এক দিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমান মহিলাদের হিজাব পরা নিয়ে বিতর্ক চলছে, অন্য দিকে সামাজিক মাধ্যমের একটি ছবি নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। কী সেই ছবি? কেনই বা তা নিয়ে বিতর্ক? ছবি ঠিক নয়, আসলে একটি ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন, যা সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় শাসক দলের গুজরাট শাখার ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়েছিল। ব্যঙ্গচিত্রটিতে দেখানো হয়েছে বেশ কিছু দাড়ি ও টুপি পরা মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। ব্যঙ্গচিত্রটি এক ঝলক দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়, কী দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। সামনে বিজেপির নির্বাচনী প্রতীক পদ্ম, পিছনে লেখা “সত্যমেব জয়তে”, অর্থাৎ সত্যের জয় হোক, মাঝে সরকারি অশোক স্তম্ভ। এই ব্যঙ্গচিত্রটি ছড়িয়ে পড়ার পরেই নানা মহল থেকে আপত্তি ওঠে। ফলে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম থেকে এই ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়, কিন্তু বিতর্ক এখনো চলছে।

সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের আপত্তির মূল কারণ এই ব্যঙ্গচিত্রটিতে মুসলমানদের দেশের শত্রু হিসেবে দেখানো হয়েছে, এবং তাঁদের শাস্তি হচ্ছে ফাঁসি, এমনটা বোঝানো হয়েছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যার সংবিধানে এখনো প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ধর্মাচরণের অধিকার আছে, সেখানে কি একটি বিশেষ ধর্মালম্বী মানুষকে এইভাবে দেশের শত্রু হিসাবে দেখানো চলে? অনেকেই উল্লেখ করেছেন, এই ব্যঙ্গচিত্রটির সঙ্গে নাজি জার্মানির সময়কার একটি ব্যঙ্গচিত্রের অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে, এবং ব্যাপারটি কাকতালীয় নয়। ১৯৩৫ সালে নাজি জার্মানিতে ঠিক এইরকম একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে দেখানো হয়েছিল ইহুদি, কমিউনিস্টসহ যারা ‘জার্মানদের শত্রু’, তাদের একত্রে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। যাতে বুঝতে অসুবিধা না হয় কারা ফাঁসি দিয়েছে জাতির শত্রুদের, তাই সঙ্গে কুখ্যাত নাজি স্বস্তিকা এঁকে দেওয়া হয়েছিল। ছবিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকস্ট মিউজিয়ামের ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এখন প্রশ্ন হল, কেন শাসক দলের তরফে এইরকম একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করা হল পাঁচ রাজ্যে নির্বাচন চলাকালীন? কেনই বা এই হিজাব সংক্রান্ত বিতর্ককে সামনে নিয়ে আসা হল? তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র তথাকথিত বিকাশের উপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না? তাহলে কি তাঁর এই উন্নয়ন ছাড়াও আরও কিছু চাই, যা দিয়ে তিনি মানুষে-মানুষে বিভাজন তৈরি করতে পারবেন? সেই উদ্দেশ্যেই সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে?

একথা সত্যি, যে ২০০৮ সালে আমেদাবাদে ২২টি বিস্ফোরণে বহু মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনা নিয়ে আদালতের রায় বেরিয়েছে, যাতে ৩৮ জন অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। এ-ও সত্যি যে বিস্ফোরকগুলো ঘটনাস্থলের আশেপাশের দাঁড় করিয়ে রাখা, বাস, স্কুটার এবং সাইকেলগুলোতে হয়তো রাখা হয়েছিল, কিন্তু তা বলে দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রতীককে বিরোধীদের সন্ত্রাসবাদের শরিক হওয়ার প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরতে পারেন না। নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশে এক নির্বাচনী জনসভায় বলেছেন, তিনি অবাক হয়েছেন কী করে সন্ত্রাসবাদীরা সাইকেলকেই (সমাজবাদী পার্টির প্রতীক) পছন্দ করল। এর পিছনে আরও বড় হাত (কংগ্রেসের প্রতীক) আছে, এবং হাতির (বহুজন সমাজ পার্টির প্রতীক) মত একটি বড়সড় জন্তু ঘরে ঢুকে পড়লে যেমন মানুষ ভীত হয়, এটাও তেমন ভীত হওয়ার মত ঘটনা।

এর আগেও যখন বিহারে নির্বাচন হচ্ছিল, তখনো প্রধানমন্ত্রী এইরকম একটি মন্তব্য করেছিলেন। সেই সময়ে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন চলছিল। সংসদে পাস হয়ে যাওয়া এই আইন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। তাই তার বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তাঁরাই সামনের সারিতে ছিলেন। শাহীনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস — বিভিন্ন স্থানে যে জমায়েতগুলি হচ্ছিল, তার পুরোভাগে ছিলেন মুসলমান মহিলারা। সেই সময়ে বিক্ষিপ্ত কিছু হিংসার ঘটনাও ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে বিহারের নির্বাচনে বিরোধীরা চেষ্টা করছিলেন কর্মসংস্থানের মত বিষয়কে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা যায়। ঠিক সেইসময় প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাচনী সভায় বলেন, কারা নাগরিকত্ববিরোধী আন্দোলন করছে তা তাঁদের পোষাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ তিনি স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছিলেন, শুধু মুসলমানদেরই এই নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সমস্যা আছে, শুধু যারা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ তাদেরই সমস্যা, তাই তারা আন্দোলন করছে।

একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন প্রকারান্তরে বা সরাসরি দেশেরই একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করে দেন, তখন দেশের সাধারণ মানুষ সেটাই বিশ্বাস করেন। তাঁদের মনে মুসলমানদের সম্পর্কে এমনিতেই বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা তৈরি আছে। দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করেও সংখ্যাগুরু মানুষের অনেকটাই ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা তাঁদের মুসলমানদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাই প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল বিলক্ষণ জানেন ১৯৩৫ সালের সেই ব্যঙ্গচিত্রটি সেদিন যতটা প্রভাব ফেলেছিল, আজ তার প্রভাব আরও গভীর হবে। দেশের কোনো একটি রাজ্যে যদি মুসলমান মহিলাদের হিজাব পরা নিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখা যায়, তাহলে তার প্রভাব কি নির্বাচন চলতে থাকা রাজ্যগুলোতে পড়বে না? যদি একটি রাজ্য থেকে ওইরকম একটি ব্যঙ্গচিত্র ছড়ানো হয়, তাহলে অন্য রাজ্যে কি মুসলমানদের সম্পর্কে খারাপ বার্তা পৌঁছনো যাবে না? যাঁরা মুসলমানদের সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নন, যাঁদের কাছে মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী, যাঁদের কাছে হিজাব পরেন বলেই মুসলমান মহিলাদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা বৈধ, তাঁরা যে উৎফুল্ল হবেন, এ আর আশ্চর্য কি?

আজ যখন একটি রাজ্যে হিজাব নিয়ে সমস্যা পাশের রাজ্যে প্রভাব ফেলছে, আজ যখন কর্ণাটকের স্কুল কলেজের সীমানা ছাড়িয়ে বিহারের ব্যাঙ্কে হিজাব পরে টাকা তুলতে দেওয়া হচ্ছে না, তখন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল ভালই জানে, ওই ব্যঙ্গচিত্রের প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে। এই ধরনের ছবি বা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে শুধুমাত্র তাঁদের দলকে আজ নির্বাচনে জিততে সাহায্য করবে না, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও এর প্রভাব পড়বে। যদিও ফেসবুক, টুইটার বা ইন্সটাগ্রাম থেকে এই ছবি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, হোয়াটস্যাপে ছড়িয়ে পড়া ছবি ফেরানো সম্ভব নয়। আসলে ভারতের শাসক দল এই ছবির ঘৃণা ও বিদ্বেষ ফেরাতেও চায়না হয়ত। তাই যখন এক বিজেপি বিধায়ক বলেন, মুসলমানদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত, তখন তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রতিবাদও দেখা যায় না।

তবে ওই বিধায়কের প্রস্তাব কিন্তু শুধুমাত্র কথার কথা নয়। ক্যাবিনেট ইতিমধ্যেই আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ড সংযুক্তিকরণের আইন অনুমোদন করেছে। এ কাজ সম্পন্ন হলে পর দেখা হবে কে বা কারা সরকারবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে, সেখান থেকে চিহ্নিত করে যদি বেছে বেছে মুসলমান বা অন্য সরকারবিরোধীদের নাম ভোটার তালিকা থেকে মুছে দেওয়া হয়, তখন তাঁরা ভোটাধিকার হারাবেন। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারই মানুষ হারাবেন।

লক্ষ লক্ষ মানুষ হলোকস্টের কথা মনে করিয়ে দেওয়া ওই কার্টুন দেখেছেন এবং আগামীদিনেও দেখবেন। বহু মানুষ হয়ত সেই বিজেপি বিধায়কের কথাও, শুনেছেন কিন্তু প্রতিবাদ করেননি। এর সমাধান কী তা নিয়ে কি কেউ ভাবছেন? আগামীদিনে কি এই ঘৃণাই ভারতের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে? পিছনে চলে যাবে রুটি রুজির লড়াই? কোনো রাজনৈতিক দলের কি এই বিষয়ে কথা বলার সদিচ্ছা আছে?

শেষ করা যাক কানাডার উদাহরণ দিয়ে। কানাডায় কোভিড এবং ভ্যাক্সিন ম্যান্ডেট নিয়ে আন্দোলনের জেরে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। কানাডার সরকার নগদ লেনদেন তুলে দিয়ে একটি ডিজিটাল আইডির সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল কারেন্সি সংযোগ করাচ্ছেন। সেই ডিজিটাল আইডির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমকে যুক্ত করার কথা হয়েছে। তারপর দেখা হচ্ছে, কে বা কারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করছে। তারপর ওখানকার নাগরিকদের বেছে বেছে ওই ডিজিটাল আইডি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে আর কেনাকাটাও না করা যায়। একেই এডওয়ার্ড স্নোডেন “সিভিল ডেথ” অথবা গুলি না করেই মেরে ফেলা বলেছেন বহুদিন আগে। একদিকে ঘৃণা তৈরী করা অন্যদিকে যাঁরা এর বিরোধিতা করবেন তাঁদের সিভিল ডেথ — এই তো সোজা অঙ্ক। আমাদের দেশের বিরোধী দলগুলি এই সোজা কথা বুঝতে পারছেন না, নাকি বুঝতে চাইছেন না?

মতামত ব্যক্তিগত

আরো পড়ুন

হিজাব নিয়ে মামলা: ভারতীয় বিচারব্যবস্থার আরেকটি পরীক্ষা

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

3 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.