দেবাশীষ সেনগুপ্ত

তুলসীদাস বলরাম কি আমাদের আদৌ ক্ষমা করবেন?

গঙ্গাপাড়ের ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসে থাকা কিংবদন্তি এ সপ্তাহে ৮৫ বছরে পা দিলেন। কলকাতা ময়দানকে তিনি দিয়েছেন অনেক। বদলে আমরা কী দিয়েছি? কাঁটা, পাথরকুচি, অপমান।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

একই ব্যবহার ১৯৭৯ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কাছে পেয়েছিলেন কলকাতা মাঠের সর্বকালের অন্যতম সেরা এক হাফব্যাকদের মধ্যে একজনও। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে ১৯৭০-১৯৭৫ আর ১৯৭৭-৭৮ মরসুমে যাঁর অবদান আজও সোনার অক্ষরে লেখা আছে চিরদিনের জন্য। ইস্টবেঙ্গল কর্তারা ১৯৭৯ সালের দলবদলের আগে কথাবার্তার সময় তাঁকে ঝুলিয়ে রেখে প্রায় শেষ মুহূর্তে দলে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। শেষ মুহূর্তে মহমেডান স্পোর্টিংয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই হাফব্যাক — সমরেশ চৌধুরী।

ষাটের দশকের কলকাতা ময়দানে সমরেশ চৌধুরীর পূর্বসুরী ছিলেন তুলসীদাস বলরাম।

সেকেন্দ্রাবাদে ১৯৩৬ সালের ৪ অক্টোবর জন্মানো বলরাম ১৯৫৫, ১৯৫৬ সালে খেলেছিলেন হায়দাবাদ সিটি কলেজ ওল্ড বয়েজ দলের হয়ে। সেখান থেকে ১৯৫৭ সালে নাম লেখান ইস্টবেঙ্গলে। বৈচিত্র‍্য আর বহুমুখিতার অন্য নাম বলরাম চার বছর খেলার পর ১৯৬১ সালে ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক হন। সেবারই কলকাতা লিগে মোহনবাগানের জার্নেল সিংকে টলিয়ে দিয়ে প্রায় শূন্য ডিগ্রি কোণ থেকে একটি অনবদ্য গোল সমেত মোট ২৩টি গোল করে গোল্ডেন বুট জিতে নেওয়া ছাড়াও ভেটারেন্স ক্লাবের দেওয়া বর্ষসেরা ফুটবলারও নির্বাচিত হয়েছিলেন বলরাম। ১৯৫৯ সালে মোট ৩৯ গোল দেবার সুবাদে দেশের সেরা স্কোরার হয়েছিলেন সুযোগসন্ধানী বলরাম। আর সারা জীবনে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ১০৪টি গোল দিয়েছিলেন। রেকর্ড বলে, ১৯৬২ সালেও ওই ক্লাবের হয়েই খেলেছিলেন তিনি। আচমকা নেওয়া বাঁক খাওয়া শট, ইম্প্রোভাইজেশন আর অসামান্য ইনসাইড কাটের জন্যই তিনি ভারতের আর বাংলার ফুটবলের ইতিহাসে থেকে গেছেন।থেকে গেছেন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে অসংখ্য গৌরবময় মুহূর্তর কারিগর হয়েও। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে তিনি জিতেছিলেন ১৯৫৭ ডিসিএম ট্রফি, ১৯৫৮ আই এফ এ শিল্ড, ১৯৬০ ডুরান্ড কাপ (মোহনবাগানের সঙ্গে যুগ্ম জয়ী) আর ডিসিএম ট্রফি, ১৯৬১ কলকাতা লিগ ও আই এফ এ শিল্ড এবং ১৯৬২ রোভার্স কাপ (অন্ধ্র পুলিসের সঙ্গে যুগ্ম জয়ী)। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের উপর ক্ষোভের কারণে ১৯৬৩ সালে তিনি চলে যান বি এন আরে এবং ওই বছরই কলকাতা লিগ চলাকালীন অসুস্থতার কারণে (ব্রঙ্কিয়াল উইক লাংস) অবসর নিতে বাধ্য হন, মাত্র ২৭ বছর বয়সে। সে কারণেই বিয়ে করার জন্য মায়ের অজস্র অনুরোধ সত্ত্বেও অকৃতদার থেকে গেলেন বলরাম।

