কর্নেল গৌতম কর

কাতারে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর। মেসি, রোনাল্ডো, এমবাপে, নেইমারের পাশাপাশি এই বিশ্বকাপের নায়ক অথবা খলনায়ক ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (VAR)। বহু গোল বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ফুটবল অনুরাগীরা অনেকেই রীতিমত বিরক্ত। কারো মতে এর ফলে খেলা বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, খেলার গতি কমছে। কেউ আবার মনে করছেন এর ফলে খেলার মানের উন্নতিই হচ্ছে।

এই বিতর্কের আলোচনায় প্রথমেই যেটা বলে নেওয়া দরকার সেটা হল এবার যা নতুন সেটা হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) সাহায্যে একটা দ্বাদশ ক্যামেরা রাখা হয়েছে শুধু অফসাইডের জন্য। বলের মধ্যে একটা চিপ বসানো আছে। সেই চিপ একজন ফুটবলারের শরীর কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে সেই তথ্য সেকেন্ডের ৫০০ ভাগের এক ভাগে ভেঙে পাঠাচ্ছে। তাই ব্যাকএন্ড থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এতটা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। VAR থাকায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বলে দেওয়া যাচ্ছে কোনটা অফসাইড বা অফসাইড নয়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

অনেকে প্রশ্ন করছেন, অফসাইড সংক্রান্ত সর্বশেষ নিয়মটা কী? কিছুদিন আগেও আমরা জানতাম যে, একজন যদি অফসাইডে থাকেন কিন্তু বল স্পর্শ না করেন, তাহলে অন্যজন গোল করে গেলে সেই গোল বৈধ। এই নিয়ম কি একই আছে? উত্তর হল, হ্যাঁ, নিয়ম একই আছে। নিয়মে কোনো বদল হয়নি, শুধু প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। ফলে অফসাইডের সিদ্ধান্ত আগের চেয়ে অনেক বেশি সঠিক হচ্ছে। আগে তো চোখের দেখার উপর নির্ভর করা হত। আমি নিজেও রেফারি থাকার সময়ে দেখেছি, মানুষের পক্ষে সবটুকু সম্ভব হয় না। একটা ঘটনা পঞ্চাশবার দেখেও কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল হয় অনেকসময়। AI পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট ফুটবলার এগিয়ে ছিল না পিছিয়ে ছিল। এতে যদি, কিন্তু, হয়ত বলার জায়গা নেই।

এবার প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট ফুটবলার গোলের ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কিনা। সেই সিদ্ধান্ত তো মাঠের রেফারিই নিচ্ছেন। AI কেবল খেলোয়াড় ঠিক কোন জায়গায় ছিলেন তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। এতে সহকারী রেফারিদের উপকারই হচ্ছে। এক্ষেত্রে রেফারি এবং সহকারী রেফারিদের বলা থাকে, সংশয় থাকলে পতাকা তুলবেন না। সংশয় নিরসনের জন্যই AI আছে, VAR আছে, আমরা তার দ্বারস্থ হব। আমার মতে এটা অবশ্যই অগ্রগতি। কারণ আমরা সকলেই নিশ্চয়ই চাই শতকরা ১০০ ভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত হোক। প্রথম ম্যাচ থেকে এখন পর্যন্ত কতগুলো গোল বাতিল হয়েছে ভেবে দেখুন। AI না থাকলে এই গোলগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতই এবং লোকে রেফারিদের ছিঁড়ে খেত। VAR সে সম্ভাবনা নির্মূল করেছে।

শুধু অফসাইড বা জার্মানির বিরুদ্ধে জাপানের দ্বিতীয় গোলটাই নয়, অনেকগুলো পেনাল্টি নিয়েও জোর আলোচনা চলছে। পর্তুগালের প্রথম ম্যাচের কথাই ধরা যাক। ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোকে ফাউল করায় পর্তুগাল পেনাল্টি পেল। স্টুডিওতে বসে খোদ লুই ফিগো এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন। আর্জেন্টিনার প্রথম ম্যাচে মেসিরা পেনাল্টি পেয়েছিলেন সৌদি আরবের একজন রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড় আর্জেন্টিনার একজন জার্সি টেনে ধরে রাখায়। ফিগো বলেছিলেন ফুটবল শরীরী খেলা। এটুকুতে পেনাল্টি দিতে হলে প্রতি ম্যাচেই প্রচুর পেনাল্টি দিতে হবে। আর্জেন্টিনার তৃতীয় ম্যাচেও পেনাল্টি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। পোলিশ গোলকিপার বল ধরতে গিয়ে পারেননি, তার ফলেই হাত মেসির মুখে লেগেছে বলে মনে হয়েছে অনেকের। কিন্তু রেফারি পেনাল্টি দেন, তাও VAR-এর সাহায্য নিয়েই। এই ঘটনাগুলো দেখে অনেকেই মনে করছেন পেনাল্টি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি উদারতা দেখানো হচ্ছে।

পেনাল্টি এমন একটা বিষয় যা সবসময়েই বিতর্কিত। ফিগো একজন বিরাট মাপের ফুটবলার, ফলে তাঁর মতামত উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু রেফারির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে অনেককিছু বিবেচনা করতে হয়। খেলোয়াড়রা কে কীরকম জায়গায় ছিলেন তা দেখতে হয়, সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মত অবস্থায় ছিলেন কিনা, বিপক্ষের খেলোয়াড়দের অবস্থান, কতজন বিপক্ষের খেলোয়াড় ছিলেন, যিনি বল আক্রমণ করছিলেন বল তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল না বেরিয়ে গিয়েছিল, এরকম অনেকগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে। সুতরাং ফিগোর মতামত ব্যক্তিগত, একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক নয়। রেফারি ফুটবলারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

আরো পড়ুন হৃদয় থাকা কাল হল কি এরিকসেন, সাবরিনার? 

ফুটবল আইনের সবচেয়ে বড় কথা হল, সবকিছু রেফারির মতামতের উপর নির্ভর করে। রেফারি যখন মাঠের মাঝখানে আছেন, তখন তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমরা ৩২টা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল দেখছি। তিনি একটা বিশেষ কোণ থেকেই দেখছেন, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ফুটবলের আইন খেলার স্বার্থে তাঁকে এই অধিকার দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, রেফারি একজন গাড়ির চালকের মত। কোনো চালক চান না দুর্ঘটনা ঘটুক। কোনো রেফারিও চান না ভুল সিদ্ধান্ত নিতে।

নিবন্ধকার প্রাক্তন ফিফা রেফারি, সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ রেফারিইং। ২০১৭ অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচ কমিশনার। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.