কয়েক দিন আগে, মানে রামনবমীর পরের দিন, সোশাল মিডিয়ায় এক প্রবাসী বন্ধু রাজস্থান থেকে লিখেছিলেন “রাজস্থানের মত হিন্দি বলয়ে, গোবলয়ে রামনবমী নিয়ে উন্মত্ততা নেই, অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই। অথচ বাংলায় রামনবমী মিছিলে উগ্রতা চোখে পড়ার মত।” জাতীয় স্তরের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম, সংবাদপত্রগুলোও একই কথা বলেছে। হাওড়ার শিবপুরে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিলের চিত্র বারবার দেখা গেছে। রামনবমীর দিন এবং তার পরের দিন হাওড়ার শিবপুর, উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা এবং হুগলীর রিষড়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং দুই গোষ্ঠীর মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ ও দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হলেন এবং ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন। তারপর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে বারবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। কখনো ধূলাগড়, কখনো রায়গঞ্জের মত একাধিক জায়গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটেছে।

রাজনৈতিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় শক্তির আস্ফালন বেড়েছে। শাসক ও বিরোধী – দুই শক্তিই নিজেদের স্বার্থে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আরএসএসের এজেন্ডা কারোর কাছেই আর গোপন নেই। ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ব কায়েম করাই আরএসএসের প্রধান লক্ষ্য। বিজেপিকে দিয়ে লক্ষ্যপূরণ হলে ভাল, কিন্তু তৃণমূল তথা মমতার হাত দিয়ে কাজটা হলেও ক্ষতি নেই। আরএসএস একাধিকবার প্রকাশ্যে মমতার প্রশংসা করেছে, এমনকি আরএসএসের মুখপত্রে মমতাকে দেবী দুর্গার সাথে তুলনাও করা হয়েছে। মমতাও একাধিকবার আরএসএসের সঙ্গে তাঁর নৈকট্যের প্রমাণ দিয়েছেন। একাধিকবার বলেছেন, তিনি মনে করেন আরএসএস খারাপ নয়, এমনকি বিজেপিরও সবাই খারাপ নন। সদ্য তিনি দীঘায় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের অনুরূপ মন্দিরের উদ্ঘাটন করেছেন। অতীতে যেমন ধূলাগড় কাণ্ডে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক ও নেতার ভূমিকা উঠে এসেছিল, এবারও তেমনি রামনবমীর মিছিলের ব্যাপারে বিজেপি ও তৃণমূল – দুই দলের নেতাদের যৌথ উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। উত্তরবঙ্গের ইসলামপুর করিম চৌধুরী মিছিলে হেঁটেছেন। করণদীঘির তৃণমূল বিধায়ক ডালখোলায় রামনবমীর শোভাযাত্রা উদ্বোধন করতে গিয়ে রামভক্তদের দ্বারাই আক্রান্ত হয়েছেন, বিধায়কের গাড়ি ভাঙচুর পর্যন্ত হয়েছে। রায়গঞ্জে প্রাক্তন বিজেপি, বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক প্রকাশ্যে বলেছেন, রামনবমী বিজেপির পৈতৃক সম্পত্তি নয়। অথচ রামের নামে মিছিলে উন্মত্ততা, বিশৃঙ্খল ধর্মীয় উস্কানি দেখে সভ্য নাগরিকরা লজ্জিত, আশঙ্কিত হয়েছেন। দক্ষিণবঙ্গেও একাধিক জায়গায় তৃণমূল-বিজেপি নিজেদের স্বার্থে রামনবমীকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তারই ফলশ্রুতি হাওড়া ও হুগলীর ঘটনা। আরএসএস-বিজেপি ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করেই রাজ্যে আবার প্রাসঙ্গিক হতে চাইছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সংখ্যালঘু অঞ্চলে ভোট ধসে যাওয়া, বিশেষত সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্রে পরাজয়ে শাসক দলের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে সংখ্যালঘু ভোট সরে যাচ্ছে। তাই তৃণমূল হিন্দু ভোট দিয়ে সেই ক্ষতি পূরণ করতে চাইছে। বিজেপি ও তৃণমূলের রামনবমী নিয়ে উৎসাহের নেপথ্যে ক্ষমতার এই রাজনীতি। এই রাজনীতিতে বারে বারে বিষাক্ত হচ্ছে বাংলার সমাজ, রাজনীতি, দৈনন্দিন জীবনযাপন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল ও বিজেপির পরে অন্তত পথের শক্তিতে এখনো সবচেয়ে বড় শক্তি বামপন্থীরা। বামপন্থার গোড়ার কথা হল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। একজন বামপন্থীকে ধর্মীয় বিভাজন, মেরুকরণ, উন্মাদনা এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অগ্রবর্তী সৈনিক হতেই হবে। এই রাজ্যে এবং এই দেশে বামপন্থীদের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার উজ্জ্বল অতীত আছে। বামপন্থীদের সদর্থক, হার না মানা মনোভাবের জন্য অতীতে বাংলায় এভাবে দাঙ্গা হতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে শিখ নিধন অথবা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী দাঙ্গা, গুজরাটের ২০০২ সালের দাঙ্গার পরেও কলকাতা তথা বাংলা ছিল স্বাভাবিক, তেমনভাবে শান্তি বিঘ্নিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে সেই সময়ের প্রধান শাসক দল সিপিএম এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুরর নাম এখনো উচ্চারিত হয়। ২০১৪ সালে রাজ্যে বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে শহর ও গ্রামের বাম ভোটব্যাঙ্ক বহু জায়গায় বিজেপির দিকে চলে যায়। একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে বহু বামপন্থী নেতা, কর্মীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা বিজেপি-আরএসএসের আশ্রয়ে তাদের হিন্দু ভোটারে পরিণত করেছে। তৃণমূলের ফ্যাসিস্ট আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে তারা আরও বড় ফ্যাসিস্ট বিজেপির ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ নির্বাচনে সিপিএম তথা বামপন্থী দলগুলোর পরাজয়ের পিছনে বাম ভোট রামে চলে যাওয়া অন্যতম কারণ। রাজ্যে বামেরা যত দুর্বল হয়েছে, ততই সবল হয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি – সমানুপাতিক হারে।

