আন্দোলনের নামে সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে প্রয়োজনে অভিযুক্তের সম্পত্তি নিলাম করে ক্ষতিপূরণ আদায়। গঙ্গারতি থেকে শুরু করে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস – যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যকেই অনুসরণ করে চলেছে দিদির রাজ্য। সরকারি উদ্যোগে গঙ্গারতির কর্মসূচি এর আগেই নেওয়া হয়েছে। দীঘাতে সরকারি উদ্যোগে মন্দিরও হবে। রাষ্ট্র আর ধর্মের মধ্যে কোনো দূরত্ব আর অবশিষ্ট নেই। ধর্মীয় উৎসবে অঢেল অর্থ খরচ এবং কায়দা করে সরকারের নাক গলানোর কর্মসূচি বিজেপিশাসিত যে কোনো রাজ্যের থেকে বাংলায় কম হচ্ছে না। এবার আন্দোলন দমনেও সেই বিজেপির পথ অনুসরণ।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজ্য বিধানসভায় মেনটেন্যান্স অফ পাবলিক অর্ডার আইনের সংশোধনী গৃহীত হল। এই আইনে বলা হয়েছে, কোথাও সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষতি হলে ৬০ দিনের মধ্যে অভিযুক্তকে চিহ্নিত করে সরকার আদালতে জানাবে এবং ১৮০ দিন, অর্থাৎ ছমাসের মধ্যে পুলিস রিপোর্ট জমা দেবে। জরিমানা আদায়ের জন্য প্রয়োজনে অভিযুক্তের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলাম করে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক আন্দোলন, হিংসাসহ যে কোনো ঘটনায় কেউ সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করলেই এভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। এতদিন আইন অনুযায়ী শাস্তির মেয়াদ ছিল সর্বোচ্চ ছ মাসের কারাবাস। সংশোধিত আইন অনুসারে কারাবাসের মেয়াদ সর্বনিম্ন ছমাস থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর হতে চলেছে। ধ্বংস হওয়া সম্পত্তির বাজারদর অনুসারেই জরিমানার পরিমাণ ঠিক হবে। ঘটনাচক্রে সেদিনই ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষা দিবসের ইতিহাস যে কোনো আধিপত্যবাদ বিরোধিতার ইতিহাস। সেই দিনেই রাজ্যে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদের নতুন অধ্যায় আরম্ভ হল। কী অদ্ভুত সমাপতন!

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সরকারের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে কোনো আন্দোলন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দমনে সংশোধিত আইন প্রয়োগ করা হবে। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন প্রতিবাদের কর্মসূচি নিলে শাস্তি নেমে আসবে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির উপর। সৌন্দর্যায়নের ক্ষতি করলেও এই শাস্তি হবে। অর্থাৎ প্রতিবাদ বা ধর্নার নামে সামান্য কিছু ঘটলেই ওই আইন বলে চরম শাস্তি দেওয়া যাবে। বিচারের নামে প্রতিবাদী বা বিরোধীদের চাঁদমারি করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হবে। এমনকি, প্রশাসন বা শাসক দল নিজেরাই সম্পত্তি নষ্ট করেও প্রতিবাদীদের ফাঁসাতে পারে। কেন্দ্রীয়ভাবে তো বটেই, স্থানীয় স্তরে নানা বিষয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অবস্থান হয়। এটা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সংশোধিত আইন বলে ঘুরপথে সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। সম্পত্তি নিলাম হওয়ার ভয় গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষেরই বেশি। তাই কার্যত তাঁদের প্রতিবাদ করার অধিকার হরণের সুযোগও বেশি। কোনো দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারি অফিসে গেলে বা আর্থিক প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই এই অস্ত্র প্রয়োগ করা হবে। ধরা যাক, আবাস যোজনা বা একশো দিনের কাজ নিয়ে অভিযোগ জানাতে কয়েকজন পঞ্চায়েত বা পৌর দপ্তরে গেলেন। তাঁরা সম্পত্তির বা দপ্তরের সৌন্দর্যায়নের ক্ষতি করেছেন বলে মিথ্যা অভিযোগ এনে ফাঁসিয়ে দেওয়া যাবে।

