গত শতাব্দীর নয়ের দশকে বামপন্থা ও বামপন্থীদের শুধু নয়, সমগ্র মানব ইতিহাসের ধারাকেই কবর দিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল অর্থনৈতিক উদারীকরণের দালালরা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমাজতন্ত্রকে এক বিস্মৃত স্বপ্ন মনে করে দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি পুঁজিবাদের কাছে নিজেদের কার্যত আত্মসমর্পণ করে। ঝাঁ চকচকে গাড়ি, শপিং মল, ফ্লাইওভার, জামাকাপড়ের চাকচিক্যে খানিক ফিকে হয়ে যায় বামপন্থীদের রুজিরুটির দাবিদাওয়া।

তারপর প্রায় সাড়ে তিন দশক কেটে গেছে। পৃথিবীর চাকা ঘুরেছে অনেক পাক, বদল করেছে দিক। আজ জনসাধারণের মনে পুঁজিবাদী সমাজ নিয়ে নীল স্বপ্নের মদ্য নেই, ভরসাও আগের চেয়ে অনেক ফিকে। মাঝে ঘটে গেছে যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সংকট, আরও যুদ্ধ, গণহত্যা, অতিমারী। সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বাড়লেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গরিব, বড়লোকের তফাত। ধর্ম, জাতপাত, লিঙ্গের ভিত্তিতে হিংসার ঘটনাও বেড়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে আগাছার মত ফ্যাসিবাদী সংগঠনের উত্থান ঘটেছে দেশে দেশে। সম্প্রতি মার্কিন পুঁজিবাদের প্রতিভূ আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের (আইএমএফ) ওয়েবসাইটে অ্যাঙ্গাস ডিটনের মত মূলধারার অর্থনীতিবিদ বাজারের আধিপত্যকে অস্বীকার করে অর্থনীতিবিদদের আরও নম্র হতে বলেছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

নয়ের দশকে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে একের পর এক ভাঙা হয়েছিল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপকার ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ, অর্থাৎ লেনিনের, মূর্তি। বারবার আক্রমণ হানা হয়েছে তাঁর আদর্শের উপর। তাঁর দেখানো পথে হাঁটা কমরেডদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। আজকের সংকটময় পরিস্থিতিতে তাঁর দেখানো পথেই নতুন করে আলো সঞ্চারিত হচ্ছে। দলে দলে মানুষ তাঁর প্রাণের লাল পতাকার তলায় আসছেন আবার। রুজিরুটি, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের দাবিতে। সেই মানুষের ভিড়ে প্রচুর ছাত্র, যুবর উপস্থিতি মনে বিশেষ আশা জোগায়। অভূতপূর্ব সমস্যায় জর্জরিত, দিগভ্রান্ত যুবকদের কাছে লেনিন হয়ে ওঠেন এক ধ্রুবতারা। রাশিয়ার আপামর যুব সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর বক্তৃতা আমাদের আজও অনুপ্রেরণা যোগায়।

২ অক্টোবর ১৯২০। নিখিল রুশ যুব কমিউনিস্ট লীগের সমাবেশে যখন লেনিন বলতে ওঠেন, তখন নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া নতুন এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের প্রায়-অসম্ভব কর্মযজ্ঞে লিপ্ত। চারিদিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করে এক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাদপর দেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন এবং তাতে যুব কমরেডদের কী কর্তব্য, তা লেনিন স্পষ্ট করে দেন ওই বক্তৃতায়। তাঁর মতে, ছাত্র-যুবদের মধ্যে নিহিত রয়েছে নতুন সমাজ গড়ার সৃজনশীল ক্ষমতা। কৃষক, শ্রমিকরা বড়জোর সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদের ঐতিহ্য বহনকারী পচাগলা সমাজকে শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ধ্বংস করতে পারবেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক এক সমাজকে গোড়া থেকে তৈরি করার দায়িত্ব ছাত্র-যুবদেরই। নতুন ভাবনা, নতুন চিন্তা, নতুন নীতি আদর্শে শিক্ষিত হয়ে নতুন সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রাম সংগঠিত করতে হবে তাঁদেরই। তার জন্য প্রয়োজন সমাজবাদী তত্ত্ব অধ্যয়ন।

