কথাবার্তা বলে যা বুঝতে পারছি, চারপাশে থাকা তৃণমূলের মুসলিম সমর্থকরা সবাই অবাক। হঠাৎ তাঁদের এই যুগের মসীহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এত কাছের মানুষ শুভাপ্রসন্ন কেন ভাষা দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনে ছলে বলে কৌশলে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ালেন? জল আর পানির মধ্যে বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করলেন কেন? সংখ্যালঘুদের সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার যে চেষ্টা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) শাসিত রাষ্ট্রে চলছে, তার পক্ষে এমন খোলাখুলি প্রচারে হঠাৎ নেমে পড়লেন কেন শিল্পীমশাই?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
অনেকেই দেখলাম শুভাপ্রসন্নের অতীব কুৎসিত, বিভাজনের রাজনীতি উস্কে দেওয়া মন্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে অভিধানের আশ্রয় নিচ্ছেন। পানি যে আদতে সংস্কৃত শব্দ, চর্যাপদেও ছিল; অথবা বাংলা অভিধানে আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষা থেকে কত শব্দ এসেছে – সেসব নিয়ে তথ্যবহুল প্রতিবাদ করছেন। সে তাঁরা করতেই পারেন। কিন্তু একজন সংখ্যালঘু যুবক হিসাবে, এই হিন্দুরাষ্ট্রের একজন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে আমি জানি, এসব করে কোনো লাভ হয় না। শুভাপ্রসন্ন নিজেও ওই তথ্যগুলো জানেন। এত সাধারণ ও সহজলভ্য তথ্য ওঁর না জানার কথা নয়। যাঁরা এই কথাগুলো বলেন, তাঁরা জেনেই বলেন। এসব উচ্চারণ আসলে এক বৃহত্তর রাজনীতির অংশ, যে রাজনীতি সংখ্যালঘুকে ‘অপর’ করে তোলে।
প্রতি বছরই একাধিকবার এমন বিতর্ক হয়। কখনো শব্দ নিয়ে, কখনো মুসলমান সমাজের কোনো প্রথা নিয়ে, কখনো অন্য দেশের কোনো ঘটনা নিয়ে। সোশাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট খোলার পর থেকেই দেখি, আমাদের মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা এমন কিছু হলেই প্রতি বছর নিয়ম করে প্রতিবাদী যুক্তি দেন। অথচ তাতে লাভের লাভ কিছু হয় না। বরং দক্ষিণ কলকাতার অতীব প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও “ও তুমি বুঝি মুসলিম! আমি তোমাকে বাঙালি ভেবেছিলাম…” শোনার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
তাই এবার হয়ত এই বুদ্ধিজীবীদের ভাবার সময় এসেছে, তাদের এই যৌক্তিক প্রতিবাদে কোথাও গলদ আছে কিনা। আসলে যে সমাজে যুক্তিবোধকে খুন করা হয়, সেখানে প্রতিরোধের ভাষাও সব সময় যুক্তির সরল ব্যাকরণ মেনে চলতে পারে না। সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদী সমাজ সংখ্যালঘুকে সেই সুযোগ দেয় না – এটা সরাসরি বুঝে নেওয়া জরুরি। কাজী নজরুলের দেশে শুভাবাবুর মতো একজন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীকে পানি শব্দের উৎপত্তি বোঝানোর চেষ্টা পণ্ডশ্রম। তার চেয়ে জরুরি তাঁকে আরএসএস তথা হিন্দুরাষ্ট্রের এজেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করা।
শুভাপ্রসন্নের মন্তব্যের উত্তরে ‘গুড মুসলিম’ বুদ্ধিজীবীদের যৌক্তিক প্রতিবাদের গলদগুলোকে চিহ্নিত করা কঠিন নয়। অপরাধ নেবেন না, আমার সীমিত জ্ঞানে ওই গলদগুলো বলার স্পর্ধা দেখাচ্ছি। ২০২৩ সালের ভারতবর্ষ আমাকে, একজন সংখ্যালঘুকে বাধ্য করছে এই স্পর্ধা দেখাতে।
