বিস্ফোরণের তীব্রতা পরিমাপ করা হয় মেগাটন দিয়ে। কিন্তু এই সপ্তাহে সমগ্র বিশ্ব যে বিস্ফোরণে সচকিত হল, তার পরিমাপের একক টেরাবাইট। আরও সঠিক ভাবে বললে ২.৯ টেরাবাইট। দেশের মূলধারার প্রিন্ট ও ভিসুয়াল মিডিয়ার একটা বড়ো অংশই, আর সব গুরুত্বপূর্ণ খবরের মতই, এর পেছনে বিশেষ সময় ব্যয় করেনি। কিন্তু গত ৩রা অক্টোবর থেকে যে প্যান্ডোরা পেপার্স প্রকাশিত হয়ে চলেছে, তার প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ নথি আমাদের ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিত্তশালীদের যেভাবে বেআব্রু করতে সক্ষম হয়েছে তা কোন মিডিয়া ব্ল্যাকআউটের চাপা দেওয়ার সাধ্য নেই। মাইকেল প্যারেন্টি একদা মন্তব্য করেছিলেন “Poor countries are not ‘under-developed’, they are over-exploited.”। যদিও সেই মন্তব্যের প্রেক্ষিত ছিল ভিন্ন, কিন্তু International Consortium of Investigative Journalists বা সংক্ষেপে ICIJ-র শতাধিক দেশের প্রায় তিনশত সাংবাদিকের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে যে সত্য সামনে এসেছে, তাতে স্পষ্ট কীভাবে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম দরিদ্র দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিদেশে চালান করছে দেশের বিত্তবানেরা। এমনিতেই তাঁদের মধ্যে অনেকে এই সম্পদ সৃষ্টি করেছেন নিজ নিজ দেশের জনতার ব্যাপক শোষণের মাধ্যমেই। তার উপরে করের টাকার মাধ্যমে সেই সৃষ্ট সম্পদের কিছু অংশ দেশের ও দেশের মানুষের কল্যাণে ব্যয় করার যে পথ, তাও তাঁরা রুদ্ধ করে দিচ্ছেন।
এঁরা কারা? তিনশো আশি জন ভারতীয় সহ লিকে যাঁদের নাম আছে, তাঁদের সকলের পরিচয় এখনও জানা যায়নি, এই বিপুল ফাইলরাশি থেকে তা উদ্ধার করতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই যাঁদের নাম জানা যাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার, জর্ডনের রাজা আবদুল্লাহ, ইকুয়েডরের সদ্য নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি গুইলের্মো লসো, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কি, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিজের মতো নাম। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে নাম রয়েছে শচীন তেন্ডুলকার, বিনোদ আদানি, অনিল আম্বানি, জ্যাকি শ্রফ সহ অনেকের।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
“এঁরা কারা ?”
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ হলেও, “এঁরা ঠিক কীঅন্যায় করেছেন?” প্রশ্নের উত্তর কিন্তু জটিল। প্রকৃতপক্ষে,এঁরা কেউই আইনত কোন অপরাধই করেননি। অভিযুক্ত অধিকাংশ ব্যক্তিই এই বক্তব্য রেখেছেন। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, এই কথাটা এঁরা কেউই ভুল বলছেন না। সহজ বিষয়টি একটু বুঝে নেওয়া যাক। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া বিষয়টা একেবারেই জটিল না। প্রথমে আপনাকে এমন একটি স্থান খুঁজতে হবে, যেখানে কর সংক্রান্ত আইন খুবই দুর্বল এবং খুব সহজেই কোনো ভুয়ো কোম্পানি খোলা যায়। সেটি সেশেলস বা মরিশাসের মতো ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র হতে পারে, এমনকি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের মতো স্বশাসিত এলাকা, যারা নিজেদের আভ্যন্তরীণ আইন নিজেরাই নির্ধারণ করে, এমন কোন অঞ্চলও হতে পারে। এইবার এখানে খুলে ফেলুন নিজের একটি কোম্পানি, সম্পূর্ণ আইন মেনে। এরপর আপনাকে যা করতে হবে, তাকে বলা হয় ‘লেয়ারিং’।