বইপত্র পড়ার মধ্য দিয়ে সমাজবাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে গিয়ে যুব কমরেডদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, বিশেষ করে আজকের দিনে। লেনিন বলছেন, ‘পুরনো পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের জন্য সব থেকে খারাপ ও দুর্ভাগ্যজনক যা রেখে গেছে, তা হল বই এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে পরিপূর্ণ বিচ্ছেদ… …কাজ এবং সংগ্রাম ছাড়া বই ও পুস্তিকা থেকে আহূত সাম্যবাদ সম্পর্কিত পুঁথিগত বিদ্যা সম্পূর্ণ অকেজো, কেননা এটা সেই তত্ত্ব ও প্রয়োগের সেই পুরনো বিচ্ছিন্নতার পুনরাবৃত্তি, যা পুঁজিবাদী সমাজের সব থেকে ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য।’

এই বিচ্ছিন্নতার কারণেই যুবমানসে নানা ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আজকের যুগে মার্কসবাদকে শুধুমাত্র পড়াশোনার বিষয় করে তাকের উপর তুলে রাখার যে চেষ্টা চলছে, লেনিনের বক্তব্য তার পরিপন্থী। তিনি বারবার যুব কমরেডদের মনে করিয়ে দেন, মার্কসবাদ পৃথিবীর তামাম সর্বহারা মানুষের বিপ্লবী তত্ত্ব। তা শুধু এক স্লোগানসর্বস্ব মতাদর্শের বাণী সমাহার নয়, এক প্রয়োগমূলক বিশ্ববীক্ষা। লেনিনের কথায়, মার্কসের সাফল্য এই জায়গাতেই, যে ‘কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়কে অবজ্ঞা না করে মানবসমাজের দ্বারা যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, সে সমস্তকে তিনি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে পুনর্গঠিত করেছিলেন। মানুষের চিন্তাপ্রসূত সব সৃষ্টিকে তিনি পুনর্বিবেচনা করে দেখেছেন, সমালোচনার অঙ্গীভূত করেছেন এবং শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখেছেন।’ আজকের দিনে যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো মানুষকে অন্ধবিশ্বাস ও প্রশ্নহীন আনুগত্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, লেনিনের এই কথাগুলো আমাদের সকলের দিকনির্দেশ। শত প্রতিকূলতার মাঝে সদর্পে প্রশ্ন করে যাওয়ার সংকল্পের উত্তরাধিকার বহন করার গুরুদায়িত্ব যুবসমাজেরই।

যুবক যুবতীরা বামপন্থী রাজনীতিতে আসেন অনেক স্বপ্ন, অনেক বিশ্বাস, অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। যা কিছু সাবেকি, যা কিছু পুরনো, সবের বিরুদ্ধে থাকে তাঁদের তীব্র ঘৃণা। তৎক্ষণাৎ সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা সবসময় তাঁদের মধ্যে দেখা যায়। অনভিজ্ঞ কমরেডদের অভিভাবকের মত করে লেনিন বোঝান, দুনিয়া পাল্টানোর রাজনীতির পথ দীর্ঘ ও দুর্গম। তাই তাতে ধৈর্য আর প্রজ্ঞার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। পুরনো ব্যবস্থার যা ভাল, তা নিজেদের দরকারে ব্যবহার করেই নতুন সমাজ গড়ার নীল নকশা তৈরি করতে হবে। অথচ বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রবাহে গা ভাসালেও চলবে না। মনে রাখতে হবে, বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা স্থিতাবস্থাকে ধরে রাখার প্রশিক্ষণ দেয়। লেনিনের কথা ভীষণ প্রাসঙ্গিক – ‘আমাদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, আমাদের পুরনো শিক্ষাপদ্ধতি, পুরনো মুখস্থ বিদ্যা এবং পুরনো কড়া অনুশীলনের বদলে অর্জন করব সেই সামর্থ্য, যার দ্বারা মানুষের পাওয়া সমস্ত জ্ঞান অর্জন করা যাবে।’ অর্থাৎ পচাগলা পুঁজিবাদী শিক্ষার জায়গায় যথার্থ মানুষ তৈরি হওয়ার সাম্যবাদী শিক্ষাকে আপন করে নিতে হবে। সাম্যবাদী শিক্ষা আনে নম্রতা আর আত্মসমালোচনার মানসিকতা। মাটি থেকে দূরে থাকলে পুঁথিপড়া সাম্যবাদে দীক্ষিত কমরেড হয়ে যেতে পারেন দাম্ভিক। তাই ক্রমাগত অধ্যয়ন, আত্মতুষ্টিহীনতা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দীপ্র জেদের মধ্য দিয়েই নতুন সমাজ গড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