তবু আদর্শগত দৃঢ়তার কারণেই দাঙ্গাবিরোধীদের শেষ আশ্রয় বামপন্থী শক্তি। রাজ্যের সাম্প্রদায়িক পরিবেশ যখনই নষ্ট হয়েছে, সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করেছেন, বামেরা কী করছে? দাঙ্গার বিরুদ্ধে বামেরা না দাঁড়ালে কে দাঁড়াবে? এ যেন বামপন্থীদের প্রতি শান্তিকামী নাগরিকের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। একথা বলতে দ্বিধা নেই, হাজার দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সৎ চেষ্টা একমাত্র বামপন্থীরাই করছে।

সদ্য রামনবমীর শোভাযাত্রা নিয়ে অশান্তি শিবপুর এবং রিষড়ায় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রাজ্যের শান্তিকামী নাগরিকরা সোশাল মিডিয়ায় বারবার একই প্রশ্ন করেছেন – শিবপুর, রিষড়ার উপদ্রুত অঞ্চলে বামপন্থীরা যাচ্ছেন না কেন? কেন মিছিল করছেন না? অন্যদিকে রাজ্য সরকার এবং বিজেপি কিছুতেই চায় না বামপন্থীরা চলতি ঘটনাক্রমে হস্তক্ষেপ করুক। বিজেপির ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম’ এসেছে। হাওড়ার শিবপুর কাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিলে উপস্থিত যুবক মুঙ্গেরে ধরা পড়লে জানা গেছে, হাওড়ার সালকিয়ারই বাসিন্দা এই ছেলেটি আজ বিজেপি তো কাল তৃণমূল। দিন কয়েক দেরিতে হলেও বামেরা পথে নেমেছে। কলকাতায় মিছিল সংগঠিত করেছে। গত ৯ এপ্রিল রিষড়া সংলগ্ন কোন্নগর বাটা থেকে উত্তরপাড়ার গৌরী সিনেমা হল পর্যন্ত মিছিলে উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু শাসক কিছুতেই চায় না ধর্ম নিয়ে যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ বামপন্থীরা প্রবেশ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করুক। তাই গতকাল (১০ এপ্রিল) হাওড়ায় বামেদের শান্তি মিছিল পুলিশ আটকে দিয়েছে। শান্তি মিছিলে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সমেত বিভিন্ন বামপন্থী দল ও সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন।

পাঠক মনে রাখবেন, পুলিস নিরস্ত্র শান্তি মিছিল আটকায়, লাঠিচার্জ করে। সেলিম রাস্তায় পড়ে যান, তবু পুলিসের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগিয়ে যায় পিলখানা হয়ে শিবপুরের দিকে।

কয়েক দিন আগে সোশাল মিডিয়ায় একটি ছবি এসেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে বিহারের তেঘরার সিপিআই বিধায়ক রাম রতন সিং রামনবমীর দিন দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে একটা মসজিদ পাহারা দিচ্ছেন। রাজ্যের দাঙ্গাবিরোধী সাধারণ মানুষ বামপন্থীদের এই ভূমিকাতেই দেখতে চান।

আরো পড়ুন দুই শাসক চাইছে, তাই দাঙ্গা হচ্ছে আমার পাড়ায়

সরকার ও বিরোধী পক্ষ বাধা দেবে, পুলিশ লাঠিচার্জ করবে, সেলিমের মত অনেকে আক্রান্ত হবেন। কারণ রাজনৈতিক স্বার্থে তৃণমূল বা বিজেপি – কেউই চায় না বামপন্থীরা দাঙ্গাবিরোধী পরিসর দখল করুক। তবু এই রাজ্যের বামপন্থীরা প্রতিটি গ্রামে, গঞ্জে, শহরে শান্তি মিছিল সংগঠিত করুক। হাওড়ার মত মিছিল হাজার হাজার হওয়া দরকার। কোচবিহার-কলকাতা-সুন্দরবন – উত্তর থেকে দক্ষিণ – মোট দূরত্ব ১,০০০ কিলোমিটার। প্রতিদিন ২৫ কিলোমিটার পথ হাঁটলে মাত্র ৪০ দিন। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বামপন্থী দল, গণসংগঠন, সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট একসাথে একযোগে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, দাঙ্গার বিরুদ্ধে, বিভাজনের বিরুদ্ধে পথ হাঁটুক।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. সঠিক লিখেছেন। একমাত্র বামপন্থীদেরই পারে রাস্তায় নেমে, মানুষকে সাথে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে রুখে দিতে। চলছেও সে প্রচেষ্টা। আগের চেয়ে বামপন্থী প্রচার ও সংগঠন অনেক ভালো, তবু খামতি আছে অনেক । ধান্ধাপূঁজির গণনাধ্যম, স্বাভাবিকভাবেই, বামপন্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু আটকাতে পারছেনা বামপন্থার এই পূন:নির্মান, আশার আলো দেখাচ্ছে

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.