মানবসভ্যতার সঙ্গে অপরাধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সৃষ্টির শুরু থেকেই আধিপত্যবাদ, লোভ লালসায় ভর করে অপরাধজগতের সৃষ্টি। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রতি মুহূর্তে ঘটছে মানুষের প্রতি। কিন্তু মানুষের অপরাধের ফলে পরিবেশ যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করার কথা আজও সেভাবে আমাদের মনে হয় না।
সাম্প্রতিককালে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কায়রোতে সম্মেলন হয়ে গেল। এই সম্মেলনে উন্নত, উন্নতিশীল ও গরিব দেশ – সকলেই সামিল হয়েছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই সম্মেলনের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তার মূল বিষয় কে কত ক্ষতিপূরণ পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য। জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন বিন্যাস তৈরি করছে। এই বিন্যাসকে বলা যেতে পারে আন্তর্জাতিক পরিবেশ বাজার। এই বাজারে কেনাবেচা হবে পরিবেশকে সুস্থ রাখার যাবতীয় উপাদান। কখনোই আলোচিত হবে না পরিবেশ ধ্বংসের কারণগুলো এবং বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বার্তা অনুযায়ী বা আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী যেসব আইন দেশে দেশে তৈরি হয়েছে সেগুলোর সুনির্দিষ্ট প্রয়োগ হচ্ছে কিনা। যেমন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি আন্তর্জাতিক জলাভূমি হিসাবে স্বীকৃত, কমবেশি বিদেশি অনুদানও এসেছে বা আসবে এই জলাভূমি রক্ষা করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে জলাভূমি রক্ষার জন্য যেসব ভারতীয় আইন আছে সেগুলো কার্যকরী হল কিনা তা নিয়ে কারোর ভ্রুক্ষেপ নেই। সুন্দরবনের বাঘ বাঁচাতে আন্তর্জাতিক স্তর থেকে অর্থ আসে, কিন্তু সুন্দরবনের বনাঞ্চল রক্ষার জন্য কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে কিনা তা কখনোই পর্যালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সব দেশেই পরিবেশরক্ষার জন্য বহু আইন তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো প্রয়োগ নিয়ে কোনো আলোচনাই শোনা যায় না। অন্যান্য আইনে দণ্ডিত আসামিদের সমাজ যে চোখে দেখে, পরিবেশ আইন ভঙ্গকারীদের সে চোখে এখনো দেখতে শেখেনি। কারণ আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি পরিবেশ আইন ভেঙে চলেছি রোজ। প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ব্যবহার থেকে শুরু করে গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাট, রাস্তায় আবর্জনা ফেলা সমেত নানা পরিবেশ-অপরাধ আমরা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করে চলেছি। কোনো শিল্পপতি যদি নদীতে দূষিত জল ফেলে বা আকাশ কালো ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেয়, তাদের আমরা কখনোই পরিবেশ-অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করি না বা তাদের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদও হয় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমার ভোট আমিই দেব – এই দাবিতে আমরা যতটা সোচ্চার ও সচেতন, তার কণামাত্র প্রতিবাদ আমরা দেখি না যখন পৌরসংস্থাগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকে বা পরিবেশ আইন কার্যকর করার নামও করে না।
পরিবেশ-অপরাধ সম্পর্কে মানুষ যদি সচেতন না হয় বা পরিবেশ-অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে না ওঠে, তবে ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে সম্মেলন চলবে আর দূষণকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক অর্থ বিনিময়ের পরিকল্পনা চলবে ধনী আর গরিব দেশগুলোর মধ্যে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী নিরসন ঘটবে না। ঘটতে পারে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আইনের কার্যকারিতা, পরিবেশ-অপরাধের যোগ্য শাস্তি এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক স্তরেও পরিবেশ আইনভঙ্গকারীদের কার্যকলাপের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর নির্মলতা রক্ষা, সমুদ্রে যথেচ্ছ বর্জ্যপদার্থ ফেলা বন্ধ করা এবং সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী মারণাস্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা ও প্রয়োগ বন্ধ হওয়া আশু প্রয়োজন। কারণ যুদ্ধ এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি ভুবনজোড়া দূষণের অন্যতম কারণ।
