বড় ম্যাচের এমন চেহারা আগে কখনো দেখা গিয়েছে কি? অনেক মাথা ঘামিয়েও প্রবীণ সাংবাদিকরা মনে করতে পারছেন না, পারার কথাও নয়। ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগানের ম্যাচ চলছে, অথচ গ্যালারির প্রায় অর্ধাংশ খালি, তা আবার হয় নাকি! বাঙালির ফুটবলে সাফল্য নেই বটে, ভারতীয় ফুটবলেরও এমনকি এশিয় পর্যায়ে বলার মত ফলাফল নেই বহু যুগ, কিন্তু এ রাজ্যে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ ঘিরে আবেগের তো ঘাটতি ছিল না কখনো! কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যাই থাকুক, বড় ম্যাচের আগে চিরকালই টিকিটের চাহিদা থাকত তুঙ্গে। ম্যাচ শুরুর ঘন্টা খানেক আগে থেকেই স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হত, একটার পর একটা ম্যাটাডোর লাল-হলুদ বা সবুজ-মেরুন পতাকা নিয়ে গর্জন করতে করতে ঢুকত সল্টলেকে। শনিবার এর কোনোকিছুই চোখে পড়েনি।

লেখার শুরুতেই সাফ সাফ একটা কথা বলে নেওয়া ভাল। ম্যাচের দর্শক সংখ্যা নিয়ে নির্জলা মিথ্যাচার চলছে। স্টেডিয়ামের বড় পর্দায় দাবি করা হয়েছে, ৬০ হাজার দর্শক নাকি খেলা দেখেছেন। ঘটনা হল, এই দাবির সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই৷ সংস্কারের পর বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন বা সল্টলেক স্টেডিয়ামে ৮৪ হাজার মানুষ বসতে পারেন, বড় ম্যাচের দিন ৬৪-৬৫ হাজার টিকিট ছাড়া হয়। ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) কর্তৃপক্ষের দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে হবে হাজার চারেক আসন বাদে গোটা স্টেডিয়ামই ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ম্যাচের পরের দিন সকালে কথা হচ্ছিল কলকাতা ময়দানের অত্যন্ত পরিচিত মুখ এক ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গে। টিভি চ্যানেলে কর্মরত ওই সাংবাদিক জানালেন, সন্ধে সোয়া সাতটা পর্যন্ত স্টেডিয়াম কার্যত শুনশান ছিল। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে হাজার ছয়েক এবং এটিকে মোহনবাগান গ্যালারিতে ১২-১৩ হাজার দর্শক ছিলেন। এরপর আচমকাই মাঠে বেশকিছু মানুষ ঢুকতে শুরু করেন। আটটা দশ পর্যন্ত লোক ঢুকেছে মাঠে। তাতে গ্যালারির চেহারা খানিকটা ভদ্রস্থ হয়। তারপরেও লাল হলুদ গ্যালারিতে মেরেকেটে হাজার বারো মানুষ ছিলেন, সবুজ মেরুন গ্যালারিতে সংখ্যাটা কমবেশি ২৫-২৬ হাজার। কয়েকটা ব্লকে ভিড় ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ব্লকই ছিল ফাঁকা।

একই কথা শোনালেন ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে এমন এক দৈনিকের সাংবাদিক। তাঁর মন্তব্য, “সোয়া সাতটার পর থেকে সংগঠিত পদ্ধতিতে মাঠে লোক ঢোকানো হয়েছে। সম্ভবত ‘কাদাপাড়া মেশিনারি’ ব্যবহৃত হয়েছে। তাই মোহনবাগান গ্যালারিতে লোক বেশি ছিল। তবে তাতেও গ্যালারির চেহারার খুব বেশি উন্নতি হয়নি।”

সমর্থকদের একাংশ যে বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন, তার আঁচ তো আগের দিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। অন্য বড় ম্যাচের আগে ক্লাব তাঁবুতে যে দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে, এবার সে ছবি দেখাই যায়নি। ম্যাচের দিন সকালে কলকাতার বহু এলাকায় শাসকদলের ঘনিষ্ঠরা রীতিমত লোক ডেকে টিকিট বিলি করেছেন। এই প্রতিবেদকের কাছেই বিভিন্ন সূত্র থেকে পাঁচখানা টিকিট এসেছিল। ম্যাচের আগে নেওয়া এক ‘মোহনবাগান সমর্থক’-এর ভিডিও ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, “এটিকে ২-২ গোলে ম্যাচ জিতবে”। বোঝাই যায় তিনি কেমন সমর্থক। ফলে আইএসএলের পরিচালক সংস্থা ফুটবল স্পোর্টস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (এফএসডিএল) যা-ই দাবি করুক, ম্যাচে নিঃসন্দেহে বয়কটের প্রভাব পড়েছে।

মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ বয়কট করা সমর্থকদের অধিকাংশের পক্ষেই খুব সহজ কাজ নয়। এই একটা ম্যাচ ঘিরে বাঙালির আবেগের লাভাস্রোত প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে। এ এমন এক ম্যাচ, যাতে ৫-০ গোলে হেরে একজন সমর্থক আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন। গত কয়েক বছরে হয়ত উন্মাদনা খানিকটা কমেছে, ম্যাচের আগের দিনের প্র্যাকটিসে হয়ত ভিড় উপচে পড়ে না। কিন্তু গত রবিবার যা ঘটল, তা নজিরবিহীন।

