খেলা হবে রাজ্য জুড়েই। কিন্তু ‘মেগা ম্যাচ’ একটি কেন্দ্রেই। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারীর দ্বৈরথ ঘিরে ক্রমশ চড়ছে পারদ। এক দিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা অবিসংবাদিত জননেত্রী মমতা। অন্যদিকে জমি আন্দোলনের ‘নায়ক’ শুভেন্দু, যাঁকে রাজনীতির কারবারিদের কেউ কেউ বলতেন, মমতার পর তৃণমূলের একমাত্র জনভিত্তিসম্পন্ন নেতা। এমন সম্মুখসমর কি এর আগে কখনো দেখেছেন এই রাজ্যের মানুষ? সাম্প্রতিক অতীতে কিন্তু নজির নেই। দুজনেই ঝুঁকি নিয়েছেন। দুজনেই জানেন এই নির্বাচনে হেরে গেলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই নন্দীগ্রামের লড়াই অন্য মাত্রা দিয়েছে একুশের বিধানসভা নির্বাচনকে। সেই আবহেই ব্যাটলগ্রাউন্ড নন্দীগ্রাম ঘুরে দেখল নাগরিক ডট নেট (www.nagorik.net)।
এই প্রতিবেদন লেখার কয়েক ঘণ্টা আগেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, আগামী সোমবার থেকে ফের প্রচারে নামবেন মমতা। হুইল চেয়ারে বসে সভা করবেন ঝাড়গ্রামে। তার আগে ১৪ই মার্চ, নন্দীগ্রামের ‘শহীদ দিবসে’ কালীঘাটে প্রকাশ করবেন দলীয় ইস্তেহার। কিন্তু যে ঘটনাকে নিয়ে গত কয়েকদিন কার্যত তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি, তাকে ঠিক কীভাবে দেখছেন নন্দীগ্রামের মানুষ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহত হওয়া ঠিক কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে নন্দীগ্রামের নির্বাচনে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম নন্দীগ্রামের ১ এবং ২ নম্বর ব্লকের বিভিন্ন এলাকার।
মমতার আহত হওয়ার ঘটনা এবং সে সম্পর্কে তৃণমূলের প্রচার নিয়ে কার্যত আড়াআড়ি বিভক্ত নন্দীগ্রামের মানুষ। সোনাচূড়ার বিমল মণ্ডল আগে তৃণমূল করতেন। জমি রক্ষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে মার খেয়েছেন পুলিশের। শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি কার্যত বসে গিয়েছেন, কোনো দলই করেন না৷ তাঁর কথায়, “আমরা দিদি এবং শুভেন্দুবাবু — দুজনকেই ভালবাসতাম। কিন্তু এখন যা শুরু হয়েছে, এই কাদা ছোড়াছুড়ি আর ভাল লাগে না। আর মিছিল মিটিঙে যাই না।” এর পরেই তাঁর সংযোজন, “তবে দিদি ঐ কথাটা না বললেই পারতেন। উনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আমাদের এখানে লড়তে এসেছেন, আমরা গর্বিত। কেন কেউ ধাক্কা মারতে যাবে? তার উপর এতজন সিকিউরিটি! দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলাই ভাল। নন্দীগ্রামের মানুষের নাম খারাপ করা ঠিক নয়।”
বিমলবাবু একা নন। নন্দীগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে এমন মতামতই কানে এল বেশি৷ অন্য রকম যে কেউ বলছেন না, তা নয়। তবে সংখ্যায় কম। সামসাবাদ বা কেন্দাবাড়ির মতো মুসলিম প্রধান এলাকায় শুভেন্দু বিরোধিতা তীব্র। কেন্দাবাড়ির রমজান শেখ বললেন, “দিদিকে মারার চেষ্টা করে বিজেপি নন্দীগ্রামের নাম ডুবিয়েছে। গোটা দেশে নন্দীগ্রামের বদনাম হয়ে গেল। এর জবাব শুভেন্দু ভোটে পাবে। বেইমানকে নন্দীগ্রাম জেতাবে না।”
