সপ্তাহ পেরোল ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজের পড়ুয়াদের অনশন। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন অগণতান্ত্রিকভাবে বাতিলের প্রতিবাদে আমরণ অনশনে ১০০ ঘন্টার মাথায় অসুস্থ ঋতমকে বন্ধুরা মিলে ভর্তি করেছে সিসিইউতে। এখনো অনশন মঞ্চে লড়ে যাচ্ছে সাবিত, প্রত্যুষ, কৌশিক এবং রণবীর। ১২ ডিসেম্বরের কনভেনশনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসক সমাজ। ওইদিনই অনশনে যোগদান করেছে শুভ এবং সৌমিত। ১৩ তারিখে ছাত্রছাত্রীদের নাগরিক মিছিলে কলকাতা সাক্ষী থেকেছে নবীন প্রজন্মের হুঙ্কারের। গণতন্ত্রের জন্য মেডিকাল কলেজের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রেসিডেন্সি, যাদবপুর, আলিয়া, বিশ্বভারতী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। ১৫ তারিখ অভিভাবকদের প্রতীকী অনশন এক অভূতপূর্ব ঐক্যের বার্তা দিয়েছে।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জয়লাভের পর থেকে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সচেতনভাবেই সামগ্রিক গণতন্ত্রের বাতাবরণ নষ্ট করেছে। বলা বাহুল্য, শিক্ষায়তনও এর ব্যতিক্রম নয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাতিল করে প্রতিনিধি বাছাইয়ের মাধ্যমে স্টুডেন্টস কাউন্সিল মডেল তৈরি করা হয়েছে। কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচন না হতে দেওয়া মতাধিকার হরণেরই অঙ্গ ছিল বটে। আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ইলেকশন বিল। আলাদা করে চারটে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নোটিস জারি হয় (বলাই ছিল, এই বিল দেখিয়ে পরবর্তীকালে কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানো যাবে না।)। এককথায়, পর্যায়ক্রমিকভাবে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছে তৃণমূল সরকার। বিনিময়ে প্রশস্ত করেছে দুর্নীতি ও গুন্ডাগিরির রাজনীতির পথ। ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের কথা, তাদের অধিকারের লড়াইকে গোটা রাজ্যে বলপূর্বক ধ্বংস করা হয়েছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২০১৬ সালের পর থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিকাল কলেজে। গত চারমাস মেডিকাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সংসদ নির্বাচনের দাবিতে লাগাতার বিক্ষোভ, ডেপুটেশন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। অবশেষে লাগাতার ৫২ ঘন্টা ঘেরাওয়ের পর ২৫ অক্টোবর ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে কলেজ কাউন্সিলই সক্ষম – এই মর্মে নোটিস জারি হয়। ঘোষিত হয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে। ৩০ নভেম্বর নির্বাচনের তারিখ জানানো হয় ২২ ডিসেম্বর, ২০২২। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর হঠাৎ জানানো হয় এখন নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কোনো লিখিত নোটিস ছাড়াই কেবল মাত্র উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাল্পনিক হস্তক্ষেপে মৌখিকভাবেই বাতিল করা হয় নির্বাচন।
এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনো যুক্তি দেওয়া হয়নি। সুতরাং সরকারি হস্তক্ষেপেই যে ভোট বাতিল করা হয়েছে – এই সহজ সমীকরণ বুঝতে অসুবিধা নেই। প্রশ্ন ওঠে, কেন? সামান্য ছাত্র সংসদ নির্বাচন সরকারের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কী কারণে? এর উত্তর পেতে হলে আপামর স্বাস্থ্য পরিষেবার রাজনৈতিক বাতাবরণ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন।
