সম্বিত পাল
একটি মিথ্যে কখনও অন্য একটি সত্যিকে মিথ্যে করে দিতে পারে না। বাক্যটি শুনতে জটিল লাগছে নিশ্চয়ই। স্বাভাবিক। এভাবেই রাজনৈতিক নেতারা একটি মন্তব্য করে পুরো বিতর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। জল ঘোলা করে দিতে পারেন। আপনি, আমি সেই ঘোলা জলে খাবি খেয়ে মরব, আর রাজনীতির কারবারিরা সেই ঘোলা জলে মাছ ধরে নিয়ে চলে যাবেন।
পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি যখন আমাদের চোখের সামনে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হচ্ছে এবং সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এতদিনে রাজ্যবাসীকে জাগিয়ে তুলছে বলে মনে হচ্ছে, তখন টাটাকে সিঙ্গুর থেকে মমতা না সিপিএম – কে তাড়িয়েছিল সেই বিতর্ক অবান্তর মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক হয়ত নয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ইতিহাস একটি বৃত্তের মত ঘুরে ফিরে আসে। সেই ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হয়। সবাইকে। তা সে অর্থনৈতিক মন্দা হোক বা ফ্যাসিবাদ, বিশ্বযুদ্ধ হোক বা পরমাণু বোমা। এ দেশের জরুরি অবস্থা হোক বা স্বৈরাচারের মত ‘গণতান্ত্রিক শাসন’ কিংবা জনআন্দোলন। শিক্ষা নিলে তবেই ঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যায় সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার। তাই ইতিহাসকে কোনো পক্ষই অস্বীকার করতে পারে না।
সুতরাং “সিঙ্গুর থেকে টাটাকে সিপিএম তাড়িয়েছিল” — মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যকে মিথ্যাচার বলে তাকে ঘিরে বিতর্কে গোটা ইতিহাস মিথ্যে হয়ে যায় না। এই ঘোলা জলে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কত সৎ ছিলেন, তিনি ন্যানো গাড়ির কারখানা নিয়ে কত বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন, কত কর্মসংস্থানের চেষ্টা করেছিলেন এবং সর্বোপরি কৃষকদের থেকে জোর করে জমি নিয়ে টাটাদের সিঙ্গুর কারখানা তৈরি করার সিদ্ধান্ত কত সঠিক ছিল ইত্যাদি ভেসে বেড়াচ্ছে।
গত বছর নির্বাচনের সময়ে নন্দীগ্রামে গিয়ে ২০০৭ সালে “বাপ-ব্যাটার অনুমতি ছাড়া নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকতে পারত না” বলে একইরকম বিতর্ক তৈরি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনো অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা কতটা ঠিক ছিল, মায় পুলিশের গুলি চালনা কেন জরুরি ছিল তাই নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ঝড় তুলতে।
আর সবার উপরে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তো হাতে গরম তৈরিই আছে। শুধুমাত্র ষড়যন্ত্রের উপর ভর করে ৩৪ বছরের একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করল বিরোধী দল!
সোজা কথাটা আবার সোজা করে বলা দরকার। সদিচ্ছা থাকলেও প্রক্রিয়াগতভাবে যে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পায়ন করার প্রচেষ্টা ভুল ছিল, সেটা সিঙ্গুর প্রসঙ্গে আবার মনে করা দরকার।
যে রাজনৈতিক প্রশাসক সিঙ্গুর কাণ্ডে নিজের দল-কর্মী-সমর্থকদের বোঝাতে পারলেন না, জমি অধিগ্রহণ কেন দরকার, জমিহারাদের তার বিকল্প কী দেওয়া হচ্ছে, তা কতটা গ্রহণযোগ্য, (টাটার অফিসাররা যেদিন সিঙ্গুরে ঝাঁটার তাড়া খেয়ে ফিরে এলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই সেই দিনটি এবং তার পরে জ্যোতি বসুর মন্তব্য), যিনি নন্দীগ্রামে কেন কেমিক্যাল হাব করা দরকার এবং তার জন্য কোন জমি নেওয়া হবে সেটাই ঠিক করে গ্রামবাসীদের বোঝাতে অসমর্থ হলেন এবং রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে দিলেন পুরো এলাকাকে — তাঁর সদিচ্ছা যতই থাক, নেতৃত্বে গলদ ছিল, সেটাও আবার বলা দরকার।
নেতা ভাল, কিন্তু দল খারাপ — এই তত্ত্ব শুনতে ভাল লাগলেও তা আসলে যে নেতার নেতৃত্বগুণকে খাটো করে তা অনেকেই বোঝেন না।
কিন্তু ওই যে, ইতিহাসকে একেবারে অস্বীকার করলে তো সমস্যা হবেই। এ নিয়ে কারো মনে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই যে, ২০১১ সাল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ। শুধুমাত্র সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম একটি সরকারকে ফেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল কি? এই দুটি আন্দোলন তো শুধু সলতেয় আগুন দিয়েছিল। বাম শাসনে সলতে পাকানোর কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছিল তা মনে করানোও জরুরি।
তখন “আমরা ২৩৫, ওরা ৩০”-এর দম্ভ, নন্দীগ্রামে ‘লক্ষ্মণরাজ’, বিনয় কোঙারের পশ্চাদ্দেশ-মন্তব্য, বৃন্দা কারাতের “দমদম দাওয়াই”, “সূর্যোদয়ের” আলোয় “দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন”, অনুজ পাণ্ডের প্রাসাদোপম বাড়ি লোকাল কমিটির ‘প্রতাপের’ জমানা।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ একদিনে ঠিক করে নেননি যে তাঁরা সরকার বদল করে দেবেন। মমতা-বিপদ জেনে বুঝেও অনেকে সেদিন বামেদের বিরুদ্ধে ভোটটি দিয়েছিলেন। তখন তিনিই গরীব চাষী-ক্ষেতমজুর, ছাত্র-যুব, মহিলাদের ত্রাতা। অন্তত রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ তাই মনে করেছিলেন।
আরো পড়ুন মমতা ও পশ্চিমবঙ্গ: মাঝির হাতেই নৌকাডুবি?