নন্দীগ্রামের দুটি ব্লক। মমতা দুই ব্লকেই একটি করে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। তার একটি বড়তলা এলাকায় প্রাক্তন সেনাকর্মী ফারুক আহমেদের বাড়ি। পাড়ায় মুখ্যমন্ত্রীর থাকাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশীদের উৎসাহ তীব্র। কিন্তু তাতেও বাদ সাধছে ‘ষড়যন্ত্র’ তত্ত্ব। ফারুক আহমেদের বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে বছর আঠাশের মৃগেন মাইতির মন্তব্য,  “নন্দীগ্রামবাসী হিসাবে খারাপ লেগেছে৷ একটা দুর্ঘটনাকে ষড়যন্ত্র না বললেই উনি পারতেন।” একই কথা শোনা গেল রেয়াপাড়ার অমূল্য সাহার গলায়, “গোটা রাজ্যে হয়তো ওঁর লাভ হবে৷ কিন্তু এই ঘটনায় নন্দীগ্রামে দিদির ভোট কমবে।”

বস্তুত, নন্দীগ্রাম চষে মনে হল, বিজেপির পাতা ফাঁদেই পা দিচ্ছেন মমতা। ভোট প্রচারে বেরিয়ে সর্বত্র ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিঁধছেন শুভেন্দু। প্রতিটি সভায়, রোড শো-তে তাঁর আক্রমণের বর্শামুখ ‘তোলাবাজ ভাইপো’। কিন্তু নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর মুখে অভিষেকের নাম কম। বরং মমতার বিরুদ্ধে তাঁর জোড়া হাতিয়ার : বহিরাগত তকমা এবং সরাসরি বিভাজনের রাজনীতি। রাজ্যের প্রাক্তন পরিবহনমন্ত্রী নন্দীগ্রামে যে ভাষায় সাম্প্রদায়িক তাস খেলছেন, বাংলার রাজনীতিতে তার নজির কার্যত নেই৷ এত স্পষ্ট, সরাসরি, বেআব্রু সাম্প্রদায়িক আক্রমণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই পর্যায়ের কোন নেতার মুখে শোনা যায়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, শুভেন্দুর লাগাতার সাম্প্রদায়িক আক্রমণের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যতই অস্বস্তিতে পড়ছেন। তিনিও নিজেকে ‘আসল হিন্দু’ বলে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা করছেন। এতে সুবিধা হয়ে যাচ্ছে বিজেপির। মমতার মতো বিপুল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না বুঝে এমনটা করছেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত, নন্দীগ্রামের রণাঙ্গনে বিজেপির চক্রব্যূহে আটকা পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির মাঠে খেলতে হচ্ছে তাঁকে। খেলতে হচ্ছে বিজেপির নিয়ম মেনে। ফলে হাসি চওড়া হচ্ছে শুভেন্দুর।
নন্দীগ্রাম নিয়ে বিজেপি সাম্প্রদায়িক তাস খেলতে শুরু করেছিল অনেকদিন আগে। তখনো শুভেন্দুর নাম প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা হয়নি। তেখালির জনসভায় মমতা নন্দীগ্রাম আসনে লড়ার কথা জানাতেই শুভেন্দু মন্তব্য করেন, “ওঁকে ৫০ হাজার ভোটে হারাব। উনি ৬২ হাজারের ভরসায় লড়ছেন। আমি লড়ব ২ লক্ষ ১৩ হাজারের ভরসায়।” স্পষ্ট, সরাসরি, ভনিতাহীন সাম্প্রদায়িক মন্তব্য৷ নন্দীগ্রামে মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ৬২ *হাজার*, হিন্দু ভোটার ২ লক্ষ ১৩ হাজার। এরপর শুভেন্দু আরও বলেন, “ওঁর ওই ৬২ হাজারেও আমি সিঁধ কাটব। আর এই ২ লক্ষ ১৩ হাজার, যাঁরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলেন, তাঁদের অধিকাংশের সমর্থন আমি পাব।”
এই শুরু। এরপর থেকে প্রতিদিন প্রচারে এসে সাম্প্রদায়িক সুর চড়িয়েছেন জমি আন্দোলনের ‘নায়ক’। কখনো তৃণমূলের মুসলিম কর্মীদের ‘জেহাদি’ বলেছেন, কখনো বলেছেন, “মা-বোনেরা জাগুন, প্রস্তুত হন। উনি (মমতা) যদি জেতেন, তাহলে সরস্বতীপুজো বন্ধ করে দেবেন। উনি জেহাদিদের ফুফু আর সন্ত্রাসবাদীদের আপা।” শুভেন্দুর এ এক নতুন অবতার। যতদিন তৃণমূলে ছিলেন, এই চেহারা সামনে আনেননি। নন্দীগ্রামের এক বিজেপি নেতার কথায়, “দাদা হিন্দু ভোটকে একজোট করতে লড়ছেন। উনি জানেন যদি সংখ্যাগুরু ভোট জোটবদ্ধ হয়, তাহলে কোন শক্তি হারাতে পারবে না।”
