয়ান লেবার কংগ্রেসের ৪৫তম ও ৪৬তম সম্মেলন আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিলের মত প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা দিলেও মানতে নারাজ পর পর কেন্দ্র শাসন করে যাওয়া কংগ্রেস ও বিজেপি সরকার।
কংগ্রেস বা বিজেপি তাদের শ্রেণিগত স্বার্থেই প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিক হিসাবে মেনে নেওয়ার বিরোধিতা করে এসেছে। শ্রমিক হিসাবে মানলে ন্যুনতম মজুরি দিতে হবে, পেনশন দিতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। অতএব ওঁরা শুধুই স্বেচ্ছাসেবক। দিন রাত এক করে এঁরা ভেঙে পড়া অথচ জরুরি সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কাঠামো বজায় রাখবেন, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বজায় রাখবেন, হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব নেবেন, পুষ্টির দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু তাঁরা শ্রমিক নন। সামান্য পাঁচ-সাত হাজার টাকার ‘সাম্মানিক’ ভাতাই তাঁদের একমাত্র প্রাপ্য।
অতিমারীর সময়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, ধোঁয়া ধুলো ঘেরা মফস্বলে, ব্যস্ত শহরে মহল্লায় অলিগলিতে করোনা মোকাবিলা করেছেন, করে চলেছেন আশা কর্মীরাই। ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে শতাধিক আশা কর্মীর মৃত্যু হলেও মিডিয়ায় ঢালাও প্রচার হওয়া মোদী সরকারের ৫০ লক্ষ টাকার বিমার এক কণাও পৌঁছয়নি এঁদের পরিবারের কাছে।
হরিয়ানার আশা কর্মীরা গত কয়েক বছর ধরেই রাস্তায় আছেন, সংঘর্ষে আছেন ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে। ২০২১ সালের প্রথমদিকে আন্দোলনের চাপে মনোহরলাল খট্টরের সরকার ভাতা বৃদ্ধির দাবি মেনে নিলেও ভাতা বাড়ায়নি, ‘লিপ সার্ভিস’ ছাড়া সরকারের কোনো কাজ নেই।
চোয়াল চাপা জেদে অনড় আশা কর্মীরা — ভাতা বাড়াতেই হবে। বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, একদিনের ধর্মঘট ডেকেছিলেন আশা কর্মীরা, সিআইটিইউ অনুমোদিত আশা ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, হরিয়ানার নেতৃত্বে। যে সরকার আশা কর্মীদের শ্রমিক বলেই মানতে চায় না, ধর্মঘট আটকাতে সেই সরকারি এসেন্সিয়াল সার্ভিস মেনটেনেন্স অ্যাক্ট, সংক্ষেপে এসমার মত কালা আইন জারি করে ১৫ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায়। রীতিমত সার্কুলার দিয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় — ধর্মঘট করা যাবে না, রাস্তায় নামা যাবে না ইত্যাদি।
সরকারি সার্কুলারের উপর রুটি সবজি ডালমাখানি রেখে খেয়ে হাত মুছে ফেলে দিয়েছেন আশা কর্মীরা। ধর্মঘট হবেই, আম্বালায় অনিল ভিজের বাড়ি, শহর অবরুদ্ধ হবেই।
১৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে শুরু হয় সিআইটিইউ, আশা ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও সংগঠকদের ধরপাকড়, গ্রেপ্তার।
গ্রেপ্তারি এড়িয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই তিরিশ হাজারের বেশি আশা কর্মী কাকভোর থেকে রাস্তায় ছিলেন, গাড়ি ধরে পৌঁছচ্ছিলেন আম্বালার পথে। কুরুক্ষেত্রে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে, গাড়ি থেকে নামিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় সিআইটিইউর রাজ্য সভানেত্রী সুরেখা, আশা কর্মী ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদিকা সুনীতা ও সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা সবিতাকে। সারা রাজ্য জুড়ে শুরু হয় গ্রেপ্তারি, ধরপাকড়।
