যত যা-ই হোক, রাজ্য সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মহার্ঘ ভাতা বা ডিএ বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের, চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের জন্য, চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের দ্বারা আন্দোলন। এর সঙ্গে রাজ্যের গরিব মানুষের স্বার্থের কোনো যোগ নেই, ফলে তাঁদের মধ্যে এর কোনো প্রভাবও নেই। এই ধারণা রাজ্যের মন্ত্রিসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফিরহাদ হাকিমের মত আমারও ছিল। ভুল ধারণা।

ধারণাটা যে ভুল তা বুঝতে আমাকে শহিদ মিনারের নিচের অবস্থান চত্বরে গিয়ে দাঁড়াতে হল শনিবার দুপুরে। দুমাসের বেশি সময় ধরে যে অবস্থান চলছে তার মঞ্চ সমেত যে অংশটুকু ছাউনিতে ঢাকা সেখানটা ভরদুপুরে জনবহুল না হলেও জমজমাট। কিন্তু বাইরের বেঞ্চগুলোতে যারা উৎকর্ণ হয়ে বসে মাইকে যা বলা হচ্ছে শুনছিল তাদের বয়স এবং পোশাক আশাক বলে দেয়, তারা অনেকেই চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত নয়। অন্তত এক জোড়া প্রেমিক যুগল ছিল যারা চাকরিসন্ধানী। তাছাড়াও বেশ কয়েকজন মাঝবয়সী ছিলেন যাঁরা নির্ঘাত অন্য কাজে বেরিয়ে সামান্য জিরিয়ে নেওয়ার জন্য শহিদ মিনারের পাদদেশে বেঞ্চে এসে বসেছিলেন। সে কাজটা সহকর্মীর সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম হলেও আশ্চর্য হব না। কিন্তু কোঁচকানো ভুরু আর সোজা পিঠ প্রমাণ করছে, প্রেম-ট্রেম ভুলে তাঁরাও সমস্ত শরীর দিয়ে ছাউনির নিচ থেকে ভেসে আসা বক্তৃতা শুনছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

দুদিন আগেও আমার এলাকায় দেখেছি, দুর্নীতি ও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে একটা স্ট্রিট কর্নারে রেভলিউশনারি সোশালিস্ট পার্টির এক কর্মী প্রাণ ঢেলে বক্তৃতা করছেন আর তাঁর চারপাশ দিয়ে নির্বিকার মানুষ যাওয়া-আসা করছেন। তিনি বলছেন জরুরি কথা, কিন্তু কেউ কান দিচ্ছে না। দলের নাম যা-ই হোক আর বক্তব্য যা নিয়েই হোক, অন্তত তিরিশ বছর ধরে যে কোনো বক্তৃতার এই গতিই হয়ে আসছে। সেই চেনা ছবি শহিদ মিনারের কাছে গিয়ে কোন মন্ত্রবলে বদলে গেল, কী এমন বক্তৃতা চলছে যা এতরকম মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে? কান খাড়া করে শুনতে শুনতেই চোখ পড়ল মলিন লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরিহিত বেঁটে, রোগা, শ্বেতশুভ্র চুলদাড়ির ফেজ পরা এক বৃদ্ধের দিকে। উপস্থিত শ খানেক লোকের মধ্যে আর কেউ বয়সে এঁর ধারেকাছে আসতে পারবে না। আন্দোলনের সংগঠকদের একজনকে বেশ উত্তেজিতভাবে হাত-পা নেড়ে কীসব বলছেন দেখে আগ্রহ তৈরি হল। ওই বয়সের লোক এখানে কেন? উনি বড়জোর রাজ্য সরকারের পেনশনার হতে পারেন। কিন্তু স্রেফ পর্যাপ্ত ডিএ পাচ্ছেন না বলে একজন ওই বয়সী পেনশনার অশক্ত শরীরে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন? ধূলিমলিন পোশাক দেখে মনে হল আসতেও হয়েছে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে। আলাপ করলাম। কিমাশ্চর্যম তৎপরম! উনি স্কুলশিক্ষক ছিলেন না, রাজ্য সরকারের কোনো দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীও নন। দিনমজুর। এসেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণার লক্ষ্মীকান্তপুরের নিকটবর্তী এক গ্রাম থেকে। নাম মহম্মদ সাত্তার।