জাতীয় দলের হয়ে তাঁর খেলা আজও আলো ছড়ায়। ১৯৫৮ টোকিও এশিয়াডে তিন গোল (বর্মা, হংকং আর ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে), ১৯৫৯ মারডেকা ট্রফিতে সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে এক গোল, আর ১৯৬২ জাকার্তা এশিয়াডে দু গোল (থাইল্যান্ড আর জাপানের বিরুদ্ধে) করেছিলেন তিনি। ১৯৬০ রোম অলিম্পিকেও দু গোল (হাঙ্গেরি আর পেরুর বিরুদ্ধে) ছিল তাঁর। ১৯৬২ জাকার্তা এশিয়াডে সোনাজয়ী, ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকে চতুর্থ স্থান পাওয়া আর ১৯৫৯ মারডেকা কাপে রানার্স আপ ভারতীয় দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিলেন বলরাম। মোট ২৬টি ম্যাচে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চড়িয়ে আটটি গোল করেছিলেন ভারতের হয়ে।

তাঁর সময়ের ভারতীয় ফরোয়ার্ড লাইনের আরো দুই উজ্জ্বল তারা পি কে ব্যানার্জি আর চুণী গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার দৌলতে ভারতীয় ফরোয়ার্ড লাইন তখন এশিয়ার ফুটবলে সমীহ জাগানো নাম। বলরাম ভারতের হয়ে খেলেছিলেন ১৯৫৬ আর ১৯৬০ অলিম্পিকে, ১৯৫৮ আর ১৯৬২ এশিয়াডে আর ১৯৫৯, ১৯৬১ মারডেকা কাপে। ১৯৫৯ মারডেকা ফাইনাল রাউন্ডের দলে পি কে ব্যানার্জিকে রাখা হয়নি খারাপ ফর্মের জন্য। কিন্তু অকুতোভয় বলরাম কোচ রহিম সাহেবের ঘরে গিয়ে অনুরোধ উপরোধ করে পি কেকে দলে ফিরিয়ে আনেন। পরে কোচ রহিম এ জন্য মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছিলেন সাহসী বলরামের।

এবং এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না চিরদিনের লড়াকু, আপোষহীন বলরাম সম্বন্ধে। এই স্বভাবের জন্য তিনি বারবার বঞ্চিত হয়েছেন ফুটবল মাঠে এবং তার বাইরেও।

১৯৬২ জাকার্তা এশিয়াড জিতে ফেরার পর বলরাম জানতে পারেন হায়দরাবাদে তাঁর মা খুব অসুস্থ। তাই কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে কলকাতায় না ঢুকে সোজা চলে যান মায়ের কাছে। এশিয়াডে সোনা জয়ের পর মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল খুব আবেগের। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে বারণ করে ভুল করেছিলেন, এই ছিল অসুস্থ শরীরেও তাঁর দিকে দৌড়ে আসা মায়ের বক্তব্য। ক্লাবকে না জানিয়ে সোজা হায়দরাবাদে চলে যাওয়ায় অখুশি ইস্টবেঙ্গল বলরামকে জরিমানা করে। এছাড়া তাঁর পারিশ্রমিক থেকে বিমান ভাড়াও কেটে নেওয়া হয়। এই ঘটনা তিনি জীবনে ভোলেননি এবং এজন্য এখনো এক বিতৃষ্ণা ঘিরে রেখেছে তাঁকে। চরম ক্ষুব্ধ বলরাম ১৯৬২ সালে মরসুম শেষ হতেই ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে চিরদিনের মত সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

এরপর বলরামের অস্ত্রোপচার হয়। ইস্টবেঙ্গলের অর্থসাহায্যের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আপোষহীন বলরাম। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের অনুষ্ঠানের অংশ নেওয়ার জন্য ক্লাবের আন্তরিক অনুরোধও ফিরিয়ে দেন তিনি। তবে কদিন আগে ক্লাবের দেওয়া নতুন জার্সি গ্রহণ করেছেন সানন্দেই।

১৯৭০ সালে তাঁকে জাতীয় নির্বাচক পদে নির্বাচিত করেছিল এআইএফএফ। কিন্তু তাঁর বেছে নেওয়া বহু ফুটবলারকে বাদ দেওয়া হয়, যার প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন।

