৮ই নভেম্বর ২০২১। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে প্রশান্ত পাত্র নামে একজন বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এই খবর নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বিশেষ কাটাছেঁড়া না হলেও, দেশের বিচারব্যবস্থা এবং জেল পরিকাঠামো নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন উস্কে দেয় এই ঘটনা। ২০১০ সালে, শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে আক্রমণের অভিযোগে পুলিশ প্রশান্ত পাত্রকে গ্রেফতার করে। তারপর থেকে ১১ বছর, বিচারাধীন প্রশান্ত।
আজকালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে১, জেলের মধ্যে তাকে আলাদাভাবে রাখা হয়েছিল এবং সেখানেই গামছার ফাঁস গলায় জড়িয়ে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তবে শেষ পর্যন্ত রক্ষীদের চোখে পড়ে যাওয়ায় প্রাণে বাঁচে। পরে তাকে এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
প্রশান্তের এই আত্মহত্যার চেষ্টাকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীনতা’র পাঁচিল তুলে আড়াল করতে চাইলেও,দেশের বিচারব্যবস্থার এবং জেল পরিকাঠামোর বেহাল দশা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তথ্য ঘাঁটলে এই আলোচনারভিত আরো শক্ত হবে।২ গত তিন বছরে ভারতে কারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা ৫,২২১। যার মধ্যে জেল হেফাজতে মৃত্যু উত্তরপ্রদেশে সর্বোচ্চ — ১২৫৯। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু গুজরাটে সর্বোচ্চ — ৪২। সব মিলিয়ে ২০২০-২১ সালেকারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা ১৯৪০। যা ২০১৯-২০২০ সালে ছিল ১৬৯৬ এবং ২০১৮-২০১৯ সালে ১৯৩৩। অতএব, এই তথ্য স্পষ্ট করে দেয়, দেশে কারাগারে মৃত্যুর গ্রাফ ঠিক কোনদিকে পা বাড়িয়েছে।
ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর শেষ দশ বছরের যে তথ্য সামনে এসেছে তা ভয়াবহ৩। এনসিআরবি অনুযায়ী গত দশ বছরে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ১,০০৪। যার মধ্যে ৪০ শতাংশের স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও, ২৯ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হিসাবে আত্মহত্যার কথাই উঠে আসছে।৪ দ্য ল্যান্সেট সাইকিয়াট্রিস্ট জার্নাল ২০০০ থেকে ২০১৯ অবধি ভারতের কারাগারে আত্মহত্যা নিয়ে একটা সমীক্ষা করে। সেখান থেকে জানা যায়, এই ২০ বছরে কারাগারে আত্মহত্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০১ সালে যা১২.১২/১০০,০০০ জন ছিল, ২০১৯ সালে সেটা গিয়ে ঠেকেছে ২৪.২৩/১০০,০০০ জনে।
এখন কারাগারে এই বিপুল পরিমাণ আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গেলে, বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। ভারতের জেলে বন্দিদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রায় ৭০% বন্দি বিচারাধীন। অর্থাৎ এই যে বন্দিরা কারাগারে থাকাকালীন মারা যাচ্ছে, অথবা আত্মহত্যা করছে, এদের মধ্যে অধিকাংশই বিচারের সুযোগ পায়নি। দ্য ওয়ায়ারের একটি প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এই বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে ৫৫% দলিত, আদিবাসী এবং মুসলমান।৫ অর্থাৎ সমাজের সবথেকে পিছিয়ে থাকা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ।
এই বিচারাধীন বন্দিদের সংখ্যা ৭০% ছুঁয়ে ফেলায়, জেলে অতিরিক্ত ভিড় অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বন্দিদের একে অপরের সাথে লাগাতার ঝুটঝামেলা হয়, যা কখনো কখনো খুনখারাপির দিকেও চলে যায়। এই সমস্ত কারণে বন্দিদের মানসিক স্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। বহু বন্দি ছোটখাটো মামলায় গ্রেফতার হয়েও বিনা বিচারে বছরের পর বছর জেল খাটতে বাধ্য হয়। জেলের এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং বিচারের আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষায় হতাশার বাঁধ ভাঙে। ফল উপরিলিখিত আত্মহত্যার তথ্য।
