ভারতীয় ভাষা মানচিত্রে হিন্দি ও উর্দুর সীমানা খুব স্পষ্ট তো নয়ই, কেজো প্রয়োগে দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান নির্ণয় করাও সহজ নয়। যাঁরা সাধারণত কানে শুনে হিন্দি শিখেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়া, তাঁদের তথাকথিত হিন্দি বোলি থেকে উর্দুটুকু ছেঁকে নিলে ভাষার কঙ্কাল কতটা অক্ষত থাকবে তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ আছে। যেহেতু প্রমিত হিন্দি এবং উর্দুর দ্বৈরথ ভাষাতাত্ত্বিক নয়, রাজনৈতিক, অতএব পারস্পরিক বোধগম্যতার যুক্তি ধোপে টেকে না। বিষয়টি খুব নতুন কিছু নয়। ফলে আগাম জানিয়ে রাখা ভালো যে এ নিবন্ধ চর্বিত চর্বন দোষে দুষ্ট। এ দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতর্কের পরিসরে যেহেতু ঘড়ির কাঁটা আপাতত উল্টো ঘুরছে, রোমন্থন প্রাসঙ্গিক হলেও হতে পারে।
উর্দুর সঙ্গে উপমহাদেশের মুসলমান জনসমাজের ঐতিহাসিক সম্পর্কটি একরৈখিক নয় আদৌ। তুর্কি শব্দ উর্দুর বুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে কোনো ভাষারই সরাসরি যোগ নেই। মুসলমান জনসমাজের বড় অংশ যে উর্দুকে মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেন না সে কথা অন্তত বাংলাভাষীকে মনে করিয়ে দেওয়া বোধহয় জরুরি নয়। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস বঙ্গসমাজে বহুচর্চিত। হিন্দি-উর্দু দ্বৈরথের যে রাজনৈতিক কুরুক্ষেত্রে রক্তপাত অব্যাহত সেই উত্তর ভারত এবং অধুনা পাকিস্তানেও উর্দু শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হত সৈন্য শিবির অর্থে। দীর্ঘকাল সুলতানি ও মোগল আমলের রাজধানী শহর দিল্লির ডাকনাম উর্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল কোনো কারণে। শামসুর রহমান ফারুকির দাবি মানলে শাহজাহানাবাদ ওরফে দিল্লিতে যে কথ্য খারি বোলি চালু ছিল তাকে জ়বান-এ-উর্দু বলার মূল কারণ রাজধানীর বাসিন্দাদের আলাপচারিতায় ওই কথ্য জ়বান-এ-উর্দুর প্রাবল্য। উর্দু বাজার বলতে কোনো ভাষার বাজার বোঝানো হত না, রাজধানী দিল্লির মূল বাজার এলাকাটিকেই চিহ্নিত করা হত। এ ভাষার সঙ্গে বৃহত্তর ইসলামি দুনিয়ার খুব সুসম্পর্ক ছিল না। ইরানের ফার্সি কবিরা ‘সবক-ই-হিন্দি’ বা ভারতীয় শৈলীকে যে বেশ কুনজরে দেখতেন তার নমুনা আমির খুসরোকে নিয়ে শিবলি নুমানির (১৮৫৭-১৯১৪) আলোচনায় পাওয়া যায়। ফার্সি কাব্যতত্ত্বের কালজয়ী গ্রন্থ শের-উল-আজমে শিবলি খুসরোর ভূয়সী প্রশংসা করার পাশাপাশি মনে করিয়ে দিচ্ছেন খুসরো এমন বহু শব্দ তৈরি ও প্রয়োগ করেছেন, বহু বাগধারা ব্যবহার করেছেন যা মূল ফার্সি কবিদের রচনায় পাওয়া যায় না এবং এই কারণে কোনো কোনো সমালোচক মনে করেন খুসরোর মতো মহাকবিরও পদস্খলন ঘটেছে সবক-ই-হিন্দির পাল্লায় পড়ে। লক্ষণীয় খুসরোর একনিষ্ঠ ভক্ত শিবলি নুমানি কিন্তু কোনো পাল্টা যুক্তি পেশ করছেন না। একবারও বলছেন না খুসরোর ভাষা ও শৈলীর স্বাতন্ত্র্য তাঁর দুর্বলতা নয়। শুচিবায়ুগ্রস্ত সাংস্কৃতিক পণ্ডিত খুঁজতে অবশ্য অতদূরের পুঁথিপত্র পেড়ে বসার দরকার নেই। উর্দু ও ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের স্বনামধন্য পণ্ডিত, একনিষ্ঠ গবেষক স্বয়ং ফারুকিসাহেব ইলাহাবাদে উর্দু ও ফার্সি সাহিত্যের ইতিহাস সংক্রান্ত একটি সেমিনারে উক্ত সমালোচকদের জনৈকের দর্শন পেয়েছিলেন বলে নিজমুখে স্বীকার করেছেন। তাঁর নিজের বক্তৃতাটি শেষ করে শামসুর রহমান ফারুকি তখন প্রশ্নোত্তর পর্বে। হেনকালে এক ফার্সি পণ্ডিত প্রশ্ন ছুঁড়লেন, আপনি যে দেহাত শব্দটি গ্রাম অর্থে ব্যবহার করলেন, একবারও তো বললেন না শব্দটি বহুবচনেই প্রয়োগ করা যায়? ফার্সি শব্দ দেহ হল গ্রাম এবং –আত বহুবচন নির্দেশ করছে। অতএব একবচনে দেহাত শব্দের প্রয়োগ ভ্রান্ত। বক্তা যে ফার্সিতে বক্তৃতা করছিলেন না, উর্দু বলছিলেন এবং মান্য উর্দুতে দেহাতের প্রয়োগ একবচনে সিদ্ধ সে যুক্তি, বলাই বাহুল্য, ফার্সিবাদীর মনে ধরেনি। তাঁকে দোষ দেওয়া বিবেচকের কাজ নয়। সাথের বদলে সঙ্গে লেখার নিদান দিয়ে শহর কলকাতায় আজও পোস্টার পড়ে। বাতিক আমাদের প্রজাতিধর্ম।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
যা হোক, উর্দু তাহলে মুসলমান সমাজের আত্মপরিচয়ের চিহ্ন হিসেবে তেমন কার্যকরী নয়। তবু উর্দুর লিপিটি যে ফার্সি থেকে ধার করা তা তো অস্বীকার করা যায় না। প্রচলিত উর্দুতে ফার্সির ঋণকৃত শব্দ ভাণ্ডারও নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। ফার্সি না হোক, ফার্সির একরকমের অপভ্রংশ হিসেবে উর্দুকে পড়া যেতে পারে কি? প্রথমত, ভাষা ও লিপির কোনো জৈব যোগাযোগ নেই আদৌ। ভাষাতাত্ত্বিক, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ধ্বনিতাত্ত্বিক, তাঁর কাজের জায়গায় পৃথিবীর সব ভাষাকেই International Phonetic Alphabet বা IPA-তে লিখে থাকেন। ভাষা ও লিপির প্রত্যক্ষ যোগাযোগের যুক্তি মেনে নিলে বাংলা, স্প্যানিশ এবং মান্দারিন চাইনিজকে একই ভাষা বলে নিশ্চিন্তে দেগে দেওয়া যায়। কোঙ্কণী বা সিন্ধির মতো পৃথিবীময় বহু ভাষাই একাধিক লিপিতে লেখা হয়। সন্দেহ থাকলে রোমানে লেখা বাংলা ভাষা পড়তে পাঠক নিজের হোয়াটসঅ্যাপের সাহায্য নিতে পারেন। উর্দুর ব্যাকরণ যে ফার্সি বা আরবির থেকে শৌরসেনী অপভ্রংশের অনেক কাছাকাছি (বচনের তফাতের একটি ছোট উদাহরণ আগেই পেশ করেছি) সে কথা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অত্যন্ত স্পষ্ট করে দেখিয়েছিলেন উর্দু কবি ও বৈয়াকরণ ইনশা আল্লা খান তাঁর দরিয়া-এ-লতাফৎ (উর্দু ভাষার প্রামাণ্য ব্যাকরণ) গ্রন্থে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো ইনশার জন্ম ও বেড়ে ওঠা অধুনা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। কিন্তু কথা তো হচ্ছিল সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে। ভাষার তাত্ত্বিক কাটাছেঁড়ার আড়াল নিয়ে কি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছি? উর্দু সাহিত্যে মুসলমান সমাজের বিপুল অবদান কি অবহেলা করা যায়? সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিক থেকে উর্দু আর মুসলমানের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ অস্বীকার করব কী যুক্তিতে?
