এই এক মজার খেলা। ভূমিকন্যাপুত্রদের দেখলেই গ্রেপ্তার করে নাও, তাদের মাওবাদী কমিউনিস্ট দেগে দিয়ে হরেক রকম মামলা সাজাও, তারপর লকআপে প্রচণ্ড নির্যাতন করো। গণআন্দোলনের কর্মীরা প্রতিবাদ করবে, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি আর মানবাধিকার কমিটি বিরুদ্ধতা জ্ঞাপন করবে, রাষ্ট্র মুচকি হাসবে। হয় বছরের পর বছর সাজানো মামলা টেনে টেনে আদিবাসী মানুষকে দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে জাঁতাকলে পেষা যাবে, নয়ত ভুয়ো এনকাউন্টার করে “ওরা মাওবাদী ছিল” বলে সাংবাদিক সম্মেলন করা যাবে। আমরা যারা ওই ভূমিপুত্রকন্যাদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বহুদূরে বসে নিরপেক্ষতার জল মাপছি, তারা বিতর্কসভা বসাব, ওঁরা সত্যিই মাওবাদী/নকশাল ছিলেন, নাকি ‘স্যান্ডউইচ’ হওয়া নিরীহ গ্রামবাসী ছিলেন? নাকি সবটাই নিয়তির দায়? এই মজার খেলাটি চলছে বহু দশক ধরে। হ্যাঁ আমরা, অর্থাৎ নিরপেক্ষরাও, এই খেলার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ঘুঁটি।
গত ২রা নভেম্বর সুকমা জেলার মোরাপল্লি গ্রাম থেকে ৫৫জন নারী-পুরুষ-শিশুকে গ্রেপ্তার করে আধাসেনা-পুলিশ। ‘এরিয়া ডমিনেশন প্রোগ্রাম’ চলাকালীন গ্রামে তল্লাশি চালিয়ে ডিটোনেটর, জিলেটিন স্টিক, আইইডি, ব্যাটারি ইত্যাদি উদ্ধার করা গেছে বলে পুলিশ ও সেনার দাবি। পঞ্চান্ন জনকে চিন্তালনার থানায় আটক করার পরে এঁদের মধ্যে আট জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন ও ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করা হয়। সুকমার এসপির দাবি অনুযায়ী, এই আটজন মাওবাদী। এঁদের গ্রেপ্তারির নাকি অর্থমূল্য ধার্য করেছিল প্রশাসন। বহু চেষ্টায় কোবরা এঁদের গ্রেপ্তার করে। সমাজকর্মী বেলা ভাটিয়া প্রথম এঁদের গ্রেপ্তারির খবর প্রকাশ্যে আনেন এবং নিরপরাধ আদিবাসী জনতার ওপরে মিথ্যে মামলা চাপানোর অভিযোগে সরব হন। বেলা ভাটিয়া এ-ও দাবি করেন, যে পরে ছেড়ে দেওয়া ৪৭ জনের মধ্যে একজন মহিলা নিখোঁজ। বেলা পুলিশ-সেনার দাবি উড়িয়ে দিয়ে আটক ও গ্রেপ্তার হওয়া গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়ান। ওইদিন গ্রামবাসীরা সিলগের গ্রামে সেনা ক্যাম্প বসানোর বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদসভায় অংশ নিয়েছিলেন। সেই প্রতিবাদ মিছিল সেরে ফেরার পথে দেড়শো পুলিশ-সেনার একটি দল মোরাপল্লি গ্রামবাসীদের তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু এ কি কোনো নতুন ঘটনা? আশ্চর্য বিষয়? না। যে সিলগের গ্রামে সেনা ক্যাম্প বসানোর বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা সোচ্চার হয়েছেন এবং নিজেদের অধিকারের প্রশ্ন তুলেছেন, সেই সিলগের গ্রামেই এই বছরের মে মাসে পুলিশ-সেনা নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ছত্তিশগড়ের ক্ষমতায় রয়েছে ‘লেসার ইভিল’ কংগ্রেস। বিজেপি হোক বা কংগ্রেস, আদিবাসী ভূমিপুত্রকন্যাদের দুর্গতি কিছু কমতি হয় না। কমিউনিস্টদের দমনের নামে কখনও ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ কখনও ‘অপারেশন সমাধান’ কিংবা ইউপিএ সরকারের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘সালবা জুড়ম’ — রাষ্ট্রের অমানবিক রাজনীতি জনতার বিরুদ্ধেই প্রযুক্ত হয়। আর সেনা ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা গ্রামবাসীদের কাছে স্বস্তি বা শান্তির নয়, বরং আতঙ্কের। নাকা-চেকিং করার নামে ভূমিকন্যাদের স্তন পরীক্ষা করা কিংবা ভূমিপুত্রদের শারীরিক নির্যাতন করা বাস্তার, সুকমাসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কমিউনিস্ট পার্টির জনতানা সরকারকে উৎখাত করার জন্যে ভারত রাষ্ট্রের নিরন্তর প্রচেষ্টা — সেনা ক্যাম্প, ইউএপিএ, গ্রামবাসীদের গ্রেপ্তারি, ভুয়ো এনকাউন্টার