শুভময় মৈত্র
বরাত জোরে বইমেলার ঠিক আগেই জুটে গেল দুটি বই। কোভিডকালে নতুন বইয়ের গন্ধ শোঁকার অভ্যাসটাই হারিয়ে গিয়েছিল। সেই জায়গায় দিন কয়েকের মধ্যে দুটি বই হাতে পাওয়া, এবং সবার থেকে বড় কথা দুটি বইয়ের গন্ধই আমার চেনা, একেবারে চিরপরিচিত নতুন পাতার আঘ্রাণ। যে বই আগে হাতে পেলাম, তার কথা দিয়েই শুরু করি। কৌশিক গুড়িয়া মহাশয়ের নতুন কবিতার সহজ গণিত। একেবারে নতুন বই। রেখে দিয়েছি পড়ার টেবিলের উপর। ঝকঝকে প্রচ্ছদ। হঠাৎ দেখি বইয়ের উপরে কে যেন কলমের দাগ দিয়ে দিয়েছে। প্রথমে ভাবলাম আশেপাশের ছোট্ট কেউ। তারা যে আমার ওপর মোটেই তুষ্ট নয় জানি। কিন্তু তার জন্যে বইয়ের উপর তাদের রাগ করার কোনো কারণ দেখি না। আমার নিজের মাথাটা অবশ্য আজকাল একটু গোলমাল করছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনটা হয়েই থাকে। নিজেই হয়ত নতুন বইয়ের উপর হিজিবিজি কেটেছি। কবে মাথার ডাক্তার দেখাব সেই কথা ভাবছিলাম। যাই হোক, সে দাগ থাক। আপাতত প্রচ্ছদ পেরিয়ে প্রবেশ করা যাক ভেতরের পাতায়।
এই বইয়ে “নতুন কবিতা” বলতে বোঝানো হয়েছে একবিংশ শতকের শুরুর দশকের কথা। লেখকের ভাষায় সেটাই শূন্য দশক। অঙ্কের শুরু যে শূন্য থেকে তা বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন আঙ্কিক লেখক। আর নতুন যুগের কবিদের তিনি বিশ্লেষণ করেছেন সংখ্যায়, পরিসংখ্যানে আর রাশিবিজ্ঞানের ছন্দে। বাংলা কবিতার দশক বিচার এবং ধারাগত বিন্যাসে শূন্য দশক বলতে লেখক শিখিয়েছেন সেই সময়ের কবিদের ধারাপাত, যাঁরা ২০০০ থেকে ২০১০ সাল নাগাদ লিখতে শুরু করেছেন। এ হেন নব্য দশকের কবিতা নিয়েই এই আলোচনা গ্রন্থ। কৌশিক গুড়িয়ার এই প্রবন্ধগুচ্ছে সংখ্যার চালুনিতে ঝাড়াই বাছাই হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ১৭২ জন নতুন কবি। তাঁদের প্রত্যেকের কবিতা নিয়ে মনগড়া, কাব্যিক পর্যালোচনার পরিবর্তে বিবিধ মাত্রা ও অবস্থান নিয়ে পরিসংখ্যাননির্ভর বিশ্লেষণ অবশ্যই এক নতুন ধারাবৃত্তান্ত। সাহিত্য-পরিচয়ের এই মাপকাঠি যেহেতু পরিসংখ্যান ও গণিতনির্ভর, তাই লেখক ও সমালোচকের দূরত্ব অথবা নৈকট্য এখানে অনুপস্থিত, বরং তথ্যের বাতাবরণ কবিকুলের সাহিত্যকীর্তি উন্মোচনের মূল অস্ত্র।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