এই প্রচারে কি কাজ হচ্ছে? নিশ্চিত উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে নন্দীগ্রাম ঘুরে মনে হল, হচ্ছে। হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ জোটবদ্ধ হচ্ছে। এমনিতেও নন্দীগ্রামে আরএসএস এবং হিন্দু সংহতির কাজ দীর্ঘদিনের। বড় সংখ্যায় মুসলিম জনসংখ্যা থাকার ফলে হিন্দু সংগঠনগুলির কমবেশি সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। সেই জনভিত্তির একটা বড় অংশ জোট বাঁধছে গেরুয়া পতাকার নীচে। এই নতুন সমীকরণ এক অন্য নন্দীগ্রামের৷ এই নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের গর্ভগৃহ নয়, বরং বিজেপির ‘মিশন বেঙ্গল’-এর গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবোরেটরি। এই শুভেন্দুর সঙ্গেও ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির শুভেন্দুকে মেলানো কঠিন।
দুঃখের হলেও সত্যি, মমতা এই মাঠেই খেলতে নেমেছেন। নিজেকে বার বার ‘সাচ্চা হিন্দু’ প্রমাণের চেষ্টা করছেন তিনি। নন্দীগ্রামের জনসভায় বার বার তাঁর মুখে শোনা গিয়েছে বাড়ির কালীপুজোর কথা৷ বক্তৃতার শুরুতে  বলেছেন, “ওর ৭০-৩০ ভাগাভাগি করতে চাইছে। করতে দেবেন না।“ কিন্তু তারপরেই চণ্ডীপাঠ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। বার বার থমকে গিয়েছেন, থেমে গিয়েছেন, ভুলে গিয়েছেন মন্ত্র। মমতা এমনিতে অনন্যসাধারণ বক্তা। ভিড়ের সঙ্গে কমিউনিকেট করার এক আশ্চর্য দক্ষতার অধিকারী৷ তিনি মঞ্চে প্রায়শই ‘ভুল’ বলেন। কিন্তু সেই ভুলগুলো শেষ পর্যন্ত গুরুত্বহীন হয়ে যায়। কারণ তিনি মমতা। তিনি জানেন কী করে বার্তা  পৌঁছে দিতে হয়। কিন্তু ২০২১ সালের নন্দীগ্রামের রণাঙ্গন বোধহয়  অনেকটাই আলাদা। মমতার চণ্ডীপাঠের রেকর্ডিং পরের দিন রোড শো-তে বাজিয়ে শুনিয়েছেন শুভেন্দু। সেই সঙ্গে বাজিয়েছেন প্রকৃত চণ্ডীপাঠ৷ মমতার প্রতিটি ‘ভুলে’ মঞ্চে হেসে গড়িয়ে পড়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে হেসেছে সভায় হাজির হাজার জনতা। মমতার ‘ভুল’ তাঁকে ‘ভেজাল হিন্দু’ হিসাবে তুলে ধরেছে। শুভেন্দু গর্জন করে উঠেছেন, “উনি চণ্ডীপাঠ করতে পারেন না। ভুল মন্ত্র বলেন। ওঁকে ভোট দিলে হিন্দুদের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে।” সেই আস্ফালন পেয়েছে জনতার সোচ্চার সমর্থন। মমতার প্রতিটি পদক্ষেপকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করছে বিজেপি। দুপুরে জনসভায় চণ্ডীপাঠের পর সন্ধ্যায় একটি *মসজিদে* গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে তাঁর উপাসনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে নন্দীগ্রামের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে। সঙ্গে প্রচার, ‘উনি জেহাদিদের সমর্থক। ভণ্ড হিন্দু। ওঁকে ভোট নয়।’