বা আদিবাসী শ্রমজীবীদের নিরস্ত্র মিছিলে গুলিচালনা এই প্রচেষ্টার অঙ্গ। সুকমা জেলায় বিভিন্ন গ্রামে সেনা-পুলিশের ক্যাম্প বসানোর বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার গ্রামবাসী এক প্রতিবাদসভায় জড়ো হয়েছিলেন। যথারীতি পুলিশ ও প্রশাসন গ্রামবাসীদেরই দায়ী করেছেন গ্রামবাসীদের মৃত্যুর জন্যে। তাঁরাই নাকি অশান্তি বাধিয়ে তুলেছিলেন সরকারি নির্দেশ অমান্য করে। ফলে গুলি চালাতে বাধ্য হয় পুলিশ। ‘দণ্ডকারণ্য আদিবাসী কিষাণ মজুর সংগঠনের’ তিনজন সদস্য জমায়েত স্থলে মারা যান, আহত হন দুশোরও বেশি গ্রামবাসী। “The camp opened on May 12, despite opposition mounting against it from the beginning. As the camp opened, villagers were coming in everyday in huge numbers to protest against the increased militarisation and the consequent repression. Attempts were being made to disperse the crowds; water was being used, stones were being thrown on them, they were being tear-gassed as well. However, the tribals did not give up. Throughout the protests, over 200 people have been injured, several are also languishing in Sukma jail”১
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সোনি সরি, কমল শুক্লা, বেলা ভাটিয়া এবং অন্যান্য স্থানীয় সমাজকর্মীরা এই ঘটনার নিন্দা করার পাশাপাশি পুলিশি যুক্তির বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেন। পুলিশ মাওবাদীদের ধরতে এসে ৩,০০০ গ্রামবাসীর উপর গুলি চালাতে ‘বাধ্য’ হয়েছে — এমন হাস্যকর পুলিশি-যুক্তির ভিত্তিহীনতা যে কেউই বুঝতে পারবেন। বিজেপি বা কংগ্রেসের মতো শাসক শুধু বুঝতে পারে না। যে সমস্ত সাংবাদিক বাস্তারের খবর করেন, তাঁরাও কেউ সাম্প্রতিক অতীতে এমন কোনো ঘটনা মনে করতে পারছেন না, যেখানে এত মানুষের জমায়েতের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ ও সেনা। ২০১২ সালে বীজাপুরে গণহত্যার কথা পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। সেই একই ছক, একই রকম সাজানো সংঘর্ষ এবং আদিবাসী ভূমিকন্যাপুত্রদের হত্যা করে মাওবাদী ঘোষণা করে দেওয়া। সাত বছর পরে আদালতের রায়ে প্রমাণ হয়েছে যে সেটি ঠাণ্ডা মাথায় সাজানো একটি গণহত্যা ছিল২। যে কোনও সার্চ ইঞ্জিনে ‘সুকমা আদিবাসী অ্যারেস্টেড’ বা ‘বাস্তার আদিবাসী কিলিং’ কি-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করলে এরকম প্রচুর ঘটনা আর খবরের লিঙ্ক বেরোবে। সেই লিঙ্কে ক্লিক করলেই দেখা যায় গ্রামবাসীদের গ্রেপ্তারি বা হত্যা করা রাষ্ট্রের ‘বাঁয়ে হাত কা খেল’! ২০২০ সালের অক্টোবরে বিজাপুর, দান্তেওয়াড়া সহ অন্যান্য জেলায় আটটি নতুন সিকিউরিটি ক্যাম্প তৈরির বিরুদ্ধে স্থানীয় গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ অব্যাহত। গাঙ্গালুর এলাকার আদিবাসী মানুষ নিয়মিত প্রতিবাদসভার আয়োজন করেন এবং থানায় বা উচ্চ দপ্তরে প্রতিবাদপত্র জমা দেন। বিজাপুরে এমনই এক সভা চলাকালীন প্রায় ৪০০০ গ্রামবাসীর উপর অতর্কিতে হামলা করে পুলিশ-সেনা, দ্বিশতাধিক মানুষ আহত হন এবং ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৩।
দোসরা নভেম্বরের ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে দু-তিনদিন সময় লেগেছে, রাষ্ট্রের ঘেরাটোপ আর নজরবন্দী পেরিয়ে মানবাধিকার কর্মীদের আরও সময় লেগেছে গ্রামবাসীদের কাছে পৌঁছতে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী জানে, এই সময়টুকু ভূমিপুত্রকন্যাদের পিষে ফেলার জন্যে ও আরও মানসিক, শারীরিক নির্যাতনের জন্যে আদর্শ সময়। এগুলো রুটিনমাফিক, এবং এই শাসন পদ্ধতির প্রতিরোধ করতে করতেই বহু দশক অতিক্রান্ত করেছেন তাঁরা।