বাকি শিক্ষাক্ষেত্রের মতই সমস্ত মেডিকাল কলেজে তৃণমূলের একাধিপত্য বর্তমান। গত বছর আর জি কর হাসপাতালের আন্দোলনের অঙ্কুর মূলেই বিনাশ করে শাসক দল। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজ, ফলে তৃণমূল সরকারের চক্ষুশূল। এমনিতেও কলেজে দীর্ঘকালব্যাপী শাসক দলের প্রতিনিধিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, চিকিৎসকবিরোধী নীতির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে তার ফলাফলে তার প্রতিফলনের সম্ভাবনা প্রবল। পরাজয় শুধুমাত্র লজ্জার নয়, শাসক দলের জন্য জন্ম দিতে পারে নতুন অস্বস্তির। কারণ স্বাধীন ছাত্রছাত্রীর সংগঠিত স্বর ছড়িয়ে পড়লে আলগা হয়ে যেতে পারে মেডিকাল কলেজগুলোতে তৃণমূল সরকারের বজ্রমুষ্টি। তাছাড়াও সাম্প্রতিক অতীতে মেডিকাল কাউন্সিল নির্বাচনে তৃণমূল সরকারের প্রার্থীদের নির্লজ্জ রিগিং এবং প্রকাশ্য দুর্নীতি নিয়ে সরকারের উপর যথেষ্ট চাপ তৈরি হয়েছে। চিকিৎসক মহলেও এর প্রভাব পড়েছে ভালরকম। তার উপর ছাত্রছাত্রীরা হাত থেকে বেরিয়ে গেলে স্বাস্থ্য রাজনীতিতে সরকারের অবস্থানকে পালটে দিতে পারে অনেকখানি।
অন্যদিকে মেডিকাল কলেজে পরিষেবা বেহাল। অধিকাংশ সময়ে জরুরি ওষুধ, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন পাওয়া যায় না, চুরি হয়ে যাচ্ছে জীবনদায়ী ইনজেকশন। সাধারণ রক্তপরীক্ষা বা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির দিন পেতেও চলে যায় মাসের পর মাস। মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য নিয়ে ধমক চমক কার্যত ফাঁকা আওয়াজ। নির্বাচিত ইউনিয়নের দায় বর্তায় স্বাস্থ্যের দাবিতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার। ফলত সামগ্রিকভাবে মেডিকাল কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন সরকারের পক্ষে শুধু অস্বস্তিকর নয়, অনভিপ্রেতও বটে।
আজকের এই আন্দোলন শুধুমাত্র ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে আবদ্ধ নয়। ক্যালকাটা মেডিকাল কলেজে পড়াশোনার ন্যূনতম পরিকাঠামোও নেই। ক্লাসঘর বা লেকচার থিয়েটারের সংখ্যা গোটা কলেজে ছটা। একটা মেরামতির জন্য বন্ধ গত চার বছর, আরেকটায় পঠনপাঠন হয় না অতিমারীর পর থেকে। অন্য একটায় আলো হাওয়া প্রায় ঢোকে না, ডেস্ক পর্যন্ত নেই। ঐতিহ্যবাহী জেনারেল লেকচার থিয়েটারে (GLT) ক্লাস চলাকালীনই ছাদ থেকে ভেঙে পড়ছে চাঙড়। বস্তুত, মাত্র দুটো লেকচার থিয়েটার পঠনপাঠনের উপযুক্ত। লাইব্রেরিতে নতুন বই নেই প্রায় বছর পাঁচেক। যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রতিদিন বদলায়, অথচ কোনো আপডেটেড জার্নাল নেই। ল্যাবরেটরির সরঞ্জাম ব্যবহারের অযোগ্য। নেই পানীয় জলের বন্দোবস্ত, খাবার অগ্নিমূল্য, শৌচাগারের হাল শোচনীয়, ছাত্রীদের হোস্টেলের অবস্থাও সঙ্গীন। সিট নেই, বাথরুমে জলের ব্যবস্থা নেই। সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ বা খেলাধুলোর ব্যবস্থার অভাবের কথা বাদই দিলাম। ছাত্রছাত্রীরা বুঝে ফেলেছে যে নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। নির্বাচিত ইউনিয়নের দাবিতে তাই ঐক্যবদ্ধ গোটা কলেজ। সমর্থন এসেছে বাইরে থেকেও। একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, সর্বতোভাবে এই আন্দোলনের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। শনিবার গণকনভেনশনের ডাক দিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা।
এই আন্দোলন এখন আর শুধু মেডিকাল কলেজের একক আন্দোলন নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
মতামত ব্যক্তিগত, তথ্য নিবন্ধকারের।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।