আমি যখন এই লেখা লিখছি, ঠিক তখনই আমার পাড়ায় চলছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। দুই সম্প্রদায়ের গরিব মানুষ আক্রান্ত। অনেক ছোট দোকানদার সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ ২০২৩) গভীর রাত পর্যন্ত বোমার শব্দ শুনেছি, শুক্রবার দুপুরেও সংঘর্ষ হয়েছে।
আমরা এই এলাকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা। স্থানীয় প্রিয়নাথ মান্না বস্তি (পিএম বস্তি) এলাকায় আমরা করোনা অতিমারীর সময় থেকে শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালাই। স্বাভাবিকভাবেই নিজের পাড়ায় চলমান সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যথাসম্ভব মানুষের পাশে থাকার। এখনই শান্তি মিছিল সংগঠিত করার মত পরিস্থিতি নেই, কারণ ১৪৪ ধারা রয়েছে। রবিবার মিছিল সংগঠিত করার প্রস্তুতি চলছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
প্রথমেই একটা কথা সাফ বলে নিতে চাই। শাসক চাইছে, তাই এই দাঙ্গা হচ্ছে। আমাকে বাম সমর্থক বলতে পারেন বা অন্য যা খুশি, কিন্তু আমি এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে উদ্ধৃত করতে চাই জ্যোতি বসুকে। তিনি বলেছিলেন, হুকুমত না চাইলে দাঙ্গা হবে না। দাঙ্গা তখনই হয়, যখন হুকুমত চায়। আমার এলাকায়, হাওড়ার শিবপুরেও, প্রশাসন চেয়েছে বলেই দাঙ্গা হয়েছে। প্রশাসনকে পরিস্থিতি সম্পর্কে বারবার জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনোরকম আগাম সতর্কতা চোখে পড়েনি। নাগরিক সংগঠনগুলি একাধিকবার পুলিশ প্রশাসনকে বলেছে, যে রামনবমীকে কেন্দ্র করে হাওয়া গরম হচ্ছে, খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে। কিন্তু প্রশাসন সেসবে কর্ণপাত করেনি। পরপর তিন বছর এই এলাকায় এমন ঘটল। প্রশাসনকে সতর্ক করার পরেও তাদের এই অপদার্থতা ক্ষমার অযোগ্য।
রামনবমীর যে মিছিলটিকে কেন্দ্র করে অশান্তি হয়েছে, তার সঙ্গে হাওড়ার রামরাজাতলার ঐতিহ্যবাহী রামনবমী উৎসবের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত গতকালের আগে পর্যন্ত ছিল না। রামরাজাতলায় তিনশো বছরের বেশি সময় ধরে রামনবমী পালিত হয়ে আসছে। রামনবমীর দিন উৎসব শুরু হয়, শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত উৎসব চলে। যে মন্দিরটিতে এই উৎসব চলে, সেটির নামেই ওই প্রাচীন জনপদের নাম ‘রামরাজাতলা’। সেখানকার রামের সঙ্গে উত্তর ভারতীয় রামের ফারাক অনেক। এই রামের গাত্রবর্ণ সবুজ, গোঁফ আছে, একটুখানি ভুঁড়িও আছে। তিনি মোটেই উত্তর ভারতীয় পুরুষালি যোদ্ধা রাম নন। এই রাম শাসক রামচন্দ্র, প্রজাবৎসল রামচন্দ্র। রঘুপতি রাঘব রাজা রাম। মন্দিরের সামনে দুটি ফলের দোকান রয়েছে। ওই দোকান থেকে ফল কিনেই পুজো দিতে যান পুণ্যার্থীরা, শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিণী সারদামণি যখন সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন, তখনো এর অন্যথা হয়নি। দুটি দোকানের মালিকই ধর্মে মুসলমান। তাঁদের উৎখাত করার বহু চেষ্টা বিফলে গিয়েছে স্থানীয় মানুষের প্রচেষ্টায়।
আরো পড়ুন কলকেতার নূতন রামনবমী ও নূতন রাম
এই রামকে দিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের কার্যসিদ্ধি হচ্ছিল না, ফলে তারা নতুন পথ ধরল। রামরাজাতলায় আরএসএসের বিস্তার শঙ্কর মঠকে কেন্দ্র করে। সেখানকার মহন্তদের নিয়োগ করা হয় সরাসরি নাগপুর থেকে। মূলত এই মঠের উদ্যোগেই এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংসের চেষ্টা শুরু করা হয়। এবার রামনবমীর দিন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী শঙ্কর মঠ থেকে মিছিল করে রামরাজাতলার মন্দিরে প্রবেশ করেন। এই প্রথমবার।
