সায়ন গুপ্ত

দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যেই সোশাল মিডিয়া সরগরম হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই আলোড়নের স্পর্শ থেকে বঞ্চিতই থাকে বাংলার কৃষক সমাজ। রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সরকার যেমন উদাসীন, ঠিক তেমনই বিরোধী দলগুলোরও মাথাব্যথা নেই। কৃষক বাঁচলেন, না মরলেন – তাতে কারোর কিছু এসে যায় না।

এই নাতিদীর্ঘ ভূমিকার কারণ হল রাজ্যের আলু চাষিদের বর্তমান দুরবস্থা এবং তা নিয়ে সব মহলের চূড়ান্ত অবহেলা। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলায় আলু চাষিদের সংকট চরমে উঠেছে। কোনো জেলাই অবশ্য ব্যতিক্রম নয়। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সরকারের উদাসীনতা নিয়ে বিরোধী দলগুলোও তেড়েফুঁড়ে আন্দোলনে নামছে না। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও এই খবর প্রায় থাকেই না। ফলে অসহায় কৃষক যে তিমিরে ছিলেন সে তিমিরেই আছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

পরিমল মণ্ডল, বিজয় মণ্ডল, অধিবাস মণ্ডলরা মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমার লাহারপাড়া অঞ্চলের নামকরা আলু চাষি। ছেলেবেলা থেকে তাঁদের জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই কেটে গিয়েছে চাষের জমিতে। বিঘের পর বিঘে জুড়ে আলু চাষ করেন তাঁরা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই কৃষকরা একেবারেই ভালো নেই। চাষের খরচ কয়েক বছরে প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সরকার কোনো সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। লাভ হওয়া তো দূরস্থান, বছরে ৮,০০০ থেকে ৯,০০০ টাকা লোকসানে আলু চাষ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।

আলু চাষিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, তাঁদের মূলত দুটো জিনিসের প্রয়োজন হয়। একটা ছত্রাক মারার জন্য প্রয়োজনীয় Dithane M-45, অন্যটা ইফকো কোম্পানির সার NPK 10-26-26। আগে Dithane M-45-এর দাম ছিল ২৭০ টাকা/কেজি। এখন ৫১০ টাকা/কেজি, কখনো কখনো ৫২০ টাকাও দিতে হয়।

অন্যদিকে, NPK 10-26-26 সারের দাম সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ১,৪০০ টাকা/কেজি। কিন্তু সরকার পরিচালিত যে কোনো কৃষি সমবায় সমিতি থেকে এই সার কিনতে হয় ১,৭১০ টাকা/কেজি দামে। কী কারণে ৩১০ টাকা বেশি লাগছে? এর উত্তর না আছে সমবায় সমিতির আধিকারিকদের কাছে, না কৃষকদের কাছে। এরকম প্রত্যক্ষ কালোবাজারি চলছে রাজ্যের প্রায় সমস্ত সমবায় সমিতিতে। তার উপর অনেকসময় সমবায় সমিতিতে এই সার পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে সারের দোকান থেকে কিনতে হয়। এই সার প্রয়োগে আলুতে ফসফরাস ও নাইট্রোজেনের মাত্রা সঠিক হয় এবং আলুর কোনো রোগ হওয়ার ভয় থাকে না। ফলে এই সার না কিনে উপায়ও নেই।

অধিবাস তাঁর চাষ করা একদম পাশাপাশি দুটো আলু চাষের জমি দেখালেন। একটায় সবুজ হয়ে আলুর গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর ঠিক তার পাশের ক্ষেতেই সমস্ত আলুর গাছ মরে কালো হয়ে গিয়েছে। কারণ জিজ্ঞেস করতে হল না। অধিবাস, বিজয় নিজেই বলতে শুরু করলেন, “এই যে মরা ক্ষেত দেখছেন আমার, এইখানে ধসা রোগ হয়েছে। টাকা জোগাড় করেও সঠিক সময়ে সার পাইনি। সরকার থেকে ঘোষণা দিল NPK 10-26-26 সার প্রতি কেজি ১,৭১০ টাকায় গ্রামের সমবায় সমিতি থেকে দেবে। ভোরবেলা থেকে গ্রামের চাষিরা লাইন দিলাম সমবায়ের মাঠে। বেলা দশটার সময় সমিতি খুলল। গুদাম ভর্তি NPK 10-26-26 রাখা আছে। সেদিন সবাইকে খানিকটা করে সার দিল। সকলে একটি করে প্যাকেট পেলাম। আবার লাগলে সমবায় সমিতি থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার কথাও জানাল সমিতি। পরেরদিন সমিতিতে গিয়ে দেখলাম গুদাম ফাঁকা, একটাও NPK নেই। এক বিঘা জমিতে কম করে তিনটে NPK 10-26-26 লাগে। একটায় কী হবে? আমার পাঁচ বিঘে জমি, বাকি প্রায় ১৪ প্যাকেট কিনতে হল ব্ল্যাকে। একেকটা প্যাকেট সারের দাম ২,৩০০ টাকা/কেজি।”