দেশ তথা রাজ্যজুড়ে রাষ্ট্রের প্রতিবাদ দমনের অপচেষ্টায় সেই আশঙ্কা আরও প্রবল। এ এমন এক সময় যখন অভিযোগকারীকেই অভিযুক্ত করে কারান্তরালে পাঠানো হচ্ছে। একের পর এক মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে। দিল্লি গণহত্যা কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রতিবাদীদেরই ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে এখন গণধর্ষণের সংবাদ পরিবেশন করতে গেলেও সাংবাদিককে জেলে ভরা হয়। এই রাজ্যও ব্যতিক্রম নয়। বিধায়কের পূর্ব ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচাল করে পুলিস তাঁকে গ্রেপ্তার করে, একের পর এক মামলা যোগ করে কারান্তরালে রাখা হয়। সংশোধিত আইন বলে তাঁকে ফাঁসানোর সুযোগ আরও বেশি। একজন বিধায়কেরই যখন এই অবস্থা, সাধারণ মানুষের অবস্থা তখন সহজেই অনুমেয়। দেশ তথা রাজ্যজুড়ে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা।

বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেত্রী থাকার সময়ে ইউএপিএর বিরোধিতা করেছিলেন। এখন সেই আইনেরই যথেচ্ছ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সামান্য সভা, মিছিল করতে গেলেও নিয়মের জটিলতায় তা বানচালের চেষ্টা চলছে। ধর্মঘট দমনে সরকার অগণতান্ত্রিক পথ গ্রহণ করছে। এমনকি প্রতিবাদ সভা করতে গেলেও নিয়মের জটিলতায় সরকারি হল পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। শাসক দল আর প্রশাসনের মধ্যে ন্যূনতম বিভাজনরেখাও আজ আর নেই। মুখ্যমন্ত্রীসহ রাজ্যের মন্ত্রীরা সরকারি অনুষ্ঠানকে দলীয় সভায় পরিণত করেন। শাসক দলের কর্মসূচিতে না গেলে আশা, আইসিডিএস, মিড ডে মিলসহ নানা প্রকল্পের কর্মীদের হেনস্থার শিকার হতে হয়। এই অবস্থায় পুলিসকে দিয়ে সম্পত্তি নষ্টের মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রতিবাদীকে ফাঁসানো তো জলভাত। শাসক দলের নেতা বা মদতপুষ্ট মাফিয়াও প্রতিবাদীদের ফাঁসিয়ে দিতে পারে। হয়ত জলাশয় বোজানো বা গাছ কাটার জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলেন। এসব দুষ্কর্ম প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই করে থাকে। প্রশাসন এবং শাসক দলের সঙ্গে এদের দহরম থাকে। এখন প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রতিবাদীদের উলটে চরম শাস্তি দিতে পারবে। আইনের এসব মারপ্যাঁচ নতুন নয়, কিন্তু প্রতিবাদীদের সম্পত্তি পর্যন্ত নিলামের আশঙ্কা থাকলে কতজনই বা প্রতিবাদ করতে সাহস পাবেন?

যে রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতিতে মন্ত্রী থেকে শুরু করে শাসক দলের নেতা বা ঘনিষ্ঠদের নাম জড়িয়ে যায়, রাজ্যের নানা জায়গায় কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়, সে রাজ্যে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে এভাবেই স্তব্ধ করে দেওয়া হবে। চাকরির আশায় যাঁরা প্রতারিত হলেন, লক্ষাধিক টাকা যাঁদের নষ্ট হল, তাঁদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? নয়া আইনে ছমাসের মধ্যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এদিকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেটে গেলেও নিয়োগ দুর্নীতির নায়ক-নায়িকাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার পরেও অভিযুক্ত দিব্যি মামলা চালানোর জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা  খরচ করতে পারেন, তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয় না। এসবের প্রতিবাদ করতে গেলেই বরং প্রতিবাদীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এরপরেও স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসের নামে নাগরিকের অর্থে চলবে সরকারি মোচ্ছব।

