বৃষ্টিতে এক-দুদিন দাম বাড়ে তো পরদিনই দাম পড়ে যায়। দিন ১৫-২০ আগে বেচলে ছিল ডাহা লোকসান। এখন লোকসান হলেও, তা আগের থেকে কম। পরে বিক্রি করলে লাভ না লোকসান কী হবে, কেউ জানে না। শেয়ার বা সোনার বাজারের দাম নয়, রাজ্যের আলু চাষিদের অবস্থার কথা হচ্ছে। বাংলা ক্যালেন্ডার বলছে, চৈত্র মাস পড়ে গেছে। এতদিন দক্ষিণবঙ্গে মাঠে আলু থাকার কথা নয়। এই মরসুমে এখনো অনেক কৃষক আলু মাঠ থেকে তোলেননি। প্রথম দিকে যাঁরা তুলেছিলেন, তাঁদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। মাঝে দাম কিছুটা বেড়েছিল, এখন আবার পড়তির দিকে। প্রতিদিন বাজারে আলুর দর ওঠানামা করছে। আড়তদার, হিমঘরের মালিক, ভিন রাজ্য থেকে আলু আসা, এ রাজ্যের আলু ভিন রাজ্য বা বাংলাদেশে চলে যাওয়া – বাজার অর্থনীতির জটিল হিসাবে কৃষক অসহায়। ফসল যাঁরা ফলান, তাঁদের হাতে কিছুই নেই। অথচ শেখানো হয়, বাজার অর্থনীতি নাকি ক্রেতা-বিক্রেতা সকলকেই স্বাধীনতা দিয়েছে। বাস্তবে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে থাকা আড়তদার, বন্ডের ফাটকা কারবারি থেকে শুরু করে ছোট-বড় কোম্পানিই বাজারের কর্তা। আলু যাঁরা ফলান আর আলু যাঁরা খান তাঁদের কোনো স্বাধীনতাই থাকে না। মাঝে মাঝে হইচই বেশি হলে সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার নাটক করে। তাতে খাজনার থেকে বাজনাই বেশি। ঘোষণা, প্রচারের চমকে কৃষক বা ভোক্তা – কারোরই লাভ হয় না। আলু চাষের উপকরণ কেনা থেকে আলু বিক্রি – গোটা বাজারটাই কৃষকের জন্য অনিশ্চিত। শেয়ার বাজারের ঘুঘু ফাটকা কারবারিও ঘোল খেয়ে যেতে পারেন।
বর্তমান মরসুমেও বীজ থেকে সার – সবকিছুর দামই ওঠানামা করেছে। একজন কৃষক আজ যে দরে সার কিনতে পেরেছেন, দুদিন পরে তার থেকে কম বা বেশি দামে কিনেছেন। কখন কিনলে কম দামে পাওয়া যাবে তার হিসাব সহজ নয়। আবার হিসাব জানা থাকলেও ছোট, প্রান্তিক কৃষকের হাতে সবসময় টাকাও থাকে না। একসঙ্গে অনেকখানি কিনতে সকলে পারেন না। নগদে না কিনতে পারলে দাম বেশি। তাই ছোট, প্রান্তিক কৃষক ঠকেও যান বেশি। যেমন ধরা যাক, এনপিকে ১০:২৬:২৬ সারের দাম। কেউ কিনেছেন ১,৮০০ টাকা প্যাকেট দরে, তো কেউ ২,৩০০ টাকা প্যাকেট। স্থান ও সময় ভেদে দামের ফারাক বিপুল। তাই বিঘে প্রতি খরচের ফারাক ১,৫০০ টাকা বা তার বেশি। সারের কোম্পানি তো দাম বাড়িয়েই চলে। তার উপরে কোম্পানির নির্ধারিত দামেও সার পাওয়া যায় না। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্যাকেটে ছাপানো এমআরপির থেকে বেশি দামে কৃষকদের সার কেনাটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সরকার, শাসক দল সব জানে। মাঝে মাঝে সরকারি কর্তারা দোকানে হানাও দেন। কিছুদিন হয়ত দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে, তারপর যে কে সেই। দোকানের বোর্ডে লেখা দামে সার বিক্রি হয় না। অনেকেই বিলও দেয় না। তাই কালোবাজারির কোনো প্রমাণও থাকে না। কোনো বিক্রেতা সঠিক দামে সার বিক্রি করতে চাইলে, অন্য বিক্রেতাদের চাপের মুখে পড়েন বলেও অভিযোগ। তার চেয়ে কালোবাজারির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাই সরকারি কর্তা, শাসক দলের মাতব্বরদের কাছে লাভজনক। এই লাভ অনেক সময়ে অর্থমূল্যে হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। কৃষি দপ্তর থেকে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তার পরিমাণও কম নয়। বাস্তবে খুব কম কৃষকই সেসব পান। আবার তার গুণমান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। বীজের ক্ষেত্রেও কালোবাজারি হয়।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