এখন প্রশ্ন হল, কলকাতার দুই বড় ক্লাবের সমর্থকদের বয়কটের পথে হাঁটতে বাধ্য করল কে বা কারা? নিঃসন্দেহে অভিযোগের আঙুল উঠবে দেবব্রত সরকার বা দেবাশিস দত্তদের দিকে। কিন্তু কলকাতা ময়দানের চলতি সংকটের আসল খলনায়ক রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রত্যক্ষ মদতে বাঙালির অতি গর্বের ক্লাব দুটো হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলের পার্টি অফিস। এর আগেও বড় ক্লাবে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল। বামফ্রন্ট আমলে উত্তর কলকাতার এক বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতার যথেষ্ট প্রভাব ছিল ইস্টবেঙ্গলে। সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, আরএসপির যতীন চক্রবর্তী, কংগ্রেস/তৃণমূলের সুব্রত মুখোপাধ্যায়রা ক্লাব রাজনীতি করতেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যা করছেন, তা হল ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বময় কর্ত্রী, যিনি এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বটে, তিনি সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে বিনিয়োগকারীর নাম ঘোষণা করছেন। এটা মুখ্যমন্ত্রীর কাজ? ক্লাবের স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু থাকবে না? যদি মুখ্যমন্ত্রীই একটা ক্লাবের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ক্লাবকর্তাদের প্রয়োজন কী? কর্মসমিতির প্রয়োজন কী?

মোহনবাগানের মত ক্লাব, যার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তারা নিজেদের ফুটবল বিভাগ কার্যত বেচে দিয়েছে। সঞ্জীব গোয়েঙ্কার এটিকে, যার প্রায় কোনো সমর্থক ছিল না, এখন শিবদাস ভাদুড়ি, গোষ্ঠ পাল, চুনী গোস্বামী, শৈলেন মান্নার মোহনবাগানের মাথার উপর বসে আছে। যে বছর মোহনবাগান আই লিগে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়ে শিরোপা ছিনিয়ে নিল, তারপরেই শোনা গেল এটিকের সঙ্গে বহু বিতর্কিত মোহনবাগানের মিশে যাওয়ার ঘোষণা। কোটি কোটি সমর্থককে কার্যত প্রতারিত করছেন মোহনবাগান কর্তারা। তাঁরা দাবি করছেন, এটিকে একটা কোম্পানি মাত্র। অতীতে যেমন ম্যাকডাওয়েলের না মোহনবাগানের আগে বসত, এও তেমনই একটা ব্যাপার।

অথচ ব্যাপার মোটেই সেরকম নয়। গোয়েঙ্কা চাইলে সিইএসসি বা তাঁর মালিকানাধীন অন্য কোনো কোম্পানির নাম মোহনবাগানের আগে জুড়তে পারতেন। তিনি তা করেননি। এটিকে একটা ফুটবল ক্লাব, নতুন ক্লাব। তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগানের নাম। অথচ গুগল করলেও দেখা যায় ক্লাবের জন্মসাল লেখা রয়েছে ২০২০। মোহনবাগানের মত ক্লাব, যা জাতীয় সম্পদ, গোটা দেশের গর্ব, তাকে নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলার অধিকার কর্মকর্তাদের কে দিয়েছে?

আরো পড়ুন আইএসএল-এ দুই প্রধান: মোক্ষলাভ, না মহাপ্রস্থান পর্বের সূচনা?

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অবস্থাও শোচনীয়। বছরের পর বছর ক্লাবে নতুন সদস্য নেওয়া হয় না। নির্বাচনের প্রহসন করে ক্ষমতা দখল করে রাখে শাসকগোষ্ঠী। আধুনিক ফুটবল সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকা কিছু লোক ক্লাবের দখল নিয়ে রেখেছে, যাদের নিজেদের বিনিয়োগকারী আনার কোনো ক্ষমতাই নেই। মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পায়ে ধরে বিনিয়োগকারী জোটাতে হয়। তারপর প্রতি বছর শেষ লগ্নে দল গড়া হয়। হারের পর হার, বিনিয়োগকারীর সঙ্গে নিত্য ঝামেলা, অবশেষে তাদের বিদায়। তারপর আবার একই নাটক গোড়া থেকে আরম্ভ – এই হয়ে দাঁড়িয়েছে রুটিন। ক্লাবকর্তাদের বিরুদ্ধে কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ডগলাসের মত প্রাক্তন ফুটবলার এসব নিয়ে মুখ খুলেছেন।

সবমিলিয়ে কলকাতা ময়দানে এখন যা চলছে, তাতে যে কোনো ক্রীড়াপ্রেমীর গা গুলিয়ে ওঠার কথা। একদিকে আইএসএলের মত অবনমন না থাকা লিগকে দেশের সর্বোচ্চ লিগে পরিণত করা, দেশের ফুটবলের আসল ক্ষমতা সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) হাত থেকে এক বেসরকারি সংস্থার হাতে চলে যাওয়া, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কলকাতার দুই প্রধানের অপদার্থ কর্তাদের কাজকর্ম। এতকিছুর ফলশ্রুতি ময়দানের বর্তমান পরিস্থিতি। এই অন্ধকার থেকে কলকাতার ফুটবলকে বের করে আনতে পারে কেবলমাত্র সমর্থকদের লড়াকু আবেগ, সংঘবদ্ধতা, দীর্ঘ আন্দোলন। তবে কাজটা অসম্ভব না হলেও ভীষণ শক্ত।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

2 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.