সম্প্রতি দ্য কাশ্মীর ফাইলস বিষয়ক বিতর্কটি আবার ফিরে এসেছে। সম্পাদকীয় কলামের ভাষায় বলা যায় কাশ্মীর সমস্যা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। যখন কাশ্মীর ফাইলস প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল, তখন আমার মত অনেকেই প্রতিবাদ করেছিলেন, বলেছিলেন এই ছবির সঙ্গে শিল্পের বা মানবিক অভিব্যক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমরা চুনোপুঁটি, সুতরাং জলে ভেসে গেছি। ওই ছবিটিকে ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জায়গা দেওয়া হয়েছিল এবং সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে যতটুকু জানতে পারলাম, জুরিদের প্রধান ইজরায়েলের চলচ্চিত্রকার নাদাভ ল্যাপিড একে কদর্য এবং শিল্প আখ্যা দেওয়ার অযোগ্য মনে করেছেন। ফলে একটা তর্ক তৈরি হয়েছে, যে প্রচার কতদূর শিল্প হতে পারে। এই বিতর্কের গঠনটাই ভুল।
প্রচার শিল্প হতেই পারে। যখন “আমি তোমাকে ভালবাসি” বলি, তখনো সেটা আমার ভালবাসার প্রচার – আমার ভালবাসা অন্য ব্যক্তিকে জানানোর উদ্দেশ্যে। তা নিয়ে যদি কবিতা লিখি, সেটাও প্রচার। যেমন শেক্সপিয়রের সনেটগুচ্ছ বা জন কিটসের কবিতা। সেগুলোও এক ধরনের প্রচার, কারণ তা পাঠকের কাছে নিবেদন করা হয়েছে অথচ তা নিঃসন্দেহে শিল্প। কিন্তু সমস্যা হল কাশ্মীর ফাইলস কোনো প্রচারও নয়, শিল্প তো নয়ই।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই যে বললাম প্রচার শিল্পে হতেই পারে, তা কিন্তু দক্ষিণপন্থী প্রচারের ক্ষেত্রেও সত্যি। যেমন ১৯১৫ সালে ডেভিড ওয়ার্ক গ্রিফিথ যখন দ্য বার্থ অফ আ নেশন বানালেন, তখন আমেরিকায়, সিনেমা কী করে আখ্যান বর্ণনা করবে নির্ধারিত হল, অর্থাৎ কথকতার জন্ম হল। এমনকি মন্তাজ জিনিসটাকে বোঝার জন্যও এই আদিপাঠ আমাদের পক্ষে জরুরি ছিল। এই গ্রিফিথ চূড়ান্ত বর্ণবিদ্বেষী। ছবি হিসাবে, ছবির বিষয় হিসাবেও বার্থ অফ আ নেশন চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু আবিশ্বে যাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তাঁরা ওই ছবিকে প্রায় বর্ণপরিচয়ের সম্মান দিয়েছেন। কারণ এখান থেকে সিনেমার প্রয়োগবিধি, আচরণবিধি সবকিছুই আয়ত্ত করা যায়। ওই ছবিই যে আমাদের প্রাইমার হিসাবে কাজ করেছে – সেকথা ভারতবর্ষে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকও বহুবার বলেছেন। বার্থ অফ আ নেশন নিঃসন্দেহে একটি বর্ণবিদ্বেষী ছবি, কিন্তু তার নির্মাণের মধ্যে এমন সপ্রতিভ চাতুর্য আছে যা দেখে বিপরীতমুখী সের্গেই আইজেনস্টাইন মুগ্ধ হতে পারেন। এমনকি লেনিনও গ্রিফিথের ইনটলারেন্স ছবিটিকে একটি অনুধাবনযোগ্য ছবি মনে করে রাশিয়ার চলচ্চিত্রকারদের দেখতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলা ভাল, ইনটলারেন্সই আইজেনস্টাইনের মন্তাজের ভিত্তিভূমি। তফাত হল গ্রিফিথ ইতিহাসকে ব্যক্তির দিকে প্রবাহিত করিয়েছেন আর আইজেনস্টাইন ব্যক্তিকে ইতিহাসের দিকে টেনে নিয়ে গেছেন। এই দেখার রকমফেরই দক্ষিণপন্থার সঙ্গে বামপন্থার মূল পার্থক্য।
আরও একটি চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী ছবির কথা বলি। শুধু দক্ষিণপন্থী নয়, রীতিমত ফ্যাসিবাদী ছবি, যা আমাদের অবশ্য দ্রষ্টব্য। ছবিটির নাম ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল (১৯৩৫)। ছবিটি লেনি রিফেনস্টাল নামে জনৈক জার্মান সিনেমাপটিয়সীর দ্বারা নির্মিত। অনেকে বলেন তিনি নাজি জার্মানির সর্বাধিনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের বান্ধবীও ছিলেন। এই ছবিটি বস্তুত হিটলারকে দেবতার স্থানে উন্নীত করতে সাহায্য করে এবং আস্ত