দেশে করোনার ধাক্কা এখনও সামলে ওঠা যায়নি। জেল ব্যবস্থাকেও যে মহামারি আরও খারাপের দিকেই ঠেলবে তা বলাই বাহুল্য। জেলে বাড়তি বন্দি থাকায় যেখানে ১০,০০০ বন্দিকে রাখবার ব্যবস্থা, সেখানে ১৬,০০০ বা ১৭,০০০ বন্দি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিগুলিকে নির্দেশ দেয়৬, প্রয়োজনে কোনো কোনো বন্দিকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। কার্যক্ষেত্রে ছবিটা বদলায়নি। দেখা যায় জেলের মধ্যে রক্ষী থেকে শুরু করে বহু বন্দি করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় বন্দি ভারভারা রাও, হানি বাবু, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ, আসামের গণআন্দোলনের কর্মী অখিল গোগোইরাও আক্রান্ত হয়েছেন। দেশজুড়ে বিভিন্ন মহল থেকে তাদের মুক্তির দাবি উঠছে। তবু জেল কর্তৃপক্ষকে কোনোরকম পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
করোনাকালে আরও বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে জেলের মহিলা বন্দিরা। বয়স্ক মহিলা বন্দি, যাদের কো-মর্বিডিটি রয়েছে অথবা গর্ভবতী মহিলা বা সন্তানকে নিয়ে জেলে বন্দি মহিলাদের পক্ষে করোনা জীবনমরণ সমস্যায় পরিণত হতে পারে। তাই তাদের জামিন মঞ্জুর না করা, জেল কর্তৃপক্ষের মানবিক চরিত্র সম্বন্ধে মস্ত বড় প্রশ্নচিহ্ন খাড়া করে।
অন্যদিকে এই অতিমারী জেলের নিয়মকানুনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। শুরু থেকেই বন্দিদের বাড়িরলোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগ রাখতে না পারার ফলে বন্দিদের মানসিক চাপ যে আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। এই আবহে, এমনিতেই বিলম্বিত বিচারব্যবস্থা যখন তার গতি আরও কমিয়ে ফেলে, তখন বিশৃঙ্খলা অবধারিত। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল দমদম সেন্ট্রাল জেলে।৭ বিচারাধীন বন্দিরা জেল কর্মী এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন বাড়ির লোকের সাথে দেখা করতে না দেওয়ায়, আদালতে পেশ না করায় তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই সংঘাতে পুলিশের গুলিতে একজন বন্দি প্রাণ হারায়, ২৮ জন গুরুতর আহত হয়, বহু জেলকর্মী এবং পুলিশও আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
উপরিলিখিত প্রতিটি তথ্যই আসলে প্রমাণ করে, জেল পরিকাঠামোর বেহাল দশা, চরম অব্যবস্থা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিচারব্যবস্থার কঙ্কালসার রূপ, শেষপর্যন্ত বন্দিদের মানসিক ভারসাম্য হারানো এবং আত্মহত্যার মত পদক্ষেপের দায় এড়াতে পারে না।
২০১৫ সালের মডেল প্রিজন ম্যানুয়াল অনুসারে প্রতিটি পুরুষ বন্দির একদিনে ২,৩২০ কিলো ক্যালরি থেকে ২,৭৩০ কিলো ক্যালরি পর্যন্ত পুষ্টির প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতিটি মহিলা বন্দির প্রতিদিন ১,৯০০ কিলো ক্যালরি থেকে ২,৮৩০ কিলো ক্যালরি পুষ্টির প্রয়োজন। অথচ ২০১৫সালের তথ্য অনুযায়ী সরকার বন্দি পিছু, প্রতিদিন খাবারের খরচ হিসাবে বরাদ্দ করেছে ৫২.৪২ টাকা। তবে এনসিআরবির ২০১৫ সালের রিপোর্ট বলছে, দিল্লি, গোয়া, মহারাষ্ট্র এবং গুজরাট সরকা বন্দি পিছু প্রতিদিন খরচ করে মাত্র, ৩১.৩১ টাকা, ৩২.৮৩ টাকা, ৩৪.২২ টাকা এবং ৩৫.৩৮ টাকা৮।
সংশোধনাগার নাম দিলেও, সংশোধনের পথ যে খোলা নেই তা জেলের প্রচলিত শাস্তিগুলিকে কাটাছেঁড়া করলেই টের পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি এলগার পরিষদ মামলায় অভিযুক্ত গৌতম নওলাখাকে ‘আন্ডা সেল’-এ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালোজা জেল কর্তৃপক্ষ।৯ আন্ডা সেল কী?