কৃষকরা জানালেন, এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে গেলে শুরুতেই এক ঘন্টা ট্র্যাক্টর দিয়ে চষিয়ে মাটি তৈরি করতে হয়। এক ঘন্টার ট্র্যাক্টরের ভাড়া ১,২০০ টাকা। এরপর আছে পাঞ্জাব থেকে আসা আলুর বীজের দাম – এক বস্তা ২,৮০০ টাকা। প্রতি বিঘেতে পাঁচ বস্তা বীজ ফেলতে হয়, তাহলে মেরেকেটে ৭০-৮০ বস্তা আলু ওঠে। এক বিঘে চাষ করার জন্য প্রথমে ১৪ হাজার টাকার বীজ দিতে হবে, তারপর NPK 10-26-26 ও Dithane M-45 দিতে হবে প্রায় ৭,৫০০ টাকার। ট্র্যাক্টর ভাড়ার কথা আগেই বললাম। বিদ্যুৎ বিল প্রায় বছরে ৭,০০০-৮,০০০ টাকা। অতএব এক বিঘে জমিতে আলু চাষ করতে লাগাতে হবে ২৮,০০০ টাকা।

এত কিছু করার পরে ৭০ থেকে ৮০ বস্তা আলু পাওয়া যাচ্ছে, যার মহাজনের বাজারে মূল্য খুব বেশি হলে ২৫০ টাকা বস্তা। এক বিঘে জমির আলু বিক্রি করে হাতে আসবে মাত্র ২০,০০০ টাকা। এদিকে চাষ করার জন্য আগেই ২৮,০০০ টাকা খরচ হয়ে যাবে। তবু ওঁদের চাষ করতেই হবে। জমি, মাটি আর ঘাম ছাড়া ওঁদের কোনো সম্বল নেই।

আরো পড়ুন এখন চৈত্র মাস, পেঁয়াজ দামি অথচ চাষির সর্বনাশ

বিজয় মণ্ডল নামে এক কৃষক বলছিলেন, আগে কেজিতে ২৭০ টাকা দাম ছিল ডাইথেনিয়ামের। কেজিতে ১,৪০০ টাকা দাম ছিল NPK 10-26-26 সারের, আজ যা কিনতে হয় ২,৩০০ টাকা দিয়ে। বাজারে ধার হয়ে যায়, আলু চাষ করে নিজের ঘরে খাওয়ার আলুটুকু পর্যন্ত থাকে না। এভাবে চলতে থাকলে চাষ বন্ধ করে দিতে হবে।

রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের মতই আলু চাষ নিয়ে উদাসীন। প্রত্যেক ব্লকে হিমঘরে আলু রাখার পরিকাঠামো আজ ধ্বংসের মুখে। বাজার থেকে আলুর খামারে এসে আলু নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মহাজনদের উদাসীনতা কৃষকদের বাজারে আলু পাঠানোর খরচ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। হিমঘরে আলু রাখার সঠিক পরিকাঠামো না থাকার জন্য অনেকসময় অনেক আলু পচে যায়। তাই অনেক কম দামে খুচরো হিসাবে মহাজনদের আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। এমতাবস্থায় চাষিদের ঘরে আগে যেখানে গোটা বছরে এক বিঘে জমি চষে ১৪-১৫ কুইন্টাল আলু থাকত, এখন সেই পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮-৯ কুইন্টালে।

সারা ভারত কৃষক সভার মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক আবু বাক্কার বললেন, “সারা ভারত কৃষক সভার পক্ষ থেকে একাধিকবার বিভিন্ন বিডিও অফিসের মাধ্যমে সরকারকে জানানোর চেষ্টা করা হয়েছে, ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে আলু কিনতে হবে। কমপক্ষে কৃষক পিছু ১০০ বস্তা করে আলু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে প্রতিটি ব্লকের হিমঘরে, সমবায় সমিতিগুলোকে কম দামে সার বিক্রি করতে হবে”। আবু বাক্কার আরো বলেন, আগামী দিনে রাজ্য কনভেনশনের পর প্রত্যেক ব্লকে আলু নিয়ে কনভেনশনের মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করে বৃহত্তর লড়াই আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।” যদিও জেলায় জেলায় এখনো তেমন কোন আন্দোলন, বিক্ষোভের ছবি দেখা যায়নি।

নিবন্ধকার মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দির বাসিন্দা। স্বাধীন সাংবাদিক, আলোকচিত্রী। পছন্দের বিষয় চাষবাস, লোকসংস্কৃতি। তথ্য ও মতামত নিবন্ধকারের

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.