“ব্রহ্মা, বিষ্ণু আগেই গেছেন, এবার মহেশ্বর চলে গেলেন।” তুলসীদাস বলরামের প্রয়াণের খবরে এমন শিরোনাম হওয়ারই কথা। হ্যাঁ, ভারতীয় ফুটবলে মহেশ্বর যদি কেউ হন, তিনি বলরামই। আনখশির লোকায়ত এমন এক চরিত্রেরই এই আখ্যা পাওয়ার যোগ্যতা থাকে, যাঁকে রত্নবেদী বা সিংহাসনে নয়, আসা-যাওয়ার পথে গাছতলার থানে আবালবৃদ্ধবণিতা প্রণাম করে যাবে। তুলসীদাস বলরাম ভারতের ক্রীড়া-ইতিহাসের মহত্তম চরিত্রদের একজন।
নির্মাণ, নির্মাণ আর নির্মাণ। নিজের ইহকাল নির্মাণ, পরকালও। সেইসঙ্গে প্রিয়জন ও নেকনজরে থাকা মানুষের সুরক্ষা নির্মাণ, নিজের ভাবমূর্তি নির্মাণ। কূটকৌশল ও বাকপটুতাও তো একান্ত প্রয়োজনীয়! বলরামের কিন্তু এসব কিছুরই দরকার পড়েনি। প্রায় চার দশক আগে একদিন, অফিসগামী আমাদের মিনিবাসে উঠেছিলেন তিনি, চৌরঙ্গী অঞ্চল থেকে। মনে আছে, শ্রদ্ধায় উত্তেজনায় আমরা সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ওঁর কিন্তু কোনো হেলদোল নেই। একেবারে যেন নিপাট সাধারণ একটি লোক, এককোণে একটি সিটে চুপটি করে বসে রইলেন। এই ‘অনাভিজাত্য’ আপনা আপনি সমীহ আদায় করে নেয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ব্রহ্মা, বিষ্ণুর কথাতেও আসতে হয়। সেই কবে পড়েছিলাম এক মস্ত জমজমাট পরিবারের কথা। বাড়ির তেজি দাদাবাবু যেন পিকে ব্যানার্জি; ফুটফুটে যে শিশুটি বাড়ির সকলের নয়নের মণি, মাতিয়ে রাখে সারা বাড়ি — সে যেন চুণী গোস্বামী; আর সেই বিরাট পরিবারটিকে ঘড়ি ধরে ভোর থেকে রাত্রি পর্যন্ত নিখুঁতভাবে চালিয়ে নিয়ে যায় বহুদিনের বিশ্বস্ত বিচক্ষণ এক ভৃত্য, যার একটি কথাও অমান্য করতে পারেন না কর্তা থেকে গিন্নি, রীতিমত সমীহ করে চলেন তাকে, যে একদিন না থাকলে বা অসুস্থ হলে সংসার অচল, চোখে অন্ধকার দেখে সকলে, সেই সেবকই যেন বলরাম।
বলরাম ঘরে-বাইরে পেয়েছেন সর্বাঙ্গীণ সফলতা। কি অলিম্পিক, কি এশিয়ান গেমস, কি কোয়াড্র্যাঙ্গুলার। ইউরোপের ক্লাব তাঁকে যাবতীয় আরাম ও সুবিধা দিয়ে সেখানে থেকে যাওয়ার অফার দিয়েছে— কান দেননি। বিদেশি মেয়েরা তাঁর খেলায় পাগলপারা হয়ে তাঁকে জীবনসঙ্গী করতে চেয়েছে — ফিরেও তাকাননি। সন্ন্যাসী, না কর্মযোগী? আন্তর্জাতিক উচ্চতার এক শিল্পী জীবনের সব চাকচিক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে নির্জন এককের সাধনায় ব্রতী থাকলেন। বড় কঠিন সে কাজ, বড় দুরূহ সেই পথ।

রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছিলেন, সিদ্ধিই চরম কথা নয়, সাধনাও পরম কথা। কী পেলাম, তার চাইতে কিছুমাত্র কম নয় সারাজীবন ধরে যাবতীয় প্রলোভন উপেক্ষা করে নিজের পথ চললাম। সে-ও এক মস্ত পাওয়া। এই লোভহীনতার সুরে নিজের জীবনকে বেঁধে নেওয়া, নিজেকে বিক্রি হতে না দেওয়ার স্থৈর্য, বাজারকে অগ্রাহ্য করা — বলরাম এই সমুদয় অ্যাজেন্ডার এক মহান শিক্ষক। তাঁর মুখের পিছন থেকে উঁকি মারে সেইসব বিপ্লবীদের জীবন, যাঁরা সব প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে পথ চলেছেন দেশকে স্বাধীন করতে, সমাজকে বদলে দিতে। কোনোকিছুর প্রত্যাশা করেননি, জুটেছে অপরিসীম নির্যাতন, সুদীর্ঘ কারাবাস। সেসবই সহ্য করেছেন। দারিদ্র্যে উপোস করেছেন, তবু আপোস করেননি। এমনকী স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশনটুকুও প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁদের অনেকে।
আরো পড়ুন নীরব প্রতিবাদী বলরাম
উত্তরপাড়া এই মহানগরীরই প্রত্যঙ্গ বলা চলে। সেখানেই কাটিয়ে দিলেন, জীবনের শেষ দিনগুলোতে কিন্তু মহানগরীর থাবা বলরামকে ছুঁতে পারল না। ঠিক জনকোলাহল বা হলাহলের আওতার বাইরে থেকে গেলেন। স্মৃতিতে ঘা দিচ্ছে, সুদূর হৃষীকেশে এক হিম-রাতে জমাট নির্জনতায় বাংলার অগ্নিকন্যা বীণা দাস (ভৌমিক)-এর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।