জার্মান জাতি সেইসময় যে মোহগ্রস্ততায় ভুগেছিল তার অন্যতম প্ররোচনা এই ছায়াছবি। কিন্তু সমস্ত চলচ্চিত্র বিদ্যায়তনে দেখানো এই ছবিটি যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে বোঝা যাবে লেনি মূলত একজন শিল্পী। ভ্রান্ত নীতির দ্বারা পরিচালিত হলেও তাঁর ছবি বানানোর উৎকর্ষ নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। তাই তথ্যচিত্রের ইতিহাসে এ ছবি অবিস্মরণীয়। অথচ এ ছবির বিষয় নাজি পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের বিবরণ এবং হিটলারের দেবত্বপ্রাপ্তি। এই বক্তব্যকে আমরা সকলেই নিন্দা করি, কিন্তু নির্মাণকে আমরা সাগ্রহে দেখতে সতত প্রস্তুত। অক্টোবর ছবিটি যদি দেখি, সেটিও সরাসরি প্রচারমূলক ছবি। কিন্তু তা ঈশ্বরপ্রতিম আইজেনস্টাইনের নির্মাণ বলেই এত বড় শিল্প হয়ে উঠেছে, যা প্রত্যেক দর্শক মুগ্ধ হয়ে দেখেন।
সুতরাং প্রচার সমস্যা নয়। সমস্যা হল অপপ্রচার। কাশ্মীর ফাইলস যদি প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তাহলেও ভুল হবে। সেই কারণেই ছবিটির বাণিজ্য সফলতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও চোখ কপালে তোলার মত নয়। রাষ্ট্রীয় ছাপ কোনো ছবিতে পড়তেই পারে, ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ছবিও হয়ে উঠতে পারে। তা বলেই যে সেই ছবি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা এবং গুজরাট থেকে মণিপুর জনচিত্তহরণ করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শুনতে পাই ছবিটি নাকি সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সকলকে দেখতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও এই ছবি শোলে বা তদ্রূপ কোনো ছবির জনপ্রিয়তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। তার একটিই কারণ – এই ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী ছবি বানাতে জানেন না। বস্তুত তিনি ছবির লোকও নন, তিনি ঘৃণা এবং বিদ্বেষের রাজদূত। ঘৃণার যে পরিচয় এই ছবিতে পাওয়া যায় তাতে একে কদর্য বলার ব্যাপারে ইজরায়েলি নির্দেশক ল্যাপিডের সঙ্গে একমত না হয়ে উপায় নেই।
আরো পড়ুন ঋত্বিক কুমার ঘটক, তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো
এ ছবির পরিচালক ভুলে গেছেন যে পণ্ডিত সমাজের যাবতীয় দায়দায়িত্ব তাঁর নয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কিন্তু কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্প্রদায়েরই লোক। তাঁর বোন বিজয়লক্ষ্মী তো পণ্ডিত শব্দটাই পদবি হিসাবে ব্যবহার করতেন। তাঁদের পরিবার এলাহাবাদে এসে বসতি স্থাপন করেছিল বটে, কিন্তু জওহরলাল এবং তাঁর পিতা মতিলাল আজীবন কাশ্মীরি নওহর বা জলধারার স্পর্শ তাঁদের পদবিতে বহন করে গেছেন। এমনও অনেকে বলেন যে মহাকবি কালিদাসও কাশ্মীরি পণ্ডিত। তিনি কাশ্মীর উপত্যকা থেকেই উজ্জয়িনীতে এসেছিলেন। কথাটা সত্যি হোক আর না-ই হোক, ভারতের ইতিহাসে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অবদান কেউ অস্বীকার করে না এবং তাদের প্রতি ১৯৮৯-৯০ সালে হওয়া অবিচারকেও কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু এ-ও সত্যি, যে সারা ভারতের হিন্দুরা যখন প্রবল শীতে অমরনাথ যাত্রা করে এবং পবিত্র শিবলিঙ্গ দর্শন করে তখন তাদের যত্ন করে ছড়িদার হয়ে যাঁরা নিয়ে যান তাঁরা সকলেই মুসলমান। কাশ্মীরের সর্বত্র যুগ যুগ ধরে এই সম্প্রীতি এমনভাবে সম্পৃক্ত যে বলতেই হবে অগ্নিহোত্রীর কাশ্মীর ফাইল একটি উই ধরা ফাইল। তা অনতিবিলম্বে মানুষের স্মৃতি থেকে এবং নথি থেকে লুপ্ত হবে।