“এ তো চাকরি করা লোকেদের আন্দোলন। আপনি এখানে কেন?” পরিচয় সারা হলে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।

“আসব না? একশোবার আসব। আমি তো সেদিনের [শুক্রবারের] বড় মিটিংয়েও ছিলাম,” সাত্তার ঘাড় উঁচু করে বললেন।

“কিন্তু এরা ডিএ পেলে আপনার লাভ কী?”

“কেন? কেবল ডিএ নাকি? চাকরির দাবি আছে না? যোগ্য লোকের চাকরির দাবি কচ্ছে তো।”

কথাটা সত্যি। মঞ্চের উপর লাগানো ফেস্টুনে বেশ বড় অক্ষরেই লেখা আছে যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দিয়ে শূন্য পদে নিয়োগ এবং যোগ্য অস্থায়ী চাকুরেদের স্থায়ী করার দাবি। কিন্তু রোজ টিভিতে যে খবর শুনি আর কাগজে যে খবর পড়ি, তাতে কেবল ডিএ-র দাবির কথাই জ্বলজ্বল করে। ফলে আমার মস্তিষ্ক যেটুকু দেখতে চেয়েছে দু জোড়া চোখ সেটুকুই দেখেছে। আমার দেড় গুণ বয়সী দিনমজুরের চোখ কিন্তু সবটা দেখেছে। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তারপর যোগ করলেন “এদের দাবি মিটলে তো আমাদের ছেলেপুলেগুলো চাকরি পাবে। নইলে কী করবে? খেতমজুরিই করে যাবে? ওদিকে তো সব পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার করে টাকা নে চাকরি দিইচে। অত টাকা কোতায় পাব আমরা?”

“আপনাদের গ্রামেও চাকরি বিক্রি হয়েছে নাকি?”

“হয়নে আবার? বিশ্বাস না হয় পাটিয়ে দিন না কী কী সব তদন্তের লোক আচে।”

বৃদ্ধের এত উৎসাহ দেখে জিজ্ঞেস করতেই হল “কিন্তু এসবের আগে কি আপনাদের গ্রামে গরিবের ছেলে স্কুলমাস্টার হত এসএসসি দিয়ে?”

“সে অনেককাল হয়নে। আগে হত।”

“কত আগে?”

“সে বাম আমলে। তারপরে আর পরীক্ষা হল কটা?”

“কিন্তু সে আমলে যে চিরকুটে চাকরি হত বলছে সরকার?”

“টাকা নিয়ে চাকরি কে দিয়েচে? দেকান না একটা।”

বৃদ্ধ বড় একগুঁয়ে। তাঁর বক্তব্য চাকরি বিক্রি করার ঘটনা আগের আমলে পাওয়া যাবে না। বিদায় নেওয়ার আগে হাত নেড়ে বলে গেলেন “সব ফাঁস হয়ে গেচে। একন যা-ই বলো, ভোটটি আর পেতে হচ্চে না।”

কারা ভোট পাবে না বললেন তা বুঝতে পারার জন্য কোনো পুরস্কার নেই। তবে সাত্তার মাত্র একজন লোক, ফলে তাঁর কথাকে হয়ত বেশি গুরুত্ব দেওয়া অনুচিত। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। ফল বেরোবার পর খোঁজ নিলে হয়ত দেখা যাবে সাত্তারের নিজের গ্রামেও তাঁর কথা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন নিয়ে রাজ্যের গরিব মানুষের কোনো আগ্রহ নেই – এ ধারণা জোর ধাক্কা খেল তাঁর কথায়।

