বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ তথা অভিনেতা পরেশ রাওয়াল প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে বললেন “গ্যাসের দাম বাড়লে পরে কমেও যাবে। কিন্তু আশেপাশে বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা থাকতে শুরু করলে কী করবেন? কম দামি গ্যাস নিয়ে কী করবেন? বাঙালিদের মাছ রান্না করে খাওয়াবেন?” তারপর সোশাল মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় শুরু হতে ক্ষমা চাওয়ার নাম করে বললেন “বাঙালি বলতে আমি বেআইনি বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গাদের কথা বলেছি”। অর্থাৎ বাঙালি মানেই ওঁর কাছে বাংলাদেশি অথবা রোহিঙ্গা! শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টাও করলেন না পরেশ। উলটে দায়সারাভাবে আরেকটা পচা মাছ ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। এমন করার সাহস পরেশ কী করে পেলেন তা এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া (বা তার অভাব) দেখে বোঝা গেল।

এই ধরণের প্রবল জাতিবিদ্বেষী, বাঙালিবিদ্বেষী মন্তব্যের পরেও প্রায় ২৪ ঘন্টা বাংলার রাজনৈতিক দল, এগিয়ে থাকা এগিয়ে রাখা সংবাদমাধ্যম বা বাঙালি সংস্কৃতির স্বঘোষিত রক্ষক বুদ্ধিজীবীদের টুঁ শব্দটিও করতে শোনা যায়নি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বাঙালি বিদ্বেষের এটাই প্রথম প্রকাশ নয়। বর্ধমানের পলাশ অধিকারী, শুক্লা অধিকারী ও তাঁদের দেড় বছরের সন্তান আজও জেলবন্দি। কারণ বেঙ্গালুরু পুলিসকে সমস্ত নথি দেখানোর পরেও দারোগাবাবুরা বিশ্বাস করেননি ওঁরা বাংলাদেশি নন। এই সন্দেহের ভিত্তি কী? ওঁদের বাঙালিত্ব।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বেঙ্গালুরুতেই বাঙালি প্রবাসী শ্রমিক বস্তিতে পুলিশি রেড হয় কোভিড লকডাউনের আগে। আর লকডাউনের পরে তাঁদের উৎখাত করা হয়। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন উনি শ্রমিকদের বাংলাদেশি বলে চিনতে পারেন ওঁদের খাবার দেখে। কী খাবার? বাঙালির অন্যতম প্রধান খাদ্য চিড়ে।

২০২২ সালে আইন মানার ভানটুকুও দূষিত যমুনার জলে বিসর্জন দিয়ে দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরীর বাঙালিপ্রধান এলাকার বহু বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ ওখানে নাকি বেআইনি বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গারা থাকেন। তখন বিজেপির সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল বহু প্রগতিশীল মানুষের চোখের মণি আম আদমি পার্টি। দুই দলের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয় কে কত বেশি অভিবাসীবিরোধী, বাঙালিবিরোধী কথা বলতে পারে তা নিয়ে।

এর কয়েক মাস পরেই দক্ষিণ দিল্লির অভিজাত বাঙালি অধ্যুষিত চিত্তরঞ্জন পার্কের মাছ ও অন্যান্য আমিষের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয় নবরাত্রির অছিলায়। কিন্তু দিল্লিরই সাকেতসহ অন্যান্য এলাকায় আমিষের বাজার খোলাই থাকে। শুধু বাঙালিপ্রধান এলাকাতেই দক্ষিণ দিল্লি পৌরসভার এই ফরমান জারি করা হয়।

বারবার বাঙালির খাদ্য, ভাষা এবং সার্বিকভাবে বাঙালি পরিচিতির উপরে আক্রমণ নেমে আসা যে কাকতালীয় নয় তা বলাই বাহুল্য। আসলে বাঙালির সামগ্রিক সংস্কৃতি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের ধারণার বিরুদ্ধে। বাঙালিদের ৯৮% মানুষ আমিষাশী। এই সংখ্যাটা গুজরাটে ৩৯%, উত্তরপ্রদেশে ৫৩% আর রাজস্থানে ২৫%। কাজেই ব্রাহ্মণ্যবাদী নিরামিষভোজন এখানে চাপিয়ে দেওয়া কঠিন। এছাড়া নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও বাঙালি সংকর জাতি। “শক-হুন-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন” বাঙালির ক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিক সত্য। নেগ্রিটো, অস্ট্রিক,আর্য-অনার্য, মঙ্গোলয়েড, আরবিসহ বহু জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আজকের বাঙালির জন্ম। এর প্রভাব বাংলা ভাষাতেও দেখা যায়। বাংলা শব্দভাণ্ডারের এক বিরাট অংশ আরবি, ফারসী, পর্তুগিজ এমনকি জাপানি ভাষা থেকেও এসেছে। হিন্দুস্তানি ভাষাকে আরবি, ফারসী মুক্ত করে রাজনৈতিক প্রকল্প হিসাবে যেভাবে হিন্দি ভাষা তৈরি করা হয়েছিল, বাংলায় তা করা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং যে একমাত্রিক ধারণা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভিত্তি, তা বাংলায় রফতানি করা সহজ নয়।

কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে এই সচেতনতা শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে ইদানীং আর দেখা যাচ্ছে না। তাই একের পর এক বাঙালিবিরোধী ঘটনা ঘটে গেলেও বাংলার রাজনৈতিক দল বা সংবাদমাধ্যম – কেউই দিল্লির শাসকের বিরুদ্ধে তেড়ে ফুঁড়ে উঠছে না। তৃণমূল কংগ্রেস সিবিআই-ইডির ভয়েই হোক বা ভিনরাজ্যে বেড়ে ওঠার শখেই হোক, ২০২১ সালে আপন করে নেওয়া বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বর্ষশেষের সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় জানিয়েছে। সিপিএমও জাহাঙ্গীরপুরীরা ঘটনার আগে এ বিষয়ে সরব হয়নি। তারপরেও যে এই ইস্যু নিয়ে একদা উদ্বাস্তু রাজনীতির প্রধান শক্তি কমিউনিস্টরা বিশেষ উৎসাহ দেখিয়েছে তা নয়।

কিন্তু বাঙালিদের উপর বাঙালি হওয়ার কারণে অত্যাচার থেমে থাকেনি। তাই রাজনীতিতে বাঙালি প্রতিনিধিত্বের সেই ফাঁক পূরণ করতে উঠে এসেছে বাংলা পক্ষের মত পরজাতিবিদ্বেষী সংগঠন। এরা বিহারী এবং হিন্দিভাষী গরীব হকারদের হেনস্থা করার সময়ে বাঘ, কিন্তু নিজেদের চেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়ার সময় এলেই স্পষ্ট হয়ে যায় তারা নেহাতই কাগুজে বাঘ। উনিশ লক্ষ বাঙালিকে অনাগরিক করে দেওয়া আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের কাছে বাংলা পক্ষ প্রধান গর্গ চ্যাটার্জির ক্ষমাপ্রার্থনার ভিডিও দেখলে ওঁকে বাঘের চেয়ে বাঘের মাসি (আচ্ছা, মেসোই হল) বেশি মনে হয়। সেই ধারা মেনেই উনি পরেশের মন্তব্যের ব্যাপারে একটি নরম-গরম টুইট করেই ক্ষান্ত থেকেছেন। গর্গবাবুরা গর্জানোর সময় চেরাপুঞ্জি আর বর্ষানোর বেলায় সাহারা মরুভূমি হয়ে যান।

আরো পড়ুন ১৯ মে: কলকাতায় বিস্মৃত একটি ভাষা আন্দোলন

তবে পরেশের মত ব্যক্তিত্বের মুখ দিয়ে বাঙালিবিদ্বেষী মন্তব্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এফআইআর করেছেন। সেই এফআইআরের একটি অনুচ্ছেদে উনি বাঙালি প্রবাসী শ্রমিকদের (যারা প্রধানত মুসলমান) সম্পর্কে লিখেছেন তা প্রশংসনীয়।

বাঙালি
সিপিএম রাজ্য কমিটির এফআইআর

তৃণমূল কংগ্রেসও প্রতিবাদ করেছে, তবে কুণাল ঘোষের বক্তব্যে মৎস্যচাষ বেশি আর মতাদর্শ এবং শ্রমিকদের দুর্দশার কথার পরিমাণ কম।

প্রাতিষ্ঠানিক বাঙালিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিধানসভায় অন্তত একটা প্রস্তাব পাশ করানোর কথাও তৃণমূল এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত বলেনি। সিপিআইএমএল লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যও পরেশের নিন্দা করে টুইট করেছেন।

তবে সেলিম বাদে কারোর মন্তব্যে বা কোনো সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এর মতাদর্শগত দিকটা তুলে ধরা হয়নি। এর কারণ খুব সহজেই বোধগম্য। বাঙালিবিরোধী রাজনীতি এখনো জায়মান স্তরে আছে। তাই এর আঘাত সবার আগে পড়ছে বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অংশ মুসলমান প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর। বেঙ্গালুরুর ফিটফাট তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীরা বা দিল্লির ভদ্রলোক সাংবাদিকরা তাঁদের সামাজিক,আর্থিক প্রতিপত্তির জোরে এখনো নিরাপদে আছেন। তবে বেশিদিন থাকতে পারবেন, এমন ভরসা না করাই ভাল। কারণ পরিকল্পিত গণহত্যা শারীরিক হিংসা দিয়ে শুরু হয় না। হলোকস্ট গ্যাস চেম্বার দিয়ে শুরু হয়নি, হয়েছিল ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণের মাধ্যমে। আজ আঘাত জাহাঙ্গীরপুরীতে নামলে কাল চিত্তরঞ্জন পার্কেও নামবে। তাই প্রতিরোধ দরকার। তারও আগে দরকার আদর্শগত শিক্ষা, যা এখনো বাংলার ভদ্রলোকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। আজ আমাদের একদিকে বাংলা পক্ষ, অন্যদিকে আরএসএস, মাঝে প্রগতিশীল মতাদর্শের অন্ধকার। তাই জাতিগত সংহতি না হোক, নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থপর উদ্দেশ্য থেকেই উচ্চবর্গীয় বাঙালি ভদ্রলোকদের উচিত নিজেদের আর্থসামাজিক পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে আরএসএসের এই প্রাতিষ্ঠানিক বাঙালিবিরোধিতা প্রতিরোধ করা।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.