আরো পড়ুন রুশ বিপ্লবের একালের তাৎপর্য

যথার্থ সাম্যবাদী শিক্ষা লাভ করার সবচেয়ে ভাল উপায় কি? লেনিন বলেন, ‘যুব কমিউনিস্ট লীগ অবশ্যই তার শিক্ষা দীক্ষা এবং ট্রেনিংকে শ্রমিক-কৃষকের শ্রমের সঙ্গে যুক্ত করবে, যাতে না নিজেদের তারা বিদ্যালয়ের মধ্যে বা সাম্যবাদী পুস্তক-পুস্তিকা পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলে। কেবলমাত্র শ্রমিক-কৃষকের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার মধ্য দিয়েই একজন প্রকৃত সাম্যবাদী হতে পারে।’ কিন্তু প্রচণ্ড উদ্যম নিয়ে রাজনৈতিক কাজ করতে গিয়ে অনেকসময় প্রতিক্রিয়াশীল বিচ্যুতির ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন অনেক কমরেড। কারণ অধিকাংশ যুব কমরেড সামন্ততান্ত্রিক বা বুর্জোয়া নৈতিকতার গ্রাস থেকে বেরোতে অক্ষম হন। তাই সাম্যবাদী নৈতিকতার শিক্ষাও তাঁদের একান্ত জরুরি।

লেনিনের কথা এক্ষেত্রে চিরভাস্বর – ‘লোকে যখন নৈতিকতার কথা বলে আমরা বলি: শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল ও সচেতন গণসংগ্রামের মধ্যে সাম্যবাদীর সমস্ত নীতিবোধ নিহিত আছে। আমরা কোনো চিরন্তন নৈতিকতায় বিশ্বাস করি না এবং আমরা নীতিবোধ সম্বন্ধে সমস্ত মিথ্যা গালগল্পের মুখোশ খুলে দিই। মানবসমাজকে উন্নত স্তরে পৌঁছে দেওয়া, শ্রমিক-শোষণ থেকে মুক্ত করা – এই উদ্দেশ্যসাধনই করে নীতিজ্ঞান।’ ‘রাজনীতি খারাপ জিনিস’ যখন সর্বব্যাপী নৈতিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন সমস্ত কিছু শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করা এবং সব ফাঁপা মানবতাবাদী নৈতিকতাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলার উপদেশ মনে রাখা আশু প্রয়োজন। একমাত্র তাহলেই সমষ্টিগত স্বার্থকে নিজের চেয়েও বেশি প্রাধান্য দিয়ে এক শোষণহীন সমাজ গড়ার কাজে লেগে পড়া সম্ভব।

কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের একগুঁয়ে এক ছাত্র যখন সব হুমকি, সব ভয়, সব দুর্ভাবনা তুচ্ছ করে নতুন সমাজ গড়ার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন, তখন খেটে খাওয়া মানুষের একজোট হওয়া, জারতন্ত্রের অবসান ঘটানো ছিল চিন্তার অতীত। আজও সেই এক পরিস্থিতি। দিকে দিকে বামপন্থীরা ভীষণ দুর্বল, পুঁজিবাদ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দুর্নিবার, পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির দ্বারা মার্কসবাদ আক্রান্ত। সামগ্রিক নৈরাশ্যবাদ ও সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞের অভাব যখন যুবসমাজের মধ্যে আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসছে, তখন শরণ নিতে হয় কাজানের সেই ছাত্রটির, যিনি সারাজীবন শিখে যাওয়াকেই সমাজবাদী বিপ্লবীর প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতেন। তিনি আগামী প্রজন্মের হাতে চিন্তার দৈন্য মেটানোর দায়িত্ব, আরও বেঁধে বেঁধে থাকার দায়িত্ব সঁপে গেছেন। আজ তাঁর জন্মদিন। মৃত্যুর ১০০ বছর পরেও তিনি বাঁধের পর বাঁধ ভেঙে চলেন। দিয়ে যান স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানটুকুতে সেতু বানানোর শিক্ষা।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.