পি কে ব্যানার্জির মতে, চুণী গোস্বামী আর বলরামের মধ্যে টেলিপ্যাথিক বোঝাপড়া ছিল, যা টের পেত ভারতের প্রতিপক্ষরা। দুই পরম সুহৃদ চুণী গোস্বামী আর পি কে ব্যানার্জী পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৮৩ আর ১৯৯০ সালে। আজ অবধি কিন্তু পদ্মশ্রী পাননি বলরাম।শুধু তাই নয়, ১৯৮৯ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার দেবার জন্য তাঁর নাম জমা পড়ার পর পুলিস ভেরিফিকেশনও হয়ে গিয়েছিল। তারপরেও এআইএফএফের কিছু কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রে আটকে গিয়েছিল তাঁর পদ্মশ্রী।

অনেক পরে, কলকাতা পুরসভার অধীনে কলকাতার মেয়র একাদশের কোচ হন জার্মানি সফরের কিছু ম্যাচের জন্য। তাঁরই হাতে পড়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিলেন সংগ্রাম মুখার্জী, মেহতাব হোসেন, চন্দন দাসের মত ফুটবলাররা। কিন্তু জার্মানি সফরে যাবার আগে তাঁর ভিসার ক্লিয়ারেন্স নিয়ে অযথা দেরি করা হয় এবং শেষ অবধি তাঁকে ছাড়াই কলকাতার মেয়র একাদশ জার্মানি গিয়েছিল।

নিরন্তর এই সব অন্যায় সহ্য করতে করতে পাথর হয়ে যাওয়ার ফলেই নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়ে ময়দানের উপর অবিমিশ্র অভিমানে এখন একান্ত নিজের জগতে থাকেন উত্তরপাড়ায়, গঙ্গাতীরবর্তী এক ফ্ল্যাটে। আজ আর কিছুই নেই তাঁর কাছে, গঙ্গার হাওয়া আর গঙ্গার ওপারের মন্দিরের দেবীর কাছে সবার ভালোর জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া। শুধু নীরব অভিমানে নিজেকে আরো ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেন না তিনি এখন। আজও থাকেন ভদ্রতা আর প্রতিবাদের নীরব প্রতীক হয়েই।

আর আজও তাঁর নামোচ্চারণে মাথা নত হয়ে আসে শ্রদ্ধায়। কারণ তাঁর সৎসাহস। আপোষহীনতা।

তুলসীদাস বলরামকে ভুলে যাওয়াটাই যখন দস্তুর, তখন একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লেখা শেষ করি। আমি আজও ভুলিনি ১৯৭৮ সালের জুলাইয়ের এক দিন প্রায় সন্ধে সময়কার কথা। বলরামের অবশ্য মনে থাকার কথা নয়।

মোহনবাগানের একটি লিগ ম্যাচ ছিল মোহনবাগান মাঠে। মহমেডান মাঠে বিএনআরেরও খেলা সেদিন। কাছাকাছি সময়ে ভাঙল দুটি ম্যাচ। তিনি ফিরছিলেন সেই ম্যাচ দেখে, মহমেডান মাঠ থেকে।আমিও মোহনবাগানের ম্যাচ দেখে ফিরছি মোহনবাগান মাঠ থেকে। খোলা মাঠের উপর দিয়ে তাকে হেঁটে ফিরতে দেখলাম। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম তাকে। এবং কী আশ্চর্য! তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “ও মাঠে স্কোর কী?” আমি উত্তর দিলাম “৩-০ গোলে জিতেছে মোহনবাগান।” আর তিনি “ও আচ্ছা। থ্যাঙ্ক ইউ” বলে হাঁটতে থাকলেন আবার, আগের মত।

আলো কমে আসা প্রায় সন্ধের ময়দানটা অলৌকিক আলোকময় লেগেছিল সেদিন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরে। তেতাল্লিশ বছর আগের সেই আশ্চর্য সময়ে বলরাম ছিলেন ৪২ বছরের টগবগে তরুণ।

শুভ বিলম্বিত জন্মদিন, সুদূর সেকেন্দ্রাবাদ থেকে এসে আজকের আক্ষরিক অর্থে বেলা পড়ে আসা কলকাতা ময়দানে অনন্ত আলোর মত জ্বলতে থাকা তুলসীদাস বলরাম। ভাল থাকুন আপনি, আপনার খেলার মতই।

কেউ কেউ পুড়তে থাকি নিজেদের অকৃতজ্ঞতার অনন্ত দহনে।

লেখক অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। বিভিন্ন পত্রিকা এবং ওয়েবসাইটে নিয়মিত কলাম লেখক। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বই

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.