আপনি আপনার যে টাকায় কর ফাঁকি দিতে চান,তা প্রথমেই আপনি যেখানে শেল কোম্পানি খুলেছেন, সেখানে পাঠাবেন না। অর্থের উৎস ও অর্থ ‘পার্ক’ করার অন্তিম গন্তব্যের মাঝে আপনাকে রাখতে হবে অনেকগুলি দেশের একইরকমভাবে খাড়া করা নকল (বা কখনো কখনো আসল) প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির স্তর। উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি কালো টাকা সেশেলসের কোনো শেল কোম্পানির মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাঙ্কে রাখতে চান, আপনি সেই টাকা মরিশাস, সাইপ্রাস ঘুরিয়ে তারপর সেশেলস থেকে সুইজারল্যান্ডের কোনো ব্যাঙ্কে রাখবেন। এর সুবিধা দুটি। প্রথমত, অনেকগুলি স্তরের অস্তিত্ব থাকার দরুন আপনাকে ধরা কঠিন। আর দ্বিতীয়, আপনার দেশের সরকার যদি কালো টাকার পরিমাণ জানতে চায়, তাহলে সঠিক হিসেব তার পক্ষে লাভ করা অসম্ভব। এই কারণেই ভারত সরকার সুইস ব্যাঙ্কে থাকা কালো টাকার যে হিসাব করে, তা মোট কালো টাকার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সরাসরি ভারত থেকে যারা কোনো লেয়ারিং না করেই সুইস ব্যাঙ্কে কালো টাকা রাখছে, সুইস সরকারের থেকে তথ্য চাইলে একমাত্র সেই তথ্যই পাওয়া সম্ভব।
অপর ক্ষেত্রে লেয়ারিংয়ের ফলে বহু দেশ ঘুরে টাকা যখন সুইস ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে, তার উৎস আর ভারত থাকছে না, হয়ে পড়ছে সাইপ্রাসের বা সেশেলেসের বা অন্য কোনো দেশের টাকা। সুইস সরকার বা ব্যাঙ্কের সহায়তায় ভারত যখন তার দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়া কালো টাকার হিসেব চাইছে, তখন এই লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিপুল অর্থ, যার উৎস প্রত্যক্ষ ভাবে ভারত নয়, তার হদিশ অধরাই থেকে যাচ্ছে। একমাত্র এই প্রকার পেপার লিকের মত ঘটনাই লেয়ারিংয়ের স্তর ভেদ করে অর্থের প্রকৃত উৎস নির্দেশ করতে পারে, নতুবা তা প্রায় অসম্ভব। এমনকি লিকও সব সময় কার্যকরী নয়। প্যান্ডোরা পেপার্সে দেখা যাচ্ছে পানামা পেপার্স প্রকাশ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বহু ব্যক্তি তাঁদের তৎকালীন অর্থ যে শেল কোম্পানির মাধ্যমে ‘পার্ক’ করেছিলেন, সেগুলি ভেঙে দিয়ে অন্য কোনোস্থানে অর্থ সরিয়ে দিচ্ছেন। এই কাজ যারা যারা করেছেন, তাঁদের অন্যতম হলেন শচীন তেন্ডুলকার। তিনি ‘Saas International Limited’ নামক ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে যে কোম্পানির স্টেকহোল্ডার ছিলেন (তাঁর স্ত্রী ও শ্বশুরের সঙ্গে), পানামা পেপার্স প্রকাশ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই তা লিকুইডেট করে দেন।
লেয়ারিং ও শেল কোম্পানির মাধ্যমে কর ফাঁকি দেওয়ার অনেক সুবিধা আছে। তার মধ্যে সবথেকে বড় সুবিধা হল, যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এটি বহু ক্ষেত্রেই আইনভঙ্গ না করেই করা যায়। যে দেশে কেউ শেল কোম্পানি খুলছেন, সেই দেশে কোম্পানি খোলা আর সেই কোম্পানির মাধ্যমে টাকা ‘পার্ক’ করা — কোনোটাই অপরাধ নয়। অপরাধ নয় দেশের বাইরে কোথাও অর্থ বিনিয়োগ করা। তাই এই যে শচীন থেকে শাকিরা — সবার আইনজীবী বলছেন এই কাজকর্ম একেবারে বৈধ, কেউ ভুল বলছেন না। কিন্তু ‘লেটার অফ দ্য ল’ লঙ্ঘিত না হলেও, ‘স্পিরিট অফ দ্য ল’ যে লঙ্ঘিত হচ্ছে, এ কথা যে কেউ বলবেন। এই বিপুল পরিমাণ কালো টাকা দেশে থাকলে তা থেকে যে কর আদায় হত, তা দিয়ে শত শত বিদ্যালয়, হাসপাতাল, নতুন রাস্তা তৈরি হতে পারত। নির্মাণ করা যেত একটি শক্তিশালী কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের। যাঁরা দেশে থেকে ফাঁপা দেশপ্রেমের ঝান্ডা নেড়ে এই কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁরা দেশের মানুষের সঙ্গেই প্রকৃতপক্ষে প্রতারণা করছেন। এই নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই।