মমতাকে হারাতে শুভেন্দুর আর এক হাতিয়ার বহিরাগত ইস্যু। মমতার ভাড়াবাড়ির বাইরে পোস্টার পড়েছে, ‘বহিরাগত নয়, নন্দীগ্রামে চাই মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র’। এই ইস্যুতেও বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন মমতা। উপেক্ষা করার পরিবর্তে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনসভায় দাঁড়িয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, তিনি ‘বহিরাগত’ নন। বলছেন, “বহিরাগত হলে কি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতাম?” নিজেকে ‘গ্রামের মেয়ে’ বলে দাবি করছেন। জনতার কাছে অনুমতি চাইছেন ভোটে লড়ার, বলছেন, “আপনারাই বলুন আমি বহিরাগত কিনা। যদি বহিরাগত মনে করেন, তাহলে লড়ব না। চলে যাব।” রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, জননেত্রীর নিজের কথাতেই স্পষ্ট হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব। মমতা বলছেন, “আমি তো ভবানীপুরেই লড়তে পারতাম। আমায় ভাবতেই হত না৷ আমি এখানে লড়তে এসেছি নন্দীগ্রামকে ভালবাসি বলে, সম্মান করি বলে।” বক্তৃতার এই অংশের ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে যাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে। সঙ্গে নিঃশব্দ প্রচার, ‘উনি নিজেই বলছেন নন্দীগ্রামে লড়তে ওঁকে ‘ভাবতে’ হচ্ছে..’
নন্দীগ্রাম ২ নম্বর ব্লকে দৃশ্যতই এগিয়ে বিজেপি। এখানে মুসলিম ভোট ১৪-১৫ শতাংশ। নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকে টক্কর সেয়ানে সেয়ানে। এখানে বুথের সংখ্যাও অনেক বেশি৷ এই ব্লকে মুসলিম ভোটের পরিমাণও প্রায় ৪০ শতাংশ। এই ভোটের কত শতাংশ মমতা পাবেন, তা নিয়ে আগ্রহ তুঙ্গে। এবং এই প্রসঙ্গে পিছন থেকে প্রবলভাবে আলোচনায় উঠে আসছে সংযুক্ত মোর্চা। প্রথমে ঠিক ছিল সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে নন্দীগ্রাম আসনে লড়বে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। এই খবরে কপালের ভাঁজ গভীর হয়েছিল তৃণমূল নেতৃত্বের। অঙ্কটা ছিল এই রকম, আইএসএফ যদি মুসলিম ভোটের ১০ শতাংশ কেটে নেয়, তাহলে মমতার পরাজয় নিশ্চিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আসনে লড়ছেন সিপিএমের মীনাক্ষি মুখার্জি। নিশ্চিতভাবেই তিনি বহিরাগত। নিশ্চিতভাবেই তিনি ফেভারিট নন। এবং, একইসঙ্গে, তাঁর হাতে রয়েছে নন্দীগ্রামের অনেক ধাঁধার উত্তর।
২০১৬ সালেও নন্দীগ্রাম বিধানসভায় বামফ্রন্টের সিপিআই প্রার্থী পেয়েছিলেন প্রায় ২৭ শতাংশ ভোট। যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা তা এক ধাক্কায় অনেকখানি কমে গিয়েছিল, বিপুল ভোট বাড়িয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ডিওয়াইএফআই নেত্রী মীনাক্ষী প্রার্থী হতেই চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন বাম কর্মীরা। চলছে বাড়ি বাড়ি প্রচার। বিজেপি, তৃণমূলকে এক যোগে বিঁধে মীনাক্ষী দলবদলের রাজনীতিকে তুলো ধোনা করছেন। বিজেপির আদি নেতাদের একাংশে আশঙ্কা, তৃণমূল বিরোধী যে ভোট তাঁরা ২০১৯ সালের লোকসভায় পেয়েছিলেন, তার একটা অংশ পাবেন মীনাক্ষী৷ আবার শুভেন্দু বিরোধী ভোটের একটা অংশও তাঁদের থেকে সরে বামপন্থীদের দিকে যাবে৷ যদিও শুভেন্দুর কল্যাণে তৃণমূলের একটা বিরাট ভোট এবার স্বাভাবিকভাবেই পদ্মফুলে আসবে।