ভাষার সাংস্কৃতিক ইতিহাস দিয়ে তার জাত বিচার করতে বসলে হিন্দির খুব সুবিধে হবে কি? আগেই বলেছি ভাষা নাম হিসেবে উর্দু শব্দটির জন্ম হয়নি। যে জ়বান-এ-উর্দু কালক্রমে উর্দু নামটিতে থিতু হল, সেই মূল জ়বানটির নাম কি ছিল? গোটা উত্তর ভারতের কথ্য ভাষাকে দুটি নামে ডাকা হত – হিন্দি ও রেখতা – দুটি ভিন্ন ভাষা নয়, একই ভাষার মৌখিক রূপটি মোটামুটি সপ্তদশ শতক অবধি হিন্দভী এবং পরবর্তীকালে হিন্দি বলে পরিচিত হয় এবং লিখিত রূপটিকে কোথাও কোথাও রেখতা বলে উল্লেখ করা হয়। হিন্দভীর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কেন্দ্রে ফার্সি কবি ও দার্শনিক আমির খুসরোর উপস্থিতি নিয়ে ঘোর শুদ্ধতাবাদীকেও সংশয় প্রকাশ করতে দেখিনি কখনো। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি এডওয়র্ড টেরি (A Voyage to East India: Edward Terry) লক্ষ্য করছেন এই কথ্য হিন্দি বা হিন্দুস্থানিতে আরবি এবং ফার্সি ঋণকৃত শব্দের প্রাচুর্য। উত্তর ভারতের হিন্দি বা রেখতা বা দেহলভী হোক কিংবা দক্ষিণের দকনি – আরবি ও ফার্সিভাঙা শব্দের প্রাচুর্য সর্বত্রই চোখে পড়ার মতো। নাম ভিন্ন, ভাষা নয়। মুশাফির দিওয়ানে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকেও দেখতে পাচ্ছি, “ফার্সির মায়া ভোলো কবি, আজ হিন্দির যুগ”। মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম শুধু হিন্দি জানতেন তা-ই নয়, হিন্দিতে তাঁর সাহিত্যচর্চার নিদর্শন দুর্লভ নয়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি প্রখ্যাত উর্দু ও ফার্সি ভাষাবিদ সিরাজ-উদ্দিন আলি খান-এ-আরজু উর্দু বলতে বোঝাচ্ছেন শহর দিল্লি আর ভাষা? বলার প্রয়োজন নেই বোধ হয়। খান-এ-আরজুর কালজয়ী উর্দু অভিধানকে স্বয়ং রচয়িতা উর্দু ভাষার অভিধান বলে দাবি করেননি। উর্দু নামক কোনো ভাষা তাঁর জানা ছিল না। দিল্লির হিন্দি বোলিতে ফার্সি প্রভাব সম্ভবত অন্যান্য কথ্যরূপগুলির চেয়ে কিছু বেশি ছিল। দরবারের সরকারি ভাষা ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকেও ছিল ফার্সি। রাজধানীর ভাষায় সরকারি প্রভাব কিঞ্চিৎ বেশি হওয়া নিতান্ত অস্বাভাবিক নয়। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেই বোধ হয় প্রথম ভাষার নাম হিসেবে উর্দু শব্দটি চালু হয়। তবে তখনও উর্দু ও হিন্দি দুটি নামে একটি ভাষাকেই বোঝানো হত। উনিশ শতকের আগে স্বতন্ত্র উর্দু ভাষার অস্তিত্বের তেমন কোনো নিদর্শন পণ্ডিতদের চোখে পড়েনি বলেই জানি। উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ ও ষোড়শ শতক থেকে কায়স্থদের লেখালিখি বাদ দিলে সেকালের যেটুকু লিখিত হিন্দি সাহিত্য পাওয়া যায় তার হরফ সেমিটিক। একমাত্র ব্রাহ্মণ দেবনাগরী হরফ ব্যবহার করতেন। কায়স্থকুল নাগরীর অন্য একটি লিপি নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিলেন – কৈঠি বলে পরিচিত সে হরফ সম্পর্কে এ অধমের বিশেষ কিছু জানা নেই।
তাহলে সিদ্ধান্ত কী দাঁড়াল? উর্দু ও হিন্দি দুটোই মুসলমানের ভাষা?
যে কোনো ভাষাই মূলত একটি চিহ্নতন্ত্র। চিহ্নতন্ত্রের মূল কাজ ভাষ্যকে ধারণ করা – ভাষা ভাষ্যের ধারক এবং আধার, সে নিজে কোনো নির্দিষ্ট ভাষ্যের প্রতিনিধি নয়। চিহ্ন ভাসমান। রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিরপেক্ষ। ইতিহাসের যে আঁচড় তার গায়ে পড়ে তাতে সে রূপ বদলায় না তা নয়, তবে সে বদল বর্গপরিচয়ের দাসত্ব করে না। সাম্রাজ্যবাদীর ইংরেজি ভাষাতেই লিখে ফেলা যায় The Empire Writes Back অথবা কোনো নগুগি ওয়া থিওংওর কলমে Decolonising the Mind – যোগ্য অনুবাদকের হাত ধরে তারা অনায়াসে পাড়ি জমায় ভাষান্তরে। সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে যে হিন্দি-উর্দু বিভেদ প্রকল্প চালু করে তাতে হিন্দি বা উর্দু অংশগ্রহণ করেনি কোনোদিনই। নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ভাষ্যের ভাষাকে পোষ মানানোর চেষ্টা কতকটা চেয়ারে বসে চেয়ার তোলার চেষ্টার মতো। যে ফার্সি পণ্ডিত উর্দুকে নেহাতই ফার্সির অশুদ্ধ রূপ বলে ধরে নেন তিনি বিশ্বাস করছেন কোনো চিহ্নতন্ত্রের পক্ষে অন্য চিহ্নতন্ত্রকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শ্রী কমলাকান্ত তাঁকে মনে করিয়ে দেবেন, গরু কার? যে দুধ খায় তার।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।