কয়েক বছর আগে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার যে রাম বিজয়ার মিছিল বের হয়, সেই মিছিল বিজেপির লোকজন দখল করতে যায়। স্থানীয় মানুষ তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এরপর পরিস্থিতি অশান্ত করতে ওই এলাকাতেই নতুন রামমন্দির নির্মাণ করা হয়। নতুন মন্দিরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৃণমূলের সাংসদ প্রসূন ব্যানার্জি এবং তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক (পরে বিজেপিতে যোগ দেন) জটু লাহিড়ি। এই রাম একেবারেই উত্তর ভারতের যোদ্ধা রাম। এই নতুন রামমন্দির থেকে গত কয়েক বছর ধরেই হাওয়া গরম করা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক ঘোঁট পাকানো চলছে।
যে মিছিলকে কেন্দ্র করে হাওড়ায় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠেছে, তা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নিয়ে যাওয়া হয় মুসলিমপ্রধান এলাকার মাঝখান দিয়ে। জিটি রোড ধরে মিছিল এগোয়। তার দুপাশে পিএম বস্তি, চওড়া বস্তি, কাজীপাড়া বস্তি। প্রতিটিই মুসলিমপ্রধান জায়গা – ৯৫% বাসিন্দা গরিব মুসলমান। অধিকাংশ মানুষ জুটমিলে কাজ করেন বা জুটমিল বন্ধ হওয়ায় অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজদুরি করেন। রামনবমীর মিছিলে তারস্বরে ডিজে বাজানো হয়। গানের লিরিক “হিন্দুস্তাম মে রহনা হ্যায় তো রাম রাম কহনা হ্যায়।” মিছিল ছিল সশস্ত্র। তরোয়ালসহ বিভিন্ন অস্ত্রের খোলাখুলি প্রদর্শনী দেখেন এলাকাবাসী।
পরপর তিন বছর এখানে রামনবমীর দিন সংঘর্ষ হল। এবছর আগে থেকেই খবর ছিল – দুপক্ষই বড়সড় গোলমালের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে খবর জানানোও হয়েছিল প্রশাসনকে, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয় থেকে কার্যত বিষয়টি ঘটতে দিল।
এই ঘটনা থেকে রাজনৈতিক লাভ তুলতে চায় কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলগুলো। বিজেপি এবং তৃণমূল গোটা রাজ্যেই হাতে হাত ধরে একসঙ্গে রামনবমীর মিছিল করেছে। হাওড়া শিবপুরের ঘটনার জন্যও দুপক্ষই দায়ী। পরিকল্পনা করে এই ঘটনা ঘটতে দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় “ইনশাল্লাহ” বলেন। আসলে তিনি ইসলামের কিচ্ছু জানেন না। বৃহস্পতিবার, শুক্রবার সংঘর্ষ হল। ইফতারের সময়ে সংঘর্ষ, জুম্মাবারে সংঘর্ষ। বহু ফল ব্যবসায়ী, খাবার ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারালেন তো বটেই, রোজাদারদের ইফতারও হল না। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। গরিব মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষতি তো বটেই, রমজান মাসে রোজাদার মানুষের এই অভিজ্ঞতার সাংস্কৃতিক ক্ষতিও অপরিসীম। এই সবকিছুর পিছনে আছে প্রশাসনের সচেতন নিষ্ক্রিয়তা। পুলিশমন্ত্রী প্রশ্ন করেছেন, মিছিলের রুট বদল হল কেন? এ প্রশ্ন ওঁর করার কথা নয়, ওঁর এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কথা। পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে জবাব দিতেই হবে। একজন আয়করদাতা নাগরিক হিসাবে, এই এলাকার বাসিন্দা হিসাবে আমি এই অমানবিক, সাম্প্রদায়িক, অসংবেদনশীল সরকার এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসক দলকে ধিক্কার জানাই।
তথ্য ও মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
[…] […]
[…] খবর ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তাই লিঙ্কে রইল একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়া…। বাঙালি মুসলমানদের ‘বাংলাদেশী’ ও […]