এই ধরণের যুক্তিকাঠামোর গোড়ার গলদ হল, মুসলমানরা রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকে কথা বলেন। মুসলমানরাও যে বাঙালি তা প্রমাণের চেষ্টা করেন। এর কী প্রয়োজন! কয়েকদিন আগেই তো একুশে ফেব্রুয়ারি গেল। আমরা, বাঙালি মুসলমানরা, বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। আমরা বুকে গুলি খেয়েছি বাংলা ভাষার জন্য। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে এই ঘটনা অনন্য। সেই রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতদের উত্তরাধিকারী আমরা। কাকে নিজেদের বাঙালিয়ানার প্রমাণ দেব? কেন দেব? আমরা কতটা বাঙালি সে কৈফিয়ত চাওয়ার অধিকার কারোর নেই। যাঁরা পানি বলেন, আব্বা বলেন, খালা বলেন, তাঁরা ভাষার জন্য যে আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেটা শুভাপ্রসন্নরা আগে করে দেখান, তারপর না হয় কে কতটা বাঙালি তা নিয়ে আলোচনায় বসা যাবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রের যেমন লড়াই হতে পারে না, ঠিক তেমনই বাঙালি হবার লড়াইয়ে মাননীয় শুভাপ্রসন্নরা বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে একই মঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য নন। এমনকি হৃদয়ে মোদীজিকে বিশ্বগুরু ভাবা যেসব শিক্ষিত ফেসবুকে ফুফু, খালা, নাস্তা, আব্বা ইত্যাদি শব্দগুলোকে নিয়ে মস্করা করেন, তাঁদের ব্যবহার্য অভ্র কিবোর্ডটা অবধি আর এক বাঙালি মুসলমানের দান।
তাই আমাদের কারোর সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। আমরা কতটা বাঙালি তার হিসাব দাখিল করার নেই। বাঙালি হতে গেলে আমাদের কী কী করতে হবে তা নিয়ে কোনো উপদেশ শোনার নেই। বরং প্রমিত বাংলায় আলাপরত এই সব সংখ্যালঘুবিদ্বেষীদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে হবে, বাংলা ভাষার জন্য তারা কী করেছে?
এবার আসি এই লেখার দ্বিতীয় পর্যায়ে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মসীহা বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এত কাছের এক বুদ্ধিজীবী হঠাৎ করে এরকম কথা বললেন কেন? এর উত্তর জানতে গেলে ইডি, সিবিআই, আয়কর দপ্তরের গল্পগুলো বুঝতে হবে। যখন সিবিআই অফিসাররা টেবিলের উল্টোদিকে বসে বছরের পর বছর ধরে চলা অপকর্মের ফাইল খোলে, তখন সামনে বসে থাকা লোকটার সামনে মোটে দুটো বিকল্প পড়ে থাকে – হয় আরএসএস যা বলবে তা অন্ধের মতো মেনে চলো, নয়ত জেলে পচো। তাই হিমন্ত বিশ্বশর্মা, কপিল মিশ্রের মতো ইফতারে টুপি পরে কলমা পড়া নেতাদেরও বিজেপি-আরএসএসের বিদ্বেষের রাজনীতির ক্যাডারে পরিণত হতে হয়। শুভাপ্রসন্ন তো শিশু। তাঁকে বিভাজনের রাজনীতির বোড়ে হিসাবে ব্যবহার করা কি আদৌ খুব কঠিন কাজ?
এখন প্রশ্ন হল, বিজেপি তো ইডি, সিবিআই ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে সাধারণত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিজেপিতে নিয়ে আসে। শুভাপ্রসন্ন তো নেতা নন, একজন শিল্পী মাত্র। তাঁর ক্ষেত্রে এমন ব্যাখ্যা কি অতিসরলীকরণ হয়ে গেল না?
এই ভাবনাতেও গলদ আছে। আমরা আরএসএসের বিরোধিতা করে চিৎকার করলেও এখনো তাদের এবং তাদের কার্যপদ্ধতিকে ঠিক করে চিনতে পারিনি। আরএসএস যত না রাজনৈতিক নেতা কেনে, তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিজীবী কেনে। সোশাল মিডিয়াকে প্রভাবিত করার মত লোকজনকে কেনে। তাদের ব্লগ, সাক্ষাৎকার, কবিতা, গল্প দিয়ে বিজেপির আখ্যান তৈরি হয়। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখবেন বিজেপির যত কর্মসূচি – সেটা গরুকে মা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাই হোক বা লাভ জিহাদ, জমি জিহাদ নামক উদ্ভট সব গপ্পো – সবকটার সূচনা কোনো না কোনো তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর কোনো না কোনো লেখা দিয়েই শুরু হয়েছে। আসলে তারা কেউ এরকম উদ্ভট কিছু লিখলেও তার প্রভাবশালী বৃত্তের জন্য আখ্যানটার বাজারে যথেষ্ট জমকালো আগমন হয়। শুরুতে আমরা কথাগুলো শুনে হাসাহাসি করি। যেমন দিলীপ ঘোষ যখন গোরুর দুধে সোনার কথা বলেছিলেন তখন হাসাহাসি করেছিলাম, অথচ বুঝতে চাইনি যে দিলীপ আদতে গরুর রাজনীতি, যা করে গোবলয়ে বিজেপি বিপুল সাফল্য পেয়েছে, তাকে পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে প্রয়োগ করছিলেন। ঠিক একইভাবে শুভাপ্রসন্নকে দিয়ে বিজেপির আসাম মডেলকে পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োগ করা শুরু হল গত ২১ তারিখ। মুখ্যমন্ত্রী পরে যা-ই বলুন, শিল্পীর ওই মন্তব্যের পর সর্বত্র বাঙালি মুসলমানদের ব্যবহৃত শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। এই ‘হাওয়া গরম’ করাটাই গেরুয়া শিবিরের লাভ।