পরিবেশ-অপরাধ ও ভারতবর্ষ
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র খাতায় ২০২১-২২ সালে ৬৪,৪৭১টি পরিবেশ-অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। বিগত চার বছরের হিসাবে সংখ্যাটা রীতিমত বেশি। এনসিআরবির Crime in India 2021 প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, মোট নথিভুক্ত অপরাধের বেশিরভাগটাই (৫৪,০২৪) সিগারেট এবং অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিধি ভঙ্গের অপরাধ। শব্দ দূষণ বিধি ভঙ্গে নথিভুক্ত হয়েছে ৭২১৭টি অপরাধ। অরণ্য বিধি ও অরণ্য সংরক্ষণ বিধি ভঙ্গের ঘটনা ২২৯২।
রাজ্যওয়াড়ি পরিবেশ-অপরাধ
পরিবেশ-অপরাধ নথিভুক্তির দিক থেকে তামিলনাড়ু সবচেয়ে এগিয়ে (৪৬,৪৫৮)। এই নথিভুক্তির ৪৬,৪৩৩টি সিগারেট এবং অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিধি সংক্রান্ত। বাকি ২৩টি শব্দ দূষণ বিধি সংক্রান্ত।
তামিলনাড়ুর পরেই রয়েছে রাজস্থান। সেখানে নথিভুক্ত মোট পরিবেশ-অপরাধের সংখ্যা ৯৩৮৭। এর মধ্যে ৭১৬৩টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে সিগারেট এবং অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিধি ভঙ্গের জন্য, ১৮৭৩টি শব্দদূষণ বিধি ভঙ্গের জন্য, ২২৪টি অরণ্য বিধি এবং ১০৬টি বন্যপ্রাণ সুরক্ষা বিধি ভঙ্গের জন্য। এর বাইরে আরও ১৯টি পরিবেশ-অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে অরণ্য বিধি এবং অরণ্য সংরক্ষণ বিধির অধীনে সবচেয়ে বেশি অপরাধ (১৩১৮) নথিভুক্ত হয়েছে। এর পরেই ঝাড়খণ্ডের স্থান (২৬৫)। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী তামিলনাড়ু, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশে দেশের প্রায় ৯০% পরিবেশ-অপরাধ ঘটে।
‘Crime in India 2021’ বলছে সবচেয়ে বেশি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, চণ্ডিগড়, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড, পঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, বিহার, অসম ও উত্তরপ্রদেশ – এই ১২ রাজ্যে। তবে অন্য দশ রাজ্যে অরণ্য বিধি ভাঙার ঘটনা কমেছে। এই রাজ্যগুলো হল মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মেঘালয় ও তেলেঙ্গানা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে অরণ্য বিধির অধীনে পরিবেশ-অপরাধের ৮৫% ঘটনা নথিভুক্ত হয়।
ইন্টারনেট, বিপন্ন বন্যপ্রাণ ও ভারত
অতি দুশ্চিন্তার খবর হল ইদানিং বন্যপ্রাণের চোরাকারবারিরা ইন্টারনেটে প্রায় ১০৬টি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাদের বেআইনি ব্যবসা বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এই তথ্য জানিয়েছে। এই সব ওয়েবসাইটের তালিকায় আমাজন, কুইকার, স্ন্যাপডিল, ইবে এবং ইউটিউবও রয়েছে। পৃথিবী জুড়ে বছরে ৭-২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চোরাশিকারের ব্যবসা হয়।
ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির কাউন্টার ওয়াইল্ডলাইফ ট্র্যাফিকিং (সিডব্লিউটি) দল ২০২০ সালে অনলাইনে প্রাপ্য সমস্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বন্যপ্রাণ চোরাকারবার সম্পর্কে এক প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘Wildlife Poaching and Illegal Trade in India: 2020’। এই প্রতিবেদনে ২০২০ সালে ভারতবর্ষের ৫২২টি বন্যপ্রাণ চোরাশিকার ও চোরাকারবারির ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (৮৯) চোরাশিকার ও চোরাকারবারের ঘটনা ঘটেছে খুরযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (Ungulates) ক্ষেত্রে।
ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে,
ভারত সরকার দেশে চোরাশিকারের ব্যাপক রমরমা সত্ত্বেও
বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে যে, ২০২০ সালে ভারতে মোট ৫২২টি বন্যপ্রাণ চোরাশিকার ও চোরাকারবারের ঘটনার মধ্যে ৫১টি ঘটেছে কর্ণাটক রাজ্যে। মোট ৫২২টি বেআইনি ঘটনার ১৭৩টিই ঘটেছিল কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বন্যপ্রাণ অপরাধ রুখতে ভারত সরকার ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে SAWEN (সাউথ এশিয়া ওয়াইল্ডলাইফ এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক) বিধি হাতে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আরও সাতটি দেশ – আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সাথে মিলে আন্তঃসীমানা বন্যপ্রাণ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবে।
ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, ভারত সরকার দেশে চোরাশিকারের ব্যাপক রমরমা সত্ত্বেও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়েছে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ সালে বন্যপ্রাণীদের বাসভূমি উন্নয়নে বরাদ্দ কমেছে ৪৭%, বাঘ প্রকল্পে কমেছে ৪০% এবং হাতি প্রকল্পে কমেছে ১৬%। কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক প্রকাশিত তথ্য (৯ অগাস্ট, ২০২১) অনুযায়ী ২০০৫-২০২১ – এই ১৫ বছরে ভারতে মোট ৫৭৯টি বাঘ মারা পড়েছে। বিগত সাত বছরে হাতি মারা পড়েছে ৬৯৬টি।
লকডাউন ও বন্যপ্রাণ চোরাকারবার
কোভিড-১৯ রুখতে ভারতে যখন লকডাউন চলছিল, তখন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ব্যাহত হয়েছিল। পৃথিবী জুড়ে বন্যপ্রাণ ব্যবসা তদারককারী সংস্থা TRAFFIC এর প্রতিবেদন থেকে একথা জানা গেছে। ‘Indian wildlife amidst the COVID-19 crisis’ শিরোনামের এই প্রতিবেদন লকডাউনের আগের ছয় সপ্তাহ (১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ – ২২ মার্চ ২০২০) এবং লকডাউন চলাকালীন ছয় সপ্তাহের (২৩ মার্চ ২০২০ – ৩ মে ২০২০) এক তুলনামূলক ছবি তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে, আলোচ্য সময়ে চোরাশিকারের ঘটনা ৩৫ থেকে বেড়ে ৮৮ হয়েছে। বন্যপ্রাণ সুরক্ষা বিধির অন্তর্গত তফসিল-১-এ অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদের চোরাশিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে। প্রাক-লকডাউন পর্বের ২২টি চোরাশিকারের ঘটনা লকডাউন কালে বেড়ে ৩৭ হয়েছিল। চোরাশিকারের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে তফসিল-৩-এ অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে। প্রাক-লকডাউন পর্বের পাঁচটি ঘটনা লকডাউনে বেড়ে দাঁড়ায় ২৮। লকডাউনের সময়ে সমস্ত চোরাশিকারের ঘটনা প্রাক-লকডাউন সময়ের তুলনায় প্রায় ১৫১% বেড়েছিল। অবশ্য এসব বেআইনি কারবারি পরিবেশ-অপরাধীদের পুলিসি ধরপাকড়ও প্রাক-লকডাউন পর্বের ৮৫ থেকে বেড়ে লকডাউনের সময়ে ২২২ হয়েছিল।
২০২০ সালে কলম্বিয়ায় সবচেয়ে বেশি পরিবেশ কর্মী (৬৫ জন) খুন হন। একই বছরে ব্রাজিলে ২০ জন, হন্ডুরাসে ১৭ জন এবং
ভারতবর্ষে চারজন পরিবেশকর্মীকে হত্যা করা হয়।
ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (ডব্লিউটিআই) জানাচ্ছে, লকডাউনে যত চোরাশিকার হয়েছে তার ৪৪% খুরযুক্ত প্রাণী। এদের পরেই হয়েছে বানর, প্যাঙ্গোলিন, বড় কাঠবেড়ালি, ভাম, খরগোশ, ছোট বনবিড়াল ও শজারুর চোরাশিকার। এসব প্রাণীর চোরাশিকার প্রাক-লকডাউন যুগের ১৭% থেকে বেড়ে লকডাউনে ২৫% হয়েছিল। এই প্রাণীদের হত্যা করা হয়েছিল মূলত তাদের মাংস খেতে এবং স্থানীয় ব্যবসার জন্য। কারণ এ সময়ে যানবাহন চলাচল ও বাজার বন্ধ থাকায় দেশের অন্যত্র বা বাইরের দেশে পাচার করা সম্ভব ছিল না বলে TRAFFIC জানাচ্ছে।
