বুলডোজার মানে রাস্তা সমান করার এবং গাছ পাথর ইত্যাদি সরিয়ে দেবার যন্ত্রবিশেষ। বুলডোজার মানে বিশাল ইমারত, কাঠামো নিমেষে ধূলিসাৎ করার যন্ত্রবিশেষ। বাংলা ব্যাকরণে শব্দের উৎকর্ষ, অপকর্ষ বলে একটি বিষয় আছে। সময়ান্তরে শব্দের অর্থের অপকর্ষ হয়, পরিবর্তন ঘটে। যেমন বুলডোজার শব্দ বর্তমান সময়ে অর্থের ‘উৎকর্ষে’ হয়েছে বুলডোজার রাজ। বুলডোজার রাজ মানে রাষ্ট্রশক্তির নিপীড়নের নতুন হাতিয়ার। কোনো নাগরিক শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই বুলডোজার দিয়ে তার বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিমেষে গুঁড়িয়ে দেওয়াই হচ্ছে বুলডোজার রাজ। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল জাতীয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ভেসে উঠেছিল দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীতে মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, নিমেষে উপড়ে ফেলা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ঘর গেরস্থালি। যদিও বিজেপিচালিত দিল্লি পৌরসভা বলেছিল, বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবেই। অন্যদিকে কয়েক দশকের ভিটেমাটির উপর দাঁড়িয়ে আসমা বিবিরা বলেছিলেন “না ইনসাফি হ্যায়, মুসলমান জরুর হ্যাঁয় হাম, লেকিন কিসি কা দুশমন নেহি হ্যাঁয় হাম।” জালালুদ্দিন বিড়বিড় করে বলেছিলেন, সব ভেঙে দিয়েছে। আমাদের জল খাওয়ারও কোনো উপায় নেই।”
শুরুটা হয়েছিল ২০১৮ সালে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে। ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরেই বিলোনিয়া বাজারে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল লেনিনের মূর্তি। যে কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তিরই আক্রমণের লক্ষ্য হয় কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীরা। বুলডোজার দিয়ে লেনিনের মূর্তি ভাঙা তারই নিদর্শন। ২০১৪ পরবর্তী ভারতবর্ষ অন্তরঙ্গে নিজেকে বদলে নিয়েছে। ভিন্ন মত, ভিন্ন সুর, সংখ্যালঘু, বামপন্থী, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত মানুষকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে একমুখী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের যে প্রয়াস আরম্ভ হয়েছে, সেখানে বুলডোজার হয়ে উঠেছে আধুনিক অস্ত্র। অবৈধ, বেআইনি নির্মাণ অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে সংবিধান, নাগরিক অধিকারের তোয়াক্কা না করে ওটি চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বুলডোজার রাষ্ট্রশক্তির নির্লজ্জ প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধ নির্মাণ নির্মূল করা, অপরাধীদের শায়েস্তা করার নামে যথেচ্ছ বুলডোজার চালানো হয়েছে নাগরিক অধিকারের উপর। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার যদিও বলে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে এবং দাগী অপরাধীদের শায়েস্তা করার জন্যই এই ব্যবস্থা। কেমন আইনের শাসন, তার একটি ছোট নমুনা দেখে নেওয়া যেতে পারে। সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক শাজিল ইসলাম আনসারি বান্দা জেলায় মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ সম্পর্কে নাকি আপত্তিজনক মন্তব্য করেছিলেন। ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে বারেলিতে তাঁর পেট্রল পাম্পকে অবৈধ নির্মাণ বলে দেগে দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। শাজিল বলেছেন “আমি যতদিন পর্যন্ত বিজেপির বিধায়ক ছিলাম, ততদিন সমস্ত কিছু বৈধ ছিল। বিজেপি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার সমস্ত কিছু অবৈধ হয়ে যায়।”
বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার হজরত মহম্মদ সম্পর্কে মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কানপুর ও প্রয়াগরাজে হিংসা ছড়িয়ে পড়েছিল গত বছরের জুন মাসে। হিংসা দমনের নামে আদিত্যনাথ সরকার অভিযুক্ত সংখ্যালঘুদের বাড়ি, দোকান ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ধূলিসাৎ করে। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে সুপ্রিম কোর্ট ও দেশের বিভিন্ন হাইকোর্টের ছজন প্রাক্তন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ চেয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানাকে চিঠি পর্যন্ত লেখেন।
শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, বিজেপি শাসিত গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশেও একই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘুদের ভীত সন্ত্রস্ত করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। গুজরাটের খাম্বাত ও আনন্দ জেলায় রামনবমীর শোভাযাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য জেলা প্রশাসন সংখ্যালঘুদের ছোট ছোট চায়ের দোকান, পানের দোকান কোনো নোটিস ছাড়াই ভেঙে দেয়। অবাক হওয়ার কিছু নেই। উত্তরপ্রদেশে আদিত্যনাথের ডাকনাম যেমন বুলডোজার বাবা, তেমনি মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ চৌহানের ডাক নাম হয়েছিল বুলডোজার মামা। তিনি তো আবার খারগোন আর রাইসানে রামনবমীর শোভাযাত্রা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়িও গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, বাড়িগুলো ছিল সংখ্যালঘুদের।
শুধু কি গোবলয়েই বুলডোজার রাজ চলছে? মোটেই না। কাশ্মীরে রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রায় যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ বুলডোজার দিয়ে অনেকের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উত্তরাখণ্ডের হলদোয়ানেও সংখ্যালঘু মানুষের ঘরবাড়ী রাতারাতি বেআইনি ঘোষণা করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে।
Bulldozer Injustice: Dispossessing Muslims in India's Uttarakhand state #Haldwani pic.twitter.com/0xqJipzYMs
— Indian American Muslim Council (@IAMCouncil) February 8, 2023
আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য আসামেও এই অনুশীলন চলেছে। গত ৪ জানুয়ারি গৌহাটি হাইকোর্ট রায় দেয়, ২০২২ সালের ২১ মে নওগাঁ জেলার বাটাড়রাবা থানার সংখ্যালঘু গ্রামে আসাম পুলিস যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং সংবিধান বহির্ভূত। বুলডোজার চালিয়ে উচ্ছেদের কারণে সেদিন যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আসাম সরকারকে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এবার আসুন পশ্চিমবঙ্গে। ২২ নভেম্বর ২০২২, খেজুরির মনসাপুজোয় শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন “উত্তরপ্রদেশ মডেল এখানেও হবে। তৈরি থাকুন, বুলডোজার চলবে।” মানে যন্ত্র চালিয়ে শুধু উচ্ছেদ নয়, এ হল একদল নাগরিককে সন্ত্রস্ত করার নতুন ব্যবস্থা।
আজকের ভারতবর্ষে বুলডোজার নাগরিকের গণতান্ত্রিক, সংবিধানস্বীকৃত অধিকার কেড়ে নেওয়ার হাতিয়ার। আর এই হাতিয়ার ব্যবহার করা হবে অবৈধ নির্মাণ উচ্ছেদের নামে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে, জি-২০ বৈঠক সুসজ্জিত করার নামে। কিন্তু আসলে সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত করা হবে। নতুন এক মতাদর্শ। রাষ্ট্রের অবাধ্য হলেই তাকে ধ্বংস করে দাও।
আরো পড়ুন পরেশ দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক বাঙালি নিরাপদ নন
ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কতটা হিংস্র হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই সেদিন দেখেছে মৃতপ্রায় এই দেশ। ১৩ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) গ্রামীণ কানপুরে চাহালা মজৌলি গ্রামের মইথা তহসিলের বাসিন্দা কৃষ্ণগোপাল দীক্ষিতের নামে কিছু মানুষ গ্রামসভায় অভিযোগ জানায়, তাঁর বাড়ি সরকারি জমিতে তৈরি। অভিযোগ পেয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই প্রশাসন পুলিস নিয়ে আসে এবং ধ্বংসকার্য চালায়। পাশের কুঁড়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ঘটনায় কৃষ্ণগোপালের স্ত্রী ৫৪ বছরের প্রমীলা দীক্ষিত এবং ২২ বছরের মেয়ে শিবা পুড়ে মারা যায়। কৃষ্ণগোপালের বক্তব্য, অবৈধ নির্মাণের অভিযোগ মিথ্যে। শুধু বুলডোজারই চালানো হয়নি, পাশের মন্দিরের হ্যান্ড পাম্পটিও খুলে নেওয়া হয়েছিল। আগুন নেভেনি জলের অভাবে। যথারীতি জেলাশাসক বলেছেন, মা আর মেয়ে নিজেরাই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল।
বুলডোজার প্রতিহত করতে না পারলে এই আগুন ছড়িয়ে পড়বে। শুধু উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট বা আসাম নয়, আগামী দিনে গোটা দেশে চলবে বুলডোজার রাজ। এখন প্রশ্ন একটাই, বুলডোজার আটকাবে কে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।