পুলিশি জুলুমবাজি, গ্রেপ্তারির সামনে অকুতোভয় আশা কর্মীরা বসে যাননি। ভিওয়ানি জেলায় পুলিশের জিপ থামিয়ে জিপের মাথায় লাল ঝান্ডা নিয়ে উঠে পড়েছেন আশা কর্মীরা, একের পর এক জেলায় রাস্তায় রাত পর্যন্ত চলছে পুলিশের সঙ্গে আশা কর্মীদের সরাসরি সংঘর্ষ।
হরিয়ানার একের পর এক জেলায় জেলা সদরের সামনে, জেলা পুলিশের কার্যালয়ের সামনে হাজারে হাজারে জড়ো হয়েছেন আশা কর্মীরা। একটাই দাবি। নেতৃত্ব ও সংগঠকদের এক্ষুনি ছেড়ে দিতে হবে, এসমা প্রত্যাহার করতে হবে। বাধ্য হয়ে সরকার শুক্রবার সকালেই বৈঠকে ডেকেছে আশা কর্মী ইউনিয়নের নেতৃত্বকে।
আশা কর্মীদের মতই অবিশ্রাম আন্দোলনে রয়েছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। একের পর এক জেলায় হাজার হাজার জমায়েত চলছে। শুক্রবার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদেরও বৈঠকে ডাকতে বাধ্য হয়েছে খট্টর সরকার।
হরিয়ানার এই শ্রমিকদের এই অবিরাম সংঘর্ষ ও তার মাধ্যমে দাবি আদায়ের সাফল্যের আড়ালে রয়েছে শ্রেণিসংগ্রামের ঠাসবুনোট ইতিহাস।
মনে রাখতে হবে হরিয়ানা এমন একটি রাজ্য, জেন্ডার ইনডেক্সে যে রাজ্যের ঠাঁই একদম নীচের দিকে। কন্যাভ্রূণ হত্যা, মহিলাদের উপর সংগঠিত অপরাধ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ খাপ পঞ্চায়েত, প্রবল লিঙ্গবৈষ্যমের হরিয়ানায় মহিলা শ্রমিকরা কেবল একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজি ও তাদের নির্বাচিত সরকারের নীতির বিরুদ্ধেই লড়ছেন না, লড়ছেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও।
যে মহিলারা দিনের পর দিন শুধু ঘরে রুটি ডাল রাঁধতে বাধ্য থেকেছেন, ঘোমটায় মুখ ঢেকে রাখতে হয়েছে, পুরুষতন্ত্রের পাঞ্জার বিরুদ্ধে তাঁরাই উঠে দাঁড়াচ্ছেন তাঁদের শ্রেণি পরিচয়ে। মনে রাখতে হবে, মহিলাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত একের পর এক অপরাধ, মহিলাদের সামাজিকভাবে পিছনে ঠেলে রাখা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও তাঁরা ফেটে পড়ছেন গরগরে রাগ নিয়ে। হরিয়ানার মত রাজ্যে সিআইটিইউর রাজ্য সভানেত্রীর দায়িত্বে কোনো পুরুষ নয়, সুরেখার মত একজন একরোখা কমবয়সী মেয়ে।
কার্নাল থেকে ভিওয়ানি, কুরুক্ষেত্র থেকে হিসার — একের পর এক জেলায় প্রকল্প কর্মীদের সমাবেশের চেহারা, পুলিশের ব্যাটন কেড়ে নিয়ে পাল্টা প্রত্যাঘাতের সাহস দেখে মনে রাখতে হবে হরিয়ানার মত রাজ্যে, নির্বাচনে যেখানে বামপন্থীদের উপস্থিতি থাকে না বললেই চলে, সেখানে কয়েক হাজার মানুষের সমাবেশ কোনো গতানুগতিক আন্দোলনের ছকে করা সম্ভব হয়নি। হরিয়ানায় শুধু কংগ্রেস-বিজেপি দ্বৈরথে আবদ্ধ না থেকে, বিজেপি বা কংগ্রেসকে অক্ষমের বিদ্রুপে বিদ্ধ না করে, সোশাল মিডিয়ায় রসিকতা, কার্টুন মিম না বানিয়ে বামপন্থীরা সরাসরি সংঘর্ষে নেমেছেন, শ্রেণি হিসাবে শাসকের রাজনীতির মোকাবিলা করছেন।
এই সমাবেশ আক্ষরিক অর্থে সমাবেশগুলি শ্রেণি সমাবেশ। শ্রেণি পরিচয়েই মানুষ রাস্তায় নামছেন, জাত-ধর্ম-ভাষার পরিচিতি সত্তার বিভাজনের বিপরীতে রুখে দাঁড়াচ্ছেন তাঁদের শ্রেণি সত্তা নিয়ে। হরিয়ানার জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়া মহিলা প্রকল্প কর্মীদের আন্দোলন থেকে অন্য রাজ্যের শ্রমিক কর্মচারীরাও শিখতে পারেন।
রাজ্যে রাজ্যে এ পথে অগ্রসর হওয়াই বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। শর্ট কাট, নির্বাচনী সমঝোতায় আটকে না থেকে শ্রেণিসংগ্রামই বামপন্থীদের পথ।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।