অন্তর্জালের যুগে সংখ্যা এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। নির্বাচন থেকে অর্থনীতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশের বিকাশ — সর্বক্ষেত্রেই সংখ্যাভিত্তিক বিশ্লেষণ আজকাল যেহেতু তথ্য উন্মোচনের হাতিয়ার, তাই সাহিত্য পর্যালোচনাতেও এই প্রকরণ ব্যবহার করা যেতেই পারে। গ্রন্থটি সেই ধারার সূত্রপাত করে। অর্থাৎ সাধারণভাবে আমরা কবি কী ভেবেছেন বলে ভাবসম্প্রসারণ শুরু করি, এই চেষ্টা তার থেকে ভিন্ন। চার্ট, গ্রাফ, কিংবা ভেনচিত্রের অবতারণা করে লেখক বাংলা সাহিত্যে নতুন কবিদের অবস্থা অথবা অবস্থান নির্ণয় করতে চেয়েছেন। একাধিক অধ্যায়ে লেখা এই ধরনের পর্যালোচনা এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে তা বলাই বাহুল্য। রবি প্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত বইটিতে দশটি প্রবন্ধ, সাময়িকপত্রে প্রকাশিত একটি চিঠি এবং কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ছাড়াও স্থান পেয়েছে ডঃ তপন বাগচীর অবতরণিকা। আলোচনা করা যাক দু-একটি পরিচ্ছেদ নিয়ে।
যেমন পঞ্চাশের পাতায় শুরু ‘প্রচ্ছন্ন মেধার দশক’। এই প্রবন্ধে লেখক শূন্য দশকের কবিতাকে যে তিনটি মূল ধারায় ভাগ করেছেন তা হল কথাকাব্য, ভাবকাব্য এবং বিমূর্তি-আরোপিত কাব্য। খুঁজে পাওয়া গেছে এই তিনটি ধারায় কবিতা লেখেন যথাক্রমে ৫৯%, ১৫% এবং ২৬% কবি। কথাকাব্যের অনুসারীরা অতিচেতনার কথা লেখেন ৭%, ব্যক্তিগত কথা ৩২% ও নিসর্গ বিষয়ে লেখেন ২০% কবি। ভাবকাব্যের লেখকরা ১% অতিচেতন, ৭% নরম-সমাজ, ৫% রাজরীতি ও ২% দর্শন বিষয়ক কবিতা রচনা করেন। আবার বিমূর্তি-আরোপিত কাব্যে আস্থাশীল লেখকরা অতিকৃত্রিম মিথ্যে কবিতা লেখেন ৮%, নব্য সামাজিক ভোগবাদ ৭% ও নিসর্গ নিয়ে লেখেন ১১% কবি। এই “সত্য” অথবা “মিথ্যা” শব্দগুলির ব্যবহার কিন্তু এই সমালোচকের দায় নয়, পুরোপুরি পুস্তক রচয়িতার। কবিরা চটে গেলে তাই দায় লেখকের। সংখ্যা-গুণগত বিশ্লেষণে পাওয়া কিছু তথ্য অবশ্যই চমকে দেয়। যেমন লেখকের কাব্যিক রাশিবিজ্ঞানে শূন্য দশকে সত্য কবিতার লেখক মাত্র ২১%, বাকী ৭৯% কবিতাই মিথ্যে, হাইব্রিড, উচ্চফলনশীল! ছন্দ বিশ্লেষণেরও অভাব নেই এই বইতে। একটি বিশ্লেষণ বলছে শূন্য দশকের এই কবিরা ছন্দ বর্জন করেন ৭৪% ক্ষেত্রে, নিখুঁত ছন্দ লেখেন ৮%, আর নাকি ভুল ছন্দ ব্যবহার করেন ১৮% কবি। এই সারমর্ম অবশ্যই লেখকের ভাবনা। পাঠক পাঠিকাদের অধিকার থাকল মানা কিংবা না মানার।
এই বইয়ের সমালোচনার মূল জায়গা একগাদা বানান এবং ছাপার ভুল। অবতরণিকার সাতের পাতায় “জানিয়ে” কে “জানিথে” ছাপিয়ে যে ভুলের শুরু, ছাপার মাথা কেটে তা এগিয়ে চলেছে ৩০-৩১ পাতায়, তার শেষ না খোঁজাই ভাল। আশা করি আমরা পরে কখনও হাতে পাব পরিমার্জিত সংস্করণ। তবে বইটি শেষ করে প্রচ্ছদে ফিরে আসতেই হবে। এই প্রচ্ছদ লেখকের। এবং তা অসাধারণ। যে কালির দাগের কথা শুরুতে বলেছিলাম, তা আসলে সচেতন আঁকিবুঁকি। একেবারে নতুন ভাবনা। ভুল বানানের হোঁচট সামলাতে পারলে ৭৯ পাতার নতুন কবিতার সহজ গণিত কষে পাঠক-পাঠিকাদের মজা পাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
