অঙ্কু দাস

এই লেখার সময়ে শহিদ মিনারের পাদদেশে অবস্থানরত সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের বিক্ষোভ কর্মসূচি ৩০ দিন এবং অনশন ২৯৬ ঘন্টা পার করেছে। গত মাসের ২৭ তারিখে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বাইশটি সংগঠন একত্রিত হয়ে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ নামে এক ছাতার তলায় অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করে। বর্তমানে এই মঞ্চের সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৪০। ২০১৬ সাল থেকে রাজ্য সরকার ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ন্যায্য পাওনা আদায় নিয়ে যে দড়ি টানাটানি শুরু হয় তাতে মমতা সরকার একাধিকবার পর্যদুস্ত হলেও, কোষাগারে ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার টাকা নেই, এই অজুহাতে হাইকোর্টে হাজির হয়। দীর্ঘদিন ধরে শুনানির পর ২০২০ সালের ২০ মে কলকাতা হাইকোর্ট তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা বা ডিএ মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর আগে ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাশীষ করগুপ্ত এবং বিচারপতি শেখর ববি শরফের ডিভিশন বেঞ্চ মহার্ঘ ভাতার অধিকারকে আইনি অধিকারের স্বীকৃতি দেন। ২০ মের রায় কার্যকর করার প্রায় শেষ মুহূর্তে রাজ্য সরকার হাইকোর্টে রিভিউ পিটিশন দাখিল করে। বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ ২২ সেপ্টেম্বর সেই পিটিশন খারিজ করে দেয় এবং ২০ মের রায় বহাল রাখে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

অবস্থা বেগতিক দেখে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যায়। আগে থেকেই সরকারের এই মনোভাব আঁচ করে কনফেডারেশন ও ইউনিটি ফোরাম ক্যাভিয়েট দাখিল করে রাখে এবং হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করে। সেই মামলা আপাতত স্থগিত আছে সুপ্রিম কোর্টে আগের মামলার ১৫ মার্চ চূড়ান্ত শুনানির জন্য।

যা-ই হোক, এই দীর্ঘ আইনি মারপ্যাঁচে ক্লান্ত ও বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সংকটে বিপর্যস্ত সরকারি কর্মচারীরা সরকারের সঙ্গে শেষ বোঝাপড়াটা করে নিতে পথে নেমেছেন। তাঁদের প্রধানত দুটি দাবি। প্রথমত, প্রতিটি শূন্য পদে দ্রুত স্বচ্ছভাবে স্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, AICPI অনুযায়ী তাঁদের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী এ রাজ্যে সরকারি কর্মীদের প্রাপ্য ডিএর হার মাত্র ৩%, যা গোটা দেশের বিজেপিশাসিত ও বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।।

অবস্থান বিক্ষোভের পাশাপাশি সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ ১ ফেব্রুয়ারি রাজ্যজুড়ে সমস্ত সরকারি দপ্তরে দু ঘন্টার কর্মবিরতির ডাক দিয়েছিল। মমতা ব্যানার্জির সরকার প্রাথমিকভাবে তাচ্ছিল্য করলেও সরকারি সমস্ত সপ্তরে কর্মবিরতিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ১৩ ফেব্রুয়ারি আবার সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ পূর্ণ দিবসের কর্মবিরতির ডাক দেয়। হাজিরার পরিসংখ্যান দেখিয়ে মমতা সরকার এই কর্মসূচিকে ব্যর্থ হিসাবে ঘোষণা করে, কিন্তু জানা গেছে দপ্তরগুলোতে হাজিরা থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় কাজকর্ম হয়নি এবং বিভিন্ন আদালতের দপ্তর সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল, কোথাও কোথাও বিক্ষোভ মিছিলও বের হয়। এই কর্মবিরতির ব্যাপক সাড়া বঞ্চিত কর্মচারীদের লড়াইকে অক্সিজেন জুগিয়েছে। শহিদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান বিক্ষোভে ব্যাপক জমায়েত হয়।