কারণ পশ্চিমবঙ্গ তখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যেখানে বামমনস্ক মানুষও রাস্তায় নামছেন কোনো পতাকা ছাড়া বাম সরকারের বিরুদ্ধে। বিকল্প নেই, বিকল্প নেই করতে করতে একটি বিকল্প চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। খারাপ-ভালর চিন্তা দুরে সরিয়ে তাই রাজ্যের জনগণ মমতাকেই ভোট দিয়েছিলেন। পরিবর্তন চেয়ে। তৎকালীন বাম নেতৃত্ব তাঁর মোকাবিলা করতে পারেননি। এটাই সাদা কথা। পুরোটাই ষড়যন্ত্র বলে দাগিয়ে দিলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়।
এবার আসি, এই বিতর্ক এখন অবান্তর মনে হলেও কেন প্রাসঙ্গিক। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতির ছবি, বিশেষ করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উদ্ধারের ছবি, আন্দোলনরত শিক্ষকদের অসহায়তার ছবি, জোর করে আন্দোলনকারীদের পুলিস ভ্যানে তোলার ছবি আমাদের চোখের সামনে দেখছি, এগুলো কী পশ্চিমবঙ্গকে আরেকটি সন্ধিক্ষণে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে? নাকি ‘শ্রী’ মোহ আর উৎসবের আবহে সবটাই ভুলে যাবে জনগণ?
এটাও মনে রাখা দরকার, নির্বাচন কিন্তু একটি টি-২০ খেলা। যতই নেট প্র্যাকটিস হোক, ভোটের দিনেই বুথ রক্ষা করা, সমর্থকদের মনে সাহস জুগিয়ে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা, নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা — এসব নিশ্চিত করতে হয়। অনুব্রত মণ্ডল তো জেলবন্দি। কোনো বিরোধী দল বুক ঠুকে বলতে পারবে তো, যে তৃণমূলের অন্যতম বড় সংগঠকের অনুপস্থিতিতে তারা নিজেদের সংগঠনের জোরে বীরভূম জেলার ভোট পরিস্থিতি পালটে দিতে পারবে?
সন্ধিক্ষণ তখনই স্থায়ী হয়, যখন মিডিয়া (বা এখন সোশাল মিডিয়া) নয়, মানুষ ঠিক করে নেন, তাঁরা সরকার পরিবর্তন করবেন। মানুষ তখনই সেই সিদ্ধান্ত নেন যখন কোনো বিকল্প চোখের সামনে দেখতে পান — তা ভাল বা খারাপ যাই হোক। সেই সন্ধিক্ষণের রসদ তো সামনেই রয়েছে। এরকম আরও অনেক মুহূর্ত এসেছে গত এগারো বছরে। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একটু মৃদু ধাক্কা দিয়েছিল মানুষ। কিন্তু দুই বছরের মধ্যে তাও স্তিমিত হয়েছে।
মনে রাখবেন, সেই ধাক্কাতে মানুষ বামেদের প্রতি নয়, রামেদের প্রতি আস্থা রেখেছিল। আর পরের নির্বাচনে বাম সমর্থকেরাও তৃণমূলে আস্থা রেখেছিল, রামেদের ভয়ে।
এখন, সারদা-নারদ, তৃণমূল স্তরের দুর্নীতি পেরিয়ে, শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি সেই সন্ধিক্ষণ সত্যিই তৈরি করবে কিনা, করলেও বিরোধী দলগুলি পরের নির্বাচন পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারবে কিনা, নাকি তারা সেই সন্ধিক্ষণের অপেক্ষাতে থাকবে যখন মানুষ নিজে থেকেই জেগে উঠবে — তা দেখতে হবে। কিন্তু তার জন্যও তো ভরসা জোগাতে হবে জনগণের মনে।
লেখক সাংবাদিকতার শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।