রাজ্যের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ফিরহাদ হাকিম ক্যামেরার সামনে ডিএ-কে গরিব মানুষের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে বলেছেন, ডিএ হল যাদের কিছু আছে তাদের আরও পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপার। তাঁর কাছে সেটা পাপ। কিন্তু সাত্তারের মত করে যে অনেক গরিব মানুষই ভাবছেন, তা সম্ভবত হাকিম সাহেবও জানেন। কারণ তিনি পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। আমার মত সুখী মধ্যবিত্ত নন, যার বেসরকারি চাকরিতে ডিএ ছিল না বলে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ প্রাপ্তিকে অন্যায় সুবিধা বলে মনে হয়। হাকিম সাহেব জানেন মানেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও জানেন। সম্ভবত সেই কারণেই সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন যত দীর্ঘ হচ্ছে তাঁর স্নায়ুর চাপ তত বাড়ছে। একদা বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে যে আত্মবিশ্বাসে বলতেন “আমি অনেক গুন্ডা কন্ট্রোল করি”, সেই আত্মবিশ্বাসে আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। শোকজ, সার্ভিস ব্রেক, আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি সত্ত্বেও ১০ মার্চ সফল ধর্মঘট (সরকারেরই হিসাব অনুযায়ী) করে ফেললেন তাঁরই অধীনস্থ কর্মচারীরা। যৌথ মঞ্চ, সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের ব্যানারে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠনের ঐক্য এমন জমাট বেঁধেছে যে শোকজের জবাবের বিলি হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলে, হোয়াটস্যাপে, ফেসবুকে। এমনকি যাঁরা সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে বা স্রেফ ভয়ে ধর্মঘটে অংশ নিতে পারেননি, তাঁরাও সোশাল মিডিয়ায় এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ধর্মঘট না করতে পারার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছেন, নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন – এমন ঘটনা বিরল নয়। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘকালের আন্দোলনবিমুখ, রাস্তায় মিছিল দেখলেই মুখ বিকৃত করে “উফ! আবার এরা নেমে পড়েছে” বলা মধ্যবিত্ত মানুষ যে এমন জোরালো আন্দোলন করার সাহস অর্জন করেছেন তা বোধহয় মুখ্যমন্ত্রী একেবারেই কল্পনা করেননি। কারণ বামফ্রন্ট সরকারের শেষ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাখিপড়া করে রাজ্যের মানুষকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন, ধর্মঘট খুব খারাপ এবং তাঁর দুর্ভাগ্য তিনি এমন একটা দল করেন যারা ধর্মঘট করে।

মুখ্যমন্ত্রী
শনিবার দুপুরে অবস্থান বিক্ষোভের একটি মুহূর্ত। ছবি: নাগরিক ডট নেট

বুদ্ধবাবুর সেই শিক্ষার সম্পূর্ণ ফায়দা তুলেছে তৃণমূল সরকার। ক্ষমতায় এসেই মুখ্যমন্ত্রী বিস্তর হাততালি কুড়িয়েছেন সরকারি কর্মচারীদের ভয় দেখিয়ে যাবতীয় বনধ ব্যর্থ করে দিয়ে। চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরা দুহাত তুলে তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের ‘চলবে না চলবে না’ সংস্কৃতি বদলে দিয়েছেন বলে। এতদিনে তাঁরা টের পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়ার জন্য খামোকাই আন্দোলন, ধর্মঘটকে দায়ী করা হয়েছিল। তৃণমূল আমলে সেসব বন্ধ হয়ে গিয়ে লাভ হয়েছে শূন্য, ক্ষতি হয়েছে বিপুল। নিজেদের বহুদিনের চেষ্টায় পাওয়া অধিকারগুলোও মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের পায়ে জমা পড়ে গেছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতিই এ রাজ্যে সমস্ত কাজে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুলে নিয়োগ, পৌরসভায় নিয়োগ তো বটেই, একশো দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা – কোথাও কাটমানির হাত থেকে নিস্তার নেই। ফলে এখন চাকুরিজীবীরাও নেমে পড়েছেন আন্দোলনে। যখন এসএসসি, টেট, মাদ্রাসায় চাকরি না পাওয়া ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তখনো এঁদের অনেকে বিশেষ গা করেননি। শেষমেশ ডিএ-র অপ্রাপ্তি এঁদের ঘুম ভাঙিয়েছে। তাতে অবশ্য ক্ষতি নেই। কবি বলেছেন “প্রভাত কি রাত্রির অবসানে।/যখনি চিত্ত জেগেছে, শুনেছ বাণী,/তখনি এসেছে প্রভাত।”