যখন কোনো বন্দিকে জেল কর্তৃপক্ষ বা সরকারপক্ষবেশি বিপজ্জনক মনে করে, তখন তাকে এই বিশেষ নিরাপত্তায় ঘেরা সেলটিতে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে আজমল কসবকে এই আন্ডা সেলে রাখা হয়েছিল। এই সেল অন্যান্য ব্যারাকগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে যে বন্দির ঠাঁই হয়, তার ক্যান্টিন, গ্রন্থাগার কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই। অন্যান্য বন্দিদের সাথে মেলামেশা, কথা বলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ জরির কাপড় জড়িয়ে, নাম বদলে, একপ্রকার সলিটারি কনফাইনমেন্ট। যতরকমভাবে সম্ভব অভিযুক্তকে বিচ্ছিন্ন করা, কোণঠাসা করা। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বিশেষ রাপোর্টিয়ার নিলস মেলজার, সলিটারি কনফাইনমেন্ট বিষয়ে জানান১০, কোন বন্দিকে দীর্ঘদিন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখবার ফলে তাদের কেবল মানসিক নয়, নানারকম শারীরিক সমস্যাও দেখা দেয়। উদ্বেগ, মানসিক চাপ, অবসাদ বন্দিদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক ব্যাধির জন্ম দেয়, যা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে।
কথায় আছে, যে কোনো দেশের কারাব্যবস্থা আসলে সেই দেশেরই প্রতিচ্ছবি। এ ক্ষেত্রেও ভেবে দেখলে হয়ত মিল পাব। কারাগারে প্রচলিত এই সমস্ত শাস্তি আসলে আর কোথাও না, সমাজ থেকেই ধার করা। কাউকে ভাঙতে কোণঠাসা করবার বা বিচ্ছিন্ন করবার রীতি বহু পুরনো। উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানদের কোণঠাসা করার রীতি, উচ্চবর্ণ এলাকায় দলিতদের কোণঠাসা করার রীতি, ঋতুস্রাবের সময়পুজোপার্বণ থেকে মহিলাদের বিচ্ছিন্ন করার রীতি। তবে জেলের ভিতরে এই কোণঠাসা করার রীতি আরো চার গুণ ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়। তার কারণ এমনিতেই জেল পরিকাঠামো জরাজীর্ণ, তার উপর বাইরে যতটুকু নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ থাকে, তাও জেলের চার দেওয়ালের মধ্যেঅসম্ভব। জেলে প্রচলিত প্রতিটি শাস্তি বা অত্যাচারই আসলে অভিযুক্তকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙেফেলার, তাকে সম্পূর্ণ একাকিত্বে ডুবিয়ে দেওয়ার ছক। ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ইলেক্ট্রিক শক, বরফের চাঁইয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা শুইয়েরাখা, রাতের বিশ্রাম বাতিল করে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাওয়ার মত একাধিক অমানুষিক অত্যাচার ভারতের কারাগারে নিত্য দিন ঘটে চলেছে।১১ ফলে হতাশা, একাকিত্বে ভেঙে পড়া বন্দিদের গামছায় ফাঁস লাগানো ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।
তথ্যসূত্র:
১) https://aajkaal.in/news/kolkata/prisoner-attempts-to-commit-suicide-in-presidency-jail-gwtl
৪। https://www.thelancet.com/journals/lanpsy/article/PIIS2215-0366(21)00233-9/fulltext
৫। https://thewire.in/uncategorised/india-prison-conditions
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।