দিনদিন বাড়তে থাকা এই আন্দোলনকে মমতা যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কর্মচারীদের একাংশের বিরোধী রাজনৈতিক মদতপ্রসূত বিক্ষিপ্ত কর্মসূচি হিসাবে দেখান না কেন, এ যে তাঁর প্রশাসনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ ফেব্রুয়ারির বাজেট অধিবেশনে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিধানসভায় চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বাজেট পেশের সময় মুখ্যমন্ত্রী প্রেরিত চিরকুট পাঠের মধ্য দিয়ে ৩% ডিএ ঘোষণা করেন। বকেয়া ৩৯% ডিএর মধ্যে মাত্র ৩% ডিএ ঘোষণা রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের ক্ষোভে অগ্নিসংযোগের কাজ করে। শহিদ মিনারের পাদদেশে উপস্থিত কর্মচারীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন এবং মমতা সরকারের প্রতি ক্ষোভ উগরে দেন। বকেয়া ডিএ না মেটালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দেন। এই বিষয়ে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ প্রথমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার এবং রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে মেল করে এবং দুই অফিসেই চিঠি দেয়।

এরপরেও সরকারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক কিছু কথা ছাড়া আর কোনো সদর্থক পদক্ষেপ না দেখে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ পরপর দুদিন – ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি পেন ডাউন বা পূর্ণ দিবসের কর্মবিরতির ডাক দেয়। সিপিএম প্রভাবিত শিক্ষক ও কর্মচারী সংগঠন প্রাথমিকভাবে মঞ্চের কর্মসূচিকে নৈতিক সমর্থন জানানোর পরেও কর্মবিরতি থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কর্মচারীদের মধ্যে পেন ডাউন কর্মসূচির ব্যাপক প্রভাব দেখে ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মবিরতিকে সমর্থন জানায়।

আরো পড়ুন ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের শিক্ষার্থীরা কেন অনশনে?

এইরকম পরিস্থিতিতে মমতা প্রশাসন বরাবর যা করে থাকে সেটাই করে। কর্মচারীদের বিশেষভাবে ওই দুদিন কাজে যোগ দেওয়ানোর জন্য স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নেয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি এক মেমো জারি করে ঘোষণা করে ১৭ ফেব্রুয়ারির আগে নেওয়া চাইল্ড কেয়ার লিভ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, মেডিকাল ছুটি এবং আর্নড লিভ বাদে সমস্ত ছুটির আবেদন বাতিল করা হবে। উপরন্তু ২০, ২১ তারিখ কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকলে dies-non (ব্রেক ইন সার্ভিস) হিসাবে গণ্য হবে এবং প্রয়োজনে শোকজ নোটিসও ধরানো হবে। শুধু সরকারিভাবে নয়, শাসকদলের মেজো, সেজো নেতারাও সোশাল মিডিয়া এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বিরুদ্ধে সুর চড়ায়। দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক উদয়ন গুহ সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন “২০-২১ না এলে ২২ তারিখ বাড়িতে থাকুন”। এই পোস্টকে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসাবেই দেখছে এবং আইনি নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে যে কয়েকটা হাতে গোনা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঞ্চের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকদের কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠিয়েছেন, তাঁদেরও আইনি নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ ও যৌথ মঞ্চ একত্রিত হয়ে ১০ মার্চ সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। উপরে উল্লিখিত দুটো দাবির পাশাপাশি যোগ্য অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ী করার দাবিও তোলা হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে অনশনকারীদের শরীর ভাঙছে। একাধিকবার তাঁরা হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের অন্যতম নেতা ও অনশনকারী ভাস্কর ঘোষকে এসএসকেএম হাসপাতাল সরকারি চাপে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ অনশন মঞ্চটাকে হাসপাতালের সামনে তুলে আনার হুঁশিয়ারি দিলে ভাস্করবাবুকে ভর্তি নিতে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে অবস্থান মঞ্চে সংহতি জানাতে এসেছেন শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার, এসেছেন বিরোধী দলের একাধিক নেতাও। তবে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ এই আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক রং লাগতে না দেওয়ার ব্যাপার সতর্ক। এখন একমাত্র প্রস্তুতি ১০ মার্চের ধর্মঘট সফল করার দিকে। তার জন্য নেতৃত্ব সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছে, প্রয়োজনে সবরকম প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হবে। এখন দেখার, এই একত্রিত লড়াই রাজ্যের সরকারি কর্মচারী, সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত বেকার যুবক-যুবতী ও অনিয়মিত কর্মীদের হকের দাবি কতটা আদায় করে নিতে পারে।

নিবন্ধকার আন্দোলনরত শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ী করা নিয়ে সেরকম জোরালো কিছু হচ্ছে কি? যোগ্য অস্থায়ী কর্মী বাছবার প্রক্রিয়া কি?

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.