আরো পড়ুন সরকারি কর্মচারীরা কেন অনশন, ধর্মঘটের পথে?

কিন্তু মুশকিল হল, এঁদের চিত্ত জেগে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী পড়েছেন বিপদে। একে গ্রামের মানুষের ক্ষোভ সামলাতে দিদির দূত পাঠানোর প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেখা গেছে দূতদের মুখের উপর মানুষ দুকথা শুনিয়ে দিচ্ছেন, ফলে গরিব মানুষের সমর্থনে ক্ষয় পরিষ্কার। এখন মধ্যবিত্তরাও যদি চটে যান, তাহলে চলে কী করে? ওদিকে মুখ্যমন্ত্রী যাঁদের ডান হাত বাঁ হাত মনে করতেন তাঁরা ইডি বা সিবিআইয়ের জিম্মায়। জাতীয় রাজনীতিতে পরিস্থিতি এমন ঘোরালো, যে রাহুল গান্ধীর পক্ষ নিয়ে দু-চার কথা বলতেই হল। আবার বেশি বললে ইডি, সিবিআই আরও কী করবে তার ঠিক নেই। এমনিতেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের একগাদা বকেয়া টাকা আটকে দিয়েছে মোদী সরকার। তা নিয়ে ধর্নায় না এলেন অন্য কোনো রাজ্যের আঞ্চলিক দলের নেতা, না এল মোদী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সৌজন্যমূলক ফোন। এত চাপ একসঙ্গে সামলাতে হলে মুখ দিয়ে চাট্টি উল্টোপাল্টা কথা বেরিয়ে যেতেই পারে। তাই নিজের সরকারের কর্মচারীদের ডিএ দিতে না পারার জন্যে হাত জোড় করে মার্জনা ভিক্ষা করার বদলে তাঁদের চোর ডাকাত বলে ফেলেছেনবাছা বাছা সরকারি কর্মচারীর পেনশন বন্ধ করার হুমকিও দিয়ে বসেছেন। আন্দোলনকারীরা সব বাম আমলে চিরকুটে চাকরি পেয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেছেন। সমস্ত আন্দোলনকারীকে একইভাবে দাগিয়ে দিয়ে এরকম আক্রমণ করলে যে সাধারণ সরকারি কর্মচারীরা আরও ক্ষেপে যাবেন, মধ্যবিত্ত ভোটেও ধস নামার সম্ভাবনা দেখা দেবে তা বুঝতে সেফোলজিস্ট হতে হয় না। কিন্তু ভারতবর্ষ হল মহাজ্ঞানী ঋষিদের দেশ। তাঁরা এমনি এমনি পুরাণে লিখে যাননি যে বিনাশকালে ক্ষমতাশালীদের বিপরীত বুদ্ধি দেখা দেয়। তাই মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা রোজ হুমকি দিচ্ছেন – বাম আমলের অমুক ফাইল বার করব, তমুক ফাইল বার করব, দেখিয়ে দেব কীভাবে চিরকুটে চাকরি দেওয়া হত। আজ বলছেন, কাল পিছিয়ে যাচ্ছেন। আসলে মমতার সঙ্গীদের মধ্যে ব্রাত্য বসুর মত বহু তাত্ত্বিক গভীরতাসম্পন্ন প্রাক্তন বামপন্থী আছেন। হয়ত তাঁদের পরামর্শেই লেনিনের বিখ্যাত কৌশলের বিপরীত প্রয়োগে এহেন এক পা এগিয়ে দু পা পিছিয়ে যাওয়ার কৌশল।

মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে যা উদ্বেগের তা হল, শনিবার অবস্থান মঞ্চ থেকে আন্দোলনকারীরা সরকারকে অনুরোধ করেছেন তাঁদের সার্ভিস রুলের যে ধারায় সরকারি তথ্য প্রকাশ্যে আনা বারণ, সেটাকে কিছুদিনের জন্য রদ করতে। তাহলে তাঁরা নিজেরাই সকলের চাকরি পাওয়ার তথ্য প্রকাশ্যে আনবেন। তাতে নাকি বর্তমান সরকারেরই মুখ লুকোবার জায়গা থাকবে না। এই মন্তব্যকে তবু রাজনৈতিক কৌশল বলে ভাবার অবকাশ আছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে কান পাতলে সাধারণ নাগরিকদের যেসব মন্তব্য শোনা যাচ্ছে তা মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের পক্ষে আরও বেশি উদ্বেগজনক। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কীভাবে চাকরি হত, কার পরিবারের কজন চাকরি পেয়েছে তা নিয়ে কুণাল ঘোষ প্রমুখের ভাসা ভাসা মন্তব্যে বিশেষ লাভ হচ্ছে না। কারণ সিপিএম দলের সদস্য বা অন্ধ সমর্থক ছাড়া সকলেই জানেন এবং মানেন যে বাম আমলে বেশকিছু স্বজনপোষণ হয়েছে। তার চেয়েও বেশি যা হয়েছে তা হল দলের লোককে বিভিন্ন চাকরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া। ২০১১ সালে যে যে কারণে অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার হওয়া আটকে দিয়েছিলেন মানুষ, তার মধ্যে এটাও একটা কারণ বলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সিপিএম নেতারা চাকরি বিক্রি করতেন, এমনকি নিজের দলের লোককেও কয়েক লক্ষ টাকা পেলে তবেই চাকরি দিয়েছেন – এমন কথা অতি বড় বামবিরোধীও বলছেন না। সুতরাং ওই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তৃণমূল সরকারের পাপস্খালন হওয়া প্রায় অসম্ভব। সুজন চক্রবর্তীর কজন আত্মীয় সরকারি চাকরিতে ছিলেন তা নিয়ে জল্পনা চালিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বিস্তর লাইক কুড়ানো যেতে পারে, বামেদের সম্পর্কে যাঁদের প্যাথোলজিকাল ঘৃণা আছে তাঁদের কদিন আনন্দও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ভোট পাওয়া মুশকিল।

মুখ্যমন্ত্রী
অবস্থান বিক্ষোভে আসা আন্দোলনকারীদের একাংশ। ছবি: নাগরিক ডট নেট

ইতিমধ্যেই আন্দোলনকারী সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা মুখ্যমন্ত্রীর কুবাক্যের প্রতিবাদে ৬ এপ্রিল ফের কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন। সরকারের পক্ষে আরও ভয় ধরানো পরিকল্পনা শুনে এলাম শহিদ মিনারের পাদদেশে। আন্দোলনকারীদের হিসাব অনুযায়ী, এত সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়া, অবশিষ্ট স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী না থাকা সত্ত্বেও সব মিলিয়ে এইসব স্কুলের মোট ছাত্রসংখ্যা সাড়ে ১৫ লক্ষের কাছাকাছি। ওঁরা এই ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ভাবছেন। গ্রামে শহরে পাড়ায় পাড়ায় মানুষকে বলবেন কীভাবে স্কুলগুলোকে শুকিয়ে মেরে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাই তুলে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কেবল শিক্ষকদের আন্দোলনকে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা বাঁচানোর আন্দোলন করে তোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল বলা যেতেই পারে। কিন্তু গাছটি যে পোঁতা হয়েছে এ কম আশার কথা নয়। রাজ্যের ডুবন্ত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার কাছে, মিড ডে মিলে সাপ পাওয়া ছেলেমেয়েদের কাছে এইটুকুই তো খড়কুটো।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.