কী সেই আসাম মডেল? সতেরো লাখ বাঙালিকে বেনাগরিক করা, যার মধ্যে ১৩ লাখ হিন্দু বাঙালি। ছিল নিজের দেশে বেনাগরিক হওয়ার যন্ত্রণায় শত শত বাঙালির আত্মহত্যা, শত শত শিশুর ভবিষ্যৎ ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকে অনিশ্চিত হয়ে পড়া। বিজেপি আসামে এই বিপুল বাঙালি মারণযজ্ঞ চালানোর আগে তারা তাদের পুরনো প্রভু ব্রিটিশদের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” বেছে নিয়েছিল। অসমিয়াদের হৃদয়ে বাঙালিদের জন্য বিপুল পরিমাণে ঘৃণা তৈরি করেছিল। ফলস্বরূপ চোখের সামনে এত লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া হতে দেখেও অসমিয়ারা প্রায় চুপ করেই ছিলেন। তাঁদের জমাট বাঁধা ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ফলপ্রসূ হওয়ায় অনেকে উল্লসিত হয়েছিলেন।
আরো পড়ুন হলোকস্ট অনুসারী কার্টুন দেখে বিরোধীরা কিছু বুঝছেন না?
সেই আসাম মডেলের দ্বিতীয় এবং উন্নততর সংস্করণটি বিজেপি এবং আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে প্রয়োগ করছে। এর মূল উদ্দেশ্য হল, বাঙালি হিন্দুকে, অর্থাৎ যে জনগোষ্ঠীর একটা অংশ এখনো বিজেপিকে বাঙালি সংস্কৃতির শত্রু মনে করে, তাদের বাঙালি মুসলমানদের থেকে আলাদা করে দেওয়া। যে কোনো প্রকারে বাঙালি হিন্দুর হৃদয়ে বাঙালি মুসলমানদের বাঙালিয়ানা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করা, যাতে পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের ৩০ শতাংশ বাঙালি মুসলমানকে উচ্ছেদ এবং সম্ভাব্য গণহত্যার রাজনীতি করা হলে, বাঙালি হিন্দু কোনো প্রতিবাদ না করে। বাঙালি হিন্দুর চেতনায় এত ঘৃণা ভরে দাও, যে চোখের সামনে তার বাঙালি মুসলমান ভাইদের গণহত্যা দেখেও যেন তাদের মনে হয় – এরা তো বাঙালিই নয়। এরা পানি বলে, আব্বা বলে, ফুফু বলে। তাই এদের যা হচ্ছে বেশ হচ্ছে। এই অপরীকরণের কাজ পুরোদমে চলছে। শুভাপ্রসন্ন যে মন্তব্য করেছেন এটা তার একটা বিশেষ প্রয়োগ মাত্র।
পৃথিবীর যে কোনো গণহত্যার ইতিহাস পড়ুন, দেখবেন একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। শুভাপ্রসন্ন শুধুমাত্র সংঘবাদীদের ব্যবহার করা এক বুদ্ধিজীবী বোড়ে, যাকে দিয়ে ওরা বাংলা এবং বাঙালিকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে ভাগ করতে চায়। বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের মুখের ভাষাকে সম্মুখসমরে দাঁড় করিয়ে দ্বিতীয় জনগোষ্ঠীটাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
সময় উপযোগী লেখা।
দাদা প্রশ্ন হলো এগুলোকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
আরএসএস যেভাবে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এদের থেকে সমাজকে বাঁচানো খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো বিরোধী দল নেই যাকে ভরসা করা যায় যে না এরা আরএসএস এর সাথে কোনো সমঝোতা করবে না।
জলের উপর পানি, না পানির উপর জল / বল খোদা, বল খোদা, বল।
চমৎকার লেখা , কিন্তু লেখক হিন্দুরাষ্ট্র বলছেন ভারতকে আর “শুভাপ্রসন্ন’রা (হিন্দুরা) আত্মত্যাগ
করে দেখান” বা “বাঙ্গালী হবার লড়াইয়ে ……”
এসব আবার কেমন কথা তার যৌক্তিকতা স্পষ্ট হলো না। উনি নিজেও তো হিন্দুবিদ্বেষ-এ ভুগছেন মনে হচ্ছে এজাতীয় কথার মাধ্যমে ।