TRAFFIC আরও জানাচ্ছে, লকডাউনে বাঘ চোরাশিকারের ঘটনা বাড়েনি, তা দেশের মোট চোরাশিকারের ২০ শতাংশই থেকে গিয়েছিল। পাখি চোরাশিকার এ সময়ে ১৪% থেকে কমে ৭% হয়েছিল। উল্লেখ্য, কিছু বড় জাতের পাখিকে এ সময়ে শিকার করা হয় তাদের মাংস খাওয়ার জন্য। কচ্ছপ চোরাশিকার হয়নি। সামুদ্রিক প্রাণীদের চোরাশিকার প্রাক-লকডাউন পর্বের ১১% থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১%।
পরিবেশ শহিদ
পরিবেশ রক্ষা করতে বেআইনি কাজকর্মের বিরোধিতা করায় ২০২০ সালে দুষ্কৃতিদের হাতে সারা পৃথিবীতে ২২৭ জন মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গ্লোবাল উইটনেস ২০২০ সালে ‘লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স’ নামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশকর্মীদের জন্য দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলি মোটেই নিরাপদ নয়। ২০২০ সালে কলম্বিয়ায় সবচেয়ে বেশি পরিবেশ কর্মী (৬৫ জন) খুন হন। এর পরেই মেক্সিকো এবং ফিলিপিন্সের স্থান। খুন হন যথাক্রমে ৩০ জন এবং ২৯ জন পরিবেশকর্মী। একই বছরে ব্রাজিলে ২০ জন, হন্ডুরাসে ১৭ জন এবং ভারতবর্ষে চারজন পরিবেশকর্মীকে হত্যা করা হয়। উপরের সংখ্যাগুলি অবশ্যই পৃথিবী জুড়ে জমি ও পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশকর্মীদের উপর সন্ত্রাসের পূর্ণাঙ্গ ছবি নয়, কারণ বেশকিছু দেশে জমি ও পরিবেশ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের উপর খবরদারি চলে। ফলে পরিবেশকর্মীদের উপর নেমে আসা সন্ত্রাসের পুরো খবর মানুষের সামনে আসে না বা রেখে ঢেকে প্রচার করা হয়।
ক্রমবর্ধমান পরিবেশ-অপরাধ দমনের ব্যাপারে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বেশকিছু বড় ফাঁক বা গাফিলতি চিহ্নিত করেছে। যেমন অপরাধ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্যের অভাব, পরিবেশ-অপরাধ কী সে ব্যাপারে সার্বিক সচেতনতার অভাব, অপরাধ দমনকারী আইনের অপ্রতুলতা, পরিবেশ-অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার অভাব, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্যের অভাব, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের অভাব এবং সর্বোপরি স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে যোগসূত্রের ঘাটতি। এই বড়সড় ফাঁকগুলি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিবেশ অপরাধ দমনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি সম্মিলিতভাবে আবার চালু করা আশু প্রয়োজন। পৃথিবীর সমস্ত দেশের সমস্ত পরিবেশ-অপরাধের তথ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে এই অপরাধকে শান্তি ও মজবুত উন্নয়নের পথে এক গুরুতর বাধা ও হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করা দরকার। সবচেয়ে যা জরুরি তা হল, এই অপরাধ নির্মূল করতে সমস্ত স্তরের পরিবেশরক্ষাকারী বিধিকে আরও শক্তিশালী করে তুলে অতি দ্রুত তার প্রয়োগ করতে হবে।
আরো পড়ুন রাজনীতি যদি গরম বাড়ায়, গরম বাড়লে রাজনীতি হবে না কেন?
আইনের আলোচনায় একটি কথা খুব বলা হয় “জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনায়েড”। তাই একটি তথ্য জানানো দরকার। ২০২০ সালে আদালতে নথিভুক্ত মোট পরিবেশ-অপরাধের ঘটনা ছিল ৬১,৭৬৭। আগের অমীমাংসিত মামলা (৪৯,৯১৫) এবং নতুন মামলা (৫৩,১৩৮) শুনানির সংখ্যা মিলে আদালতে সুবিচারের জন্য ঝুলে থাকা মোট পরিবেশ মামলা শুনানির সংখ্যা ছিল ১,০৩,০৫৩। বছর শেষে ৭৭,৩৯৮টি মামলা শুনানির জন্য বকেয়া ছিল। এসব বকেয়া মামলা এক বছরের মধ্যে মীমাংসার জন্য আদালতে রোজ প্রায় ২১২টি মামলা নিষ্পত্তির প্রয়োজন। কিন্তু একদিনের মধ্যে ২১২ মামলার নিষ্পত্তি অসম্ভব। ফলে পরিবেশ-অপরাধজনিত ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মামলাকারীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন আর পরিবেশ-আইনভঙ্গকারীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ তারা বুঝেছে, তাদের শাস্তি দেবার জন্য ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এখনো প্রস্তুত নয়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।