কোনো সন্দেহ নেই কাশ্মীর ভারতীয় রাজনীতিতে বরাবরের জটিল পরিসর। আমরা যখন গোঁফ ওঠার বয়সে কাশ্মীর কি কলি দেখেছিলাম, তখন শাম্মি কাপুর আর শর্মিলা ঠাকুরের ঠোঁটে ‘দিওয়ানা হুয়া বাদল’ ছিল। সে এক পিকচার পোস্টকার্ড কাশ্মীর। তার বহুকাল পরে বিশাল ভরদ্বাজের হায়দার ছবিতে যে কাশ্মীর দেখলাম তা একেবারে অন্য কাশ্মীর। কোন কাশ্মীরটা সত্যি? বেদনার কুসুমগুচ্ছ না স্বপ্নের মেঘমালা? তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরের মানুষের বাকি ভারতের জীবনধারার সঙ্গে জুড়ে থাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। অন্ধকারে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা/আঁধারে মলিন হল যেন খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার – রবীন্দ্রনাথ বলাকায় যা লিখেছিলেন অগ্নিহোত্রী তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ বা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস পরবর্তী ঘটনাবলীর মত যেসব বিচ্ছেদ ঘটে গেছে তা নিয়ে নিশ্চয়ই শিল্পে আলোকপাত করা যেতে পারে। কিন্তু একজন শিল্পী তো সেই দুর্ভোগের দিকে তাকিয়ে ভাববেন, সময় এত বিষাক্ত হয়ে গেল কী করে? কেউ না চাইতে তবু নদী মানুষের মূঢ় রক্তে ভরে যায়/সময় সন্দিগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করে নদী নির্ঝরের থেকে নেমে এসেছ কি, মানুষের হৃদয়ের থেকে? কিন্তু সেই রক্তনদীর উচ্ছ্বাস যদি আমাদের হৃদয়কে অন্ধ করে দেয়, তা কখনোই শিল্পের কাঙ্ক্ষিত রূপ নয়।
ল্যাপিডের বক্তব্যে আপত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করি, একজন শিল্পী কি রাষ্ট্রদূত? তাঁকে শিল্পী হিসাবেই অতিথি করে আনা হয়েছিল এবং একজন শিল্পীর সবসময় তাঁর মুক্ত চিন্তা প্রকাশ করার অধিকার আছে। একজন শিল্পীর কাছ থেকে কেন আশা করা হবে তিনি ভারত সরকারের অতিথি বলে সরকারের নীতি ও কার্যক্রম অনুমোদন করবেন? এমনিতেও অগ্নিহোত্রীর ছবি কোনো সরকারি নথি নয়, ফলে ওই ইজরায়েলি পরিচালকের কোনো কূটনৈতিক দায় নেই ওই ছবির সমালোচনা না করার। দ্বিতীয়ত, শিল্পকে কূটনীতির দায় নিতে হলে আমাদের কোনো পরিচালকও কোনো মার্কিন নীতির সমালোচনা করতে পারবেন না। যেমন সত্যজিৎ প্রতিদ্বন্দ্বী ছবিতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেটাও তাহলে অন্যায় ছিল, কারণ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। মুক্তিযুদ্ধ অথবা তিয়েন আন মেনের ছাত্র বিদ্রোহ নিয়েও আমাদের কোনো কথা বলা চলবে না, কারণ সেসব অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
একজন শিল্পী একটি চক্রান্তের মুখে ছাই দিতে পারবেন না – এরকম ভবিষ্যৎ আমরা কল্পনাও করিনি। আজ যে এ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে এটাই দুর্ভাগ্য। আমাদের সকলের দুর্ভাগ্য যে আমরা জনসাধারণের কাছে শিল্পীর মতামতের জন্য কৈফিয়ত দিচ্ছি। আসলে শিল্পীর মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সমাজ বা রাষ্ট্র কোন সম্পর্কে আবদ্ধ থাকবে সে বিষয়ে আমাদের ধারণা দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে আবৃত হয়ে আছে। একসময় এই দেশ বলেছিল “হিরণ্ময়েন পাত্রেন সত্যস্যাপিহিতং মুখম”, অর্থাৎ হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ ঢাকা আছে। আজ সেই হিরণ্ময় পাত্র এমন কালো মেঘে ঢেকে গেল!
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] আরো পড়ুন ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ শিল্প তো নয়ই, প্রচ… […]
[…] আরো পড়ুন ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ শিল্প তো নয়ই, প্রচ… […]