চলতি মরসুমে জ্যোতি আলু চাষে শুধুমাত্র কৃষি উপকরণেই মোটের উপর বিঘে প্রতি খরচ হয়েছে ২৪,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা। চন্দ্রমুখীর ক্ষেত্রে আরো ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা বেশি। কৃষি উপকরণের খরচ কেবল হিসাব করলেই চলে না। এরপরে রয়েছে ঋণের সুদ। সরকারি কৃষি ঋণ সকলে পান না। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বা মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানিগুলির থেকে ধার করা টাকা চাষের কাজে খরচ হয়। মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানিগুলির সুদের বার্ষিক হার ২০ শতাংশের বেশি। নানা কোম্পানির নানারকম। মহাজনের থেকে ৩০ শতাংশের বেশি সুদেও ধার নেওয়া হয়। রয়েছে গয়না বন্ধক রেখে চাষের প্রচলন। ফলে একজনের হয়ত জ্যোতি আলু চাষে উপকরণে খরচ লেগেছে ২৪,০০০ টাকা। তিনি হয়ত মহাজনের থেকে ৩০% বার্ষিক সুদের হারে ধার নিয়েছেন। তাঁর সুদের খরচ পড়ছে প্রায় ২,০০০ টাকা (আলুর জন্য তিন মাস ধরে)।
এই মরসুমে বিঘে প্রতি আলুর ফলন কম হয়েছে। যে চাষির বিঘে প্রতি ১০০ থেকে ১২০ বস্তা আলু হত, তাঁর হয়েছে ৮০ বস্তা (৫০ কেজি আলুতে এক বস্তা হিসাবে)। যাঁর ৮০ বস্তা হত, তাঁর হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ বস্তা। গড়ে ৭০ বস্তা ফলন ধরলে এবং সরকারি কৃষি ঋণ পেলেও বস্তা পিছু খরচ প্রায় ৪০০ টাকা। এটা কম করে দেখানো হল। অধিকাংশ কৃষকই সরকারি কৃষি ঋণ পান না। এর জন্য দায়ী সরকারের অযৌক্তিক নিয়ম। নিজের নামে জমির নথি থাকলে তবেই তিনি সরকারের কাছে কৃষক। কৃষিজমির মালিক আর কৃষক সরকারের কাছে সমার্থক। অন্যের জমিতে ভাগে, চুক্তিতে অথবা জমি ভাড়া বা বন্ধক নিয়ে চাষ করা প্রায় কোনো কৃষক এই সুযোগ পান না। খাস জমিতে চাষ করা পাট্টাহীন কৃষকেরও একই অবস্থা। অনেক জমির মালিক নিজে চাষ করেন না। জমির মালিক হিসাবে কৃষি ঋণ নিয়ে মহাজনী কারবার করেন। সরকার দেখায় কতজনকে কৃষি ঋণ দেওয়া হল। কিন্তু কতজন প্রকৃত কৃষক তা পেলেন, তার হিসাব নেই। কেন্দ্র ও রাজ্য – দুই সরকারেরই এ বিষয়ে অদ্ভুত মিল। অন্যের জমিতে ভাগে বা চুক্তিতে চাষ করলে পাকাপোক্তভাবে লিখিত নথি থাকে না। তাই কৃষকের নিজেকে কৃষক প্রমাণের নথিও নেই। বর্গায় নাম উঠে যাওয়ার ভয়ে ভাগচাষি বা চুক্তিচাষির সঙ্গে সচরাচর মালিক লিখিত চুক্তি করেন না। তৃণমূলের আমলে বর্গা রেকর্ড বা পাট্টা বিলির কাজও প্রায় বন্ধ। মাঝেমধ্যে মন্ত্রীমশাই বা শাসক দলের নেতাদের প্রচারের জন্য হইচই করে কয়েকজনকে দেওয়া হয়।