এখন প্রশ্ন হল, এর প্রতিকার কী? এর কোনো সহজ উত্তর নেই। প্রথমত, সর্ষের মধ্যেই ভূত বর্তমান। প্যান্ডোরা পেপার্সে ইন্ডিয়ান রেভেনিউ সার্ভিসের দুজন উচ্চপদস্থ অফিসারের নাম এসেছে, তাঁর মধ্যে একজন আয়কর দপ্তরের প্রাক্তন মুখ্য আধিকারিক। এসেছে দেশের প্রাক্তন সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের নামও। দেশের শাসনকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও যদি এই নৈতিক ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রতিকার কী করে হবে? এর পাশাপাশি দেশের বাইরে একবার কালো টাকা চলে গেলে, সেই টাকা ফেরত আনা বা তার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ধরা কার্যত অসম্ভব। এই লিকের পেপারও যথেষ্ট না। কারণ কোনোব্যাঙ্ক বা প্রতিষ্ঠানই স্বীকার করবে না, যে এ তাদের নথি। তাই কোর্ট কেসের সময় প্রমাণ হিসাবে এগুলি ব্যবহার করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, যদি কালো টাকা ধরতে হয়, এ দেশে থাকতেই ধরতে হবে। তার জন্য চাই সরকারের সদিচ্ছা ও একটি শক্তিশালী স্বশাসিত রাজস্ব সেবা। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই দুটিরই এই দেশে অভাব রয়েছে। আর আন্তর্জাতিক স্তরে এই কর ফাঁকি কীভাবে ধরা যায়, তার একটি প্রস্তাব অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি দিয়েছিলেন। তিনি একপ্রকার আন্তর্জাতিক আয়কর দপ্তরের মাধ্যমে এর একটা সমাধান সম্ভব বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু তার জন্যও পৃথিবীর প্রধান দেশগুলির যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, তার যে একান্ত অভাব রয়েছে, তা তিনি অস্বীকার করেননি।
অন্তিমে পানামা, প্যারাডাইজ বা প্যান্ডোরা পেপার্সথেকে বিভিন্ন দেশের অগ্রগণ্য ব্যক্তিদের নৈতিক দেউলিয়াপনার ও তাঁদের নিজ নিজ দেশের মানুষকে তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার কাহিনী জানা গেলেও, যতদিন এই তথ্যকে ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার সদিচ্ছা মানুষের মধ্যে উঠে আসছে, ততদিন কয়েকদিনের মুখরোচক সংবাদ হওয়ার অধিক এর আর কোন সুগভীর প্রভাব পড়বে না।
অথচ মানুষ ভুলে যাচ্ছে, খুব সহজেই ভুলে যাচ্ছে। পানামা পেপার্স ফাঁস করার জন্য গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে প্রান দিতে হয়েছিল ICIJ-র অন্যতম সাংবাদিক ড্যাফনে গালিজিয়াকে। কজন মানুষ তাঁকে মনে রেখেছেন? প্রকৃতপক্ষে মানুষকেও দোষ দেওয়া যায় না। ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য, বিভ্রান্ত করার জন্য একটি অতীব শক্তিশালী মেশিনারি বিশ্বজুড়ে খাড়া আছে। একে ভেঙে ফেলা একেবারেই সহজ কাজ নয়। বড়জোর এখানে একটা খোঁচা, ওখানে একটা ধাক্কা দেওয়া যেতে পারে। ICIJ কে অভিনন্দন, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের সাংবাদিকরা সেই ধাক্কাটা দিচ্ছেন। গ্রীক পুরাণে প্যান্ডোরা তার বাক্স থেকে মৃত্যু, ব্যাধি সহ পৃথিবীর সকল দুঃখ দুর্দশার কারণকে মুক্তি দেওয়ার পর যা খুঁজে পেয়েছিল, তা হল ‘আশা’। ICIJ-র প্যান্ডোরার বাক্সের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। উন্মোচিত এই প্যান্ডোরার বাক্স থেকে যে ক্ষোভ, ক্রোধ, অসহায়তা মানুষের মনে সঞ্চারিত হচ্ছে, একদিন সেই স্ফুলিঙ্গ দাবানল তৈরি করবে — এই আশা আমরা করতেই পারি।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।