নিহত গ্রামবাসীদের ‘মাওবাদী কমিউনিস্ট’ তকমা দিয়ে কিংবা গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ‘কমিউনিস্ট নকশাল’ তকমা দিয়ে কি এই সমস্ত হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনকে বৈধতা দেওয়া যায়? সরকার নিশ্চয়ই জানে, যায় না। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে বসে থাকা আমাদের মনে সংশয় তৈরি করে দেওয়া যায়। রাষ্ট্র জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে দিতে চায়, যে কমিউনিস্টদের ইউএপিএ দেওয়া যায়, যখন তখন লকআপে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা যায় কিংবা মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলেই তাকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা যায়, তাদের স্তনদুগ্ধ পরীক্ষা করা যায়।
কমিউনিস্টদের মানবাধিকার কম, কমিউনিস্টদের মেরে ফেললে রাষ্ট্রের সুরক্ষা হয় — এই কথাগুলো রাষ্ট্র গেঁথে দিতে চায় আমাদের মাথায়। মানবাধিকারের ন্যূনতম শর্তগুলো পুলিশ-সেনা প্রায়ই লঙ্ঘন করে এবং ফলাও করে তাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। আর সিংহভাগ সংবাদমাধ্যম এইসব খবর ছাপে না, দেখায় না। রাষ্ট্র এই পদ্ধতিগুলোর অনুশীলন করে দমনমূলক আধিপত্য বাড়িয়ে নিতে চায়, প্রয়োজনে গণতন্ত্রের শর্তগুলো নাকচ করে রাজনৈতিক পরিসরকে আতঙ্কিত করে রাখতে চায়। রাষ্ট্র কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারে না, কর্তাদের ভয় কিছুতেই যায় না। বিরুদ্ধতা আর দ্রোহের ভয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি নীতি ও কৌশলে এত অন্যায় থাকে, রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এত বৈষম্য ও জবরদস্তি থাকে এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোতে এত বেশি উচ্ছেদ-অন্যত্র স্থাপনকারী-উচ্চবর্গতোষী রক্ত লেগে থাকে যে রাষ্ট্র কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারে না দ্রোহসম্ভাবনা সম্পর্কে। কলামঞ্চের শিল্পীরা ইউএপিএ ধারায় জেলে চলে যান, কিষাণ-মজুর সংগঠনের উপর গুলি চলে এবং জল-জমি-জঙ্গল ছিনিয়ে নিতে নতুন নতুন আইন প্রণীত হয়। ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর রাশিয়ার সশস্ত্র বলশেভিকরা শ্রমিক-কৃষকের আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করেছিলেন। অনেক ঝড়ঝাপটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে এবং অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্য মানবাধিকার অর্জন করেছিলেন তাঁরা। এই ১০৪ বছরে দুনিয়ায় প্রচুর বদল এসেছে, অনেক তত্ত্ব পুনর্নিমিত বিনির্মিত হয়েছে, অনুশীলনের ধারায় বদল হয়েছে অনেক। কিন্তু বদলায়নি শোষক রাষ্ট্রের জনগণকে শোষণ করার ধারা। বদলায়নি কমিউনিস্টদের প্রতি শাসক শ্রেণির আক্রোশ। আর নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাও অবিকল। নভেম্বর বিপ্লবকে ‘মহান’ বলে যাঁরা মনে করেন, অন্তত তাঁদের কাছে যেন শাসকের আক্রোশ আর শাসিতের প্রতিরোধ সম ওজনের না হয়ে যায়। নিরপেক্ষতার ভানে ভূমিকন্যাপুত্রদের উপরে সংঘটিত রাষ্ট্রীয় নির্যাতনকে ঘৃণা ছুঁড়ে দিতে যেন ভুলে না যাই।
তথ্যসূত্র
[১] নিউজক্লিক, ২০শে মে ২০২১
[২] “The Chhattisgarh Police killed 17 persons in cold blood in a staged gunfight at Sarkeguda in Bijapur district on June 28, 2012 and passed it as elimination of Maoists, as per the report of Justice Vijay Kumar Agarwal judicial probe, submitted a month ago after seven years of hearing and investigation, and leaked on Sunday.” — ইন্ডিয়া টুডে, ৩রা ডিসেম্বর, ২০১৯
[৩] নিউজক্লিক, ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২০
~মতামত লেখকের ব্যক্তিগত।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।