রেয়াপাড়া পেরিয়ে কিছুটা এগোতেই দেখা গেল তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি মেঘনাদ পালের পাশে বসে রয়েছেন নন্দীগ্রাম বিধানসভায় বিজেপির কো-কনভেনর দেবাংশু মাইতি। শুভেন্দুর হাত ধরে মেঘনাদ এখন বিজেপিতে। টেঙ্গুয়া মোড়ের পার্টি অফিসে বসে মেঘনাদ বললেন, “আমরা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মুসলিম প্রধান অঞ্চলে প্রচারে বাধা দিচ্ছে। ফোনে তো বটেই, সরাসরিও হুমকি দিচ্ছে।” মেঘনাদের দাবি, তাঁর কাছে পিকের টিমের লোকজন এসেছিলেন। তাঁরা তৃণমূলে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিজেপি নেতা প্রলয় পালের দাবি, কেন্দাবাড়ি, দাদপুর, সামসাবাদসহ বেশি কিছু মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ভয়-ভীতির পরিবেশ রয়েছে। একশো শতাংশ সংখ্যালঘু অঞ্চলে বিজেপি কর্মীরা কাজ করতে পারছে না। তবে জয় নিয়ে কোন সংশয় নেই তাঁর। প্রলয় বলেন, “তৃণমূলে থাকলেও শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে অনেকেরই যোগাযোগ রয়েছে। নন্দীগ্রামের ৬০ শতাংশ তৃণমূল নেতৃত্ব আমাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাঁরা বিজেপিতে আসার জন্য এক পা বাড়িয়ে রয়েছেন।”

ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিতে তৃণমূলের দুজন প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁদের একজন শেখ সুফিয়ান এবার মমতার নির্বাচনী এজেন্ট। উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে এই শেখ সুফিয়ানেরই প্রাসাদোপম বাড়ি দেখে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সুফিয়ান বললেন, “মমতাদি যেখানেই লড়বেন, সেখানেই জিতবেন। আমরা এক লক্ষ ভোটে হারাব শুভেন্দুবাবুকে।” ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আর এক নেতা আবু তাহের। নন্দীগ্রামের রাজনীতিতে তিনি সুফিয়ানের ‘বিরোধী’ বলেই পরিচিত। কয়েক মাস আগেও ‘শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে পরিচিত তাহের কিন্তু দল বদল করেননি। তাঁর কথায়, “বেইমানি করতে পারব না। যতদিন দলে ছিলেন, শুভেন্দুদার সঙ্গে ছিলাম। এখন আর কোন সম্পর্ক নেই।”
তাহেরের সঙ্গে হয়ত সত্যিই সম্পর্ক নেই বিজেপির। কিন্তু কতজন নেতা যে তলায় তলায় শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তা জানেন না তৃণমূল নেতৃত্বও। অবিশ্বাস আর সন্দেহের গুমোট বাতাবরণ একটু খেয়াল করলেই নজরে আসে। কিন্তু তা বলে কি বিজেপির জয় নিশ্চিত? একেবারেই নয়। গেরুয়া শিবিরেও তীব্র নতুন বনাম পুরনোর বিবাদ। পুরনো কর্মীরা অনেকেই শুভেন্দু অনুগামীদের নেতৃত্ব মানতে নারাজ। অথচ তাঁদের বাদ দিয়ে কেবল নিজের মেশিনারির ভরসায় লড়তে ভরসা পাচ্ছেন না শুভেন্দুও। তাই চলছে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা। শুভেন্দু চাইছেন গোটা নির্বাচনের কেন্দ্রীয় ইস্যু হোক দুটো — বহিরাগত এবং বিভাজন। মমতাকে তিনি টেনেও আনতে পেরেছেন এই দুই মাঠে৷ ফলে দৃশ্যত কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন কাঁথির শান্তিকুঞ্জের বাসিন্দা। কিন্তু প্রতিপক্ষের নাম যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভবত নিজের জীবনের কঠিনতম লড়াইয়ে সবটুকু উজাড় করে দিচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী৷ অনুজ প্রতিম প্রাক্তন সহকর্মীকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বেন না তিনি।
মমতা জানেন, তিনি নন্দীগ্রামের চক্রব্যূহে প্রবেশ করেছেন। স্বেচ্ছায়। ব্যূহ ভেদ হবে কিনা, তার উত্তর দেবে দোসরা মে।
নন্দীগ্রামে ২০২১ রাজ্য নির্বাচনী লড়াই – চিত্র নিজস্ব।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।