***
এবার আসি অন্তরা মুখার্জি সম্পাদিত করোনার কড়চা বইটির আলোচনায়। শিরোনামের নিচে কিছুটা ছোট হরফে লেখা “মহামারির আলোআঁধারিতে বাংলার মুখচ্ছবি”। অর্ণব চক্রবর্তীর আঁকা প্রচ্ছদটি বেশ গভীর, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার মত। শুরুতেই এবং শেষ পাতার অন্দরে সম্পাদিকার স্বজন হারানোর বেদনা স্পষ্ট। এই সম্পাদনা সে ক্ষতে কতটা প্রলেপ দিয়েছে তা জানা নেই, তবে এই বই যারা পড়ছেন তাঁরা প্রায় সকলেই জানেন কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গত দুবছর পথ হেঁটেছেন এই শহর, এই দেশ কিংবা এই পৃথিবীর মানুষ। অনেকেই হারিয়েছেন প্রিয়জনকে। এই বইটি সেই কথা মনে করানোর, আবার নতুন পথ হাঁটারও বটে।
অত্যন্ত উচ্চমানের পঁয়তাল্লিশটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এই বইতে। লেখক লেখিকাদের নাম আলাদা করে লিখতে গেলে অনেকটা জায়গা চলে যাবে, এবং বিশেষ বিশেষ কিছু প্রবন্ধ আলাদা করে তুলে ধরাও ঠিক হবে না। তবে বইটি যারা পড়তে চান, তাঁদের শুরুতেই লোভ দেখিয়ে দেওয়া যাক যে সমাজের বেশ কয়েকজন অতিপরিচিত মানুষ লিখেছেন এই বইতে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাঁরা কেউ প্রথিতযশা শিক্ষক, কেউ স্বাস্থ্যকর্মী, কেউ নাট্যশিল্পী। বইটির শুরু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লেখা দিয়ে। মোট ছটি লেখা আছে এই বিষয়ে। অতিমারীর মোকাবিলায় যাঁরা লড়াই করেছেন, তাঁরাই আবার কলম ধরেছেন। “কী অসুখ দিলে কেষ্ট / জমে নিলেও ডোমে নিচ্ছে না” দিয়ে শুরু হয়েছে ডাক্তারবাবুর লেখা। পুস্তক সমালোচকের পোশাক ছেড়ে এখানে নিজের মত দিতেই হবে। এই অসুখে অসুস্থের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে আত্মীয়দের। বিজ্ঞান হয়ত অন্য কথা বলবে, কিন্তু আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতা অন্যরকম। কোভিড আক্রান্ত মেয়ের পাশে শুয়ে মায়ের খুব ক্ষতি হয়নি, অন্যের কষ্টে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রতিবেশী সুস্থ থেকেছেন, আবার একেবারে ঘরবন্দী সাবধানী মানুষ আক্রান্ত হয়ে পাড়ি দিয়েছেন অন্য লোকে। আমি বিশ্বাস করি, কোভিডে সবথেকে বেশিবার প্রাণ হারিয়েছে মনুষ্যত্ব, মানুষকে মানুষের থেকে আলাদা রেখে। সাবধানী থাকা যেমন বিজ্ঞানসম্মত, তেমনই নিজের লোকের জন্যে ঝুঁকি নেওয়াও। মায়েরা তো নিয়মিত সন্তানের জন্ম দেন। সেই ঝুঁকি নেওয়া যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনই মানুষের থেকে মানুষকে আলাদা রাখায় এই অসুখকে আমরা অকারণে অধিক ভয় পেয়েছি। তার দাম দিতে হয়েছে বারবার। হাসপাতালে ক্লান্ত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে দাঁড়ালে হয়ত এর থেকে বেশি ক্ষতি কিছু হত না। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা বলে হাসপাতাল থেকে শ্মশান সব জায়গাতেই কোভিড ছিল, তবে সেই কোভিড শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বৈঠকখানায় ছিল আরও অনেক বেশি। আর তার জন্যে ছোটদের জীবন থেকে দুবছর কেড়ে নেওয়ার যুক্তি কোনো অনুসিদ্ধান্তে খুঁজে পাওয়া শক্ত। সেখানেই অসাধারণ সাতটি প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে কোভিডকালের শিক্ষা পরিস্থিতি।
এরপর শাসক এবং প্রশাসক। সঙ্গে রাজনীতি এবং অর্থনীতি। পরিযায়ী শ্রমিক, কর্মহীন মানুষ, প্রান্তিক শিল্পীদের নিয়ে সুগভীর আলোচনা। সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ার গল্প, মানসিক অস্থিরতা, সোশাল মিডিয়া, অ্যানিমেশন — জীবনের কিছুই প্রায় খোয়া যায়নি এই রচনাসমগ্রে। এসেছে গানের কথা, এসেছে আমাদের প্রাণের গ্রুপ থিয়েটার। আমার দুই অতি প্রিয় অভিনেতার লেখা আছে এই বইতে। কিন্তু ওই যে বললাম, নাম লিখব না কিছুতেই। পাতা উল্টোলে তবেই জানতে পারবেন কতজন গুণী মানুষ কলম চালিয়েছেন এই বইতে, আঁচড় কেটেছেন আপন ইচ্ছায়।
সমালোচনা আছে। এই বইয়ের লেখা এত ভাল যে বিভিন্ন লেখার আগে অতিপরিচিত কবিতা বা গানগুলি উল্লেখ না করলেও চলত। এই বইতে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের গদ্যই আমার কাছে কোভিডকাল উত্তরণের কবিতা। বিশ্লেষণী মন তাই বারবার হেরে যায় ছবি হয়ে ওঠা ভালোবাসার গল্পের কাছে। একবার নয়, অনেক বেশিবার পড়তে হবে এই বই। কোভিড অতিক্রম করে, কোভিড ভুলে। তবে শেষে অক্ষর বিভ্রাট ধরতে গিয়ে কিছু ভুল করছি কি? যেমন পাতা ৩৮৩। নিচের দিক থেকে নয় নম্বর লাইনে “বামপন্থা” কি “বামপন্থী” হবে? আশা থাকবেই অভিনয় বেচেও পেশাদার অভিনেতা স্বপ্ন দেখাবেন বিপ্লবের। তাই চলুন, এই বই পড়তে পড়তে চিঠি লিখি রক্তিম আকাশের ঠিকানায়।
***
শুধু এই দুটো বই কেন? বইয়ের আম্ফানে উড়ে যেতে (থুড়ি, বইয়ের সাম্পানে ভেসে যেতে) আসুন সাবধানী দূরত্বটুকু বজায় রেখে সবাই ছুটি বইমেলায়, হইচই করতে। কোভিডে নয়, অক্ষর খুঁজে মরতে। মিশে যাক ফাগুনের ধুলো আর নতুন বই-পাতার গন্ধ। দৌড়ে গিয়ে বই গিলি, বই কিনি, এক্ষুনি।
১। নতুন কবিতার সহজ গণিত, কৌশিক গুড়িয়া, রবি প্রকাশ, ১২০ টাকা। প্রচ্ছদ লেখকের।
২। করোনার কড়চা, সম্পাদনা অন্তরা মুখার্জী, রূপালী, ৫৫০ টাকা। প্রচ্ছদ অর্ণব চক্রবর্তী।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।