সিএএবিরোধী আন্দোলন দমনে এভাবেই আইন প্রণয়ন করেছিল উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার। সেই আইন প্রয়োগ করে নাগরিকের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বুলডোজার দিয়ে বাসস্থান ভেঙে দেওয়া এখন রাষ্ট্রের বীরত্বের প্রতীক। দেশের নাগরিকদের উপরেই সেই বীরত্ব দেখানো হয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে দেশজুড়ে বুলডোজাররাজ কায়েম করার বিচার করবে কে? প্রচারমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা – সবই সরকারের খবরদারিতে বিপন্ন, পরাধীন। আমাদের রাজ্যের চিত্রও আলাদা নয়। আদিত্যনাথের অনুপ্রেরণায় দিদি আন্দোলন দমনে আইন সংশোধন করেন। এখানেও বিচারপতির এজলাস বয়কটের নামে খোদ হাইকোর্টে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা হয়।

আরো পড়ুন রামনবমী এখন প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার উদযাপন

প্রতিদিন তৃণমুল-বিজেপির তরজার নাটক চলে, আর সেই নাটকের আড়ালে আসলে দুই দলের সরকারই গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞে নামে। কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপিশাসিত রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে তৃণমূল সরকারের পার্থক্য মুছে যাওয়ার পথে। একদিকে কর্পোরেটদের প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুঠের বিপুল আয়োজন – কর্পোরেট লুঠের সুযোগ করে দিতে ছত্তিশগড়ে আকাশপথে নাগরিকদের উপর আক্রমণ নেমে আসে, এ রাজ্যে দেউচা পাঁচামি কয়লাখনির জন্য রাষ্ট্রীয় দমন চলে। গৌতম আদানিকে বিদ্যুৎ ব্যবসার সুযোগ করে দিতে মুর্শিদাবাদ জেলায় আমবাগান ধ্বংস করা হয়। তার প্রতিবাদ করলে পুলিস হামলা চালায়। বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ এনে এবার থেকে কর্পোরেটবিরোধী আন্দোলনকারীদেরও চরম শাস্তি দেওয়া হবে নির্ঘাত। তাদের প্রকল্পের বিরোধিতা করলেই কর্পোরেটের সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে বলে প্রতিবাদীদের সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে। অথচ উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করলে তার শাস্তি হবে না।

নয়া উদারনীতির বিকাশ বা তথাকথিত উন্নয়নের পথকে প্রতিবাদহীন করতেই গণতন্ত্র ধ্বংসের বিপুল আয়োজন। ‘ভয়েসলেস গ্রোথ’-এর এক সন্ত্রাসের রাজত্ব। নয়া উদারনীতি এটাই চায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নয়া উদারনীতির শত্রু। তাই মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের কর্তব্যের কথা মনে করানো হয়। প্রতিবাদহীনতাই এখন দেশপ্রেমিক, কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হওয়ার একমাত্র পরিচয়। রাষ্ট্রের সুরে সুর মেলাতে হবে। না হলেই শায়েস্তা করার, ভিটে মাটি চাঁটি করার রাষ্ট্রীয় আয়োজন। সেই আয়োজনে দেশ তথা রাজ্য এক বদ্ধ কারাগারে পরিণত হচ্ছে। মুক্ত চিন্তার পরিসরটা ছোট হতে হতে বিলোপের পথে। রাজ্য সরকারের সংশোধিত আইন তারই অঙ্গ। গণতন্ত্র আর রাষ্ট্র আজ সম্মুখসমরে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করা এখন নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.