ভাগ, চুক্তি, ভাড়াটে চাষিদের যেমন বেশি সুদে ধার নিতে হয়, তেমন অন্য খরচও রয়েছে। একজন ভাগ চাষির হয়তো বিঘেতে ৭২ বস্তা আলু হয়েছে। ফলনের সিকি ভাগ জমির মালিককে দিতে হলে ১৮ বস্তা দিতে হবে। তাহলে তিনি বিক্রির জন্য পাবেন মাত্র ৫৪ বস্তা আলু। জমির মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে বন্দোবস্ত থাকলে বা জমি ভাড়া নিলেও, হয় আলু নয় টাকা দিতে হবে। সেই হিসাবে অনেকের খরচ বস্তা পিছু ৬০০ টাকারও বেশি হবে। এই হিসাব জ্যোতি আলুর ক্ষেত্রে। কৃষক দাম পাচ্ছেন কত? এবারে জ্যোতি আলু অনেকেই প্রথমে বস্তা পিছু ৩০০ টাকারও কম দামে বিক্রি করেছেন। পরে দাম কিছুটা বাড়ে। রাজ্য সরকার অনেক পরে সহায়ক মূল্য ঘোষণা করেছে কুইন্টালে ৬৫০ টাকা, অর্থাৎ বস্তায় ৩২৫ টাকা। হিসাব বলছে বস্তায় ৪০০ টাকা পেলেও অধিকাংশের লাভ হবে না। এখন দুদিন বর্ষায় দাম ওঠানামা করছে। জ্যোতি আলুর দাম বস্তায় ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। চন্দ্রমুখী ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। এরপর দাম না বাড়ারই সম্ভাবনা। কারণ হিমঘর আলু কেনা বন্ধ করে দিলে বা কমিয়ে দিলে দামও পড়বে। সরকার সহায়ক মূল্য ঘোষণা করল অনেক পরে। সেই দামেও কৃষকদের লোকসান হবে। এই দাম ঘোষণায় কৃষকদের লাভের বদলে লোকসানই হল। কারণ আড়তদাররাও আর বেশি দাম বাড়াবে না। যাঁদের আলু রেখে দেওয়ার আর্থিক সামর্থ আছে, তাঁরা ভবিষ্যতে দাম বাড়লে লাভ করতে পারেন। কিন্তু প্রান্তিক কৃষক, মহাজনের থেকে ধার নিয়ে চাষ করা কৃষকের হাতে নগদ টাকা চাই। তাঁদের খরচও যেমন বেশি, তেমন আলু মজুত রাখার সুযোগও কম।
রাজ্য সরকার এভাবেই কৃষক দরদী সেজে আসলে আলু কারবারিদের সুবিধা করে দিল। সরকার খরচ হিসাব করার সময়ে কালোবাজারিতে কৃষক কত দামে বাস্তবে সার বা বীজ কিনেছেন তা ধরে না। মহাজনী বা মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানির উচ্চ সুদের হিসাব করে না। ভাগ, চুক্তি, ভাড়া চাষির বাড়তি খরচের হিসাব করে না। কারণ তাহলে স্বীকার করতে হয় যে কালোবাজারি হচ্ছে, সকলে সরকারি কৃষি ঋণ পাচ্ছেন না। কৃষকদের আয় বৃদ্ধির গপ্পের পর্দা তখন ফাঁস হয়ে যাবে। স্বামীনাথন কমিশনের ফর্মুলা অনুসারে চাষের খরচের হিসাব ও তার দেড়গুণ সহায়ক মূল্যের প্রস্তাব কেন্দ্র বা রাজ্য – কোনো সরকারই মানে না। কেন্দ্র প্রতিশ্রুতি দিয়েও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইন করল না। রাজ্য অধিকাংশ ফসলেই সহায়ক মূল্য দেয় না। এর আগে দাবি সত্ত্বেও আলুর সহায়ক মূল্য রাজ্য সরকার ঘোষণা করেনি। এবছর আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের গুঁতোয় ঘোষণা করলেও ঘুরিয়ে কৃষকের অভাবী বিক্রিকে নিশ্চিত করল। কৃষকের থেকে সরাসরি আলু কেনার ব্যবস্থাও রাজ্য সরকার কার্যত করল না।
আরও পড়ুন আলু চাষিদের দুর্দশা নিয়ে ভাবছে না কেউ
কেন্দ্র, রাজ্য – দুই সরকারই কৃষকের লোকসান চায়। তাহলে কর্পোরেট দানবদের সুবিধা। কৃষিকে একদিকে অলাভজনক বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বড় বড় কর্পোরেট কৃষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করতে চাইছে। বেশি ফলনের নামে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের উপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। সেসবের বাজার বড় বড় কোম্পানির দখলে। আলু চাষে সার ও কীটনাশকে বিপুল খরচ হয়। এই মরসুমে কারোর বিঘে প্রতি কৃষি উপকরণে ২৪,০০০ টাকা খরচ হলে, তার মধ্যে সার, অনুখাদ্য ইত্যাদি মিলিয়ে খরচ পড়েছে প্রায় ১০,০০০ টাকা। এসবের ব্যবহার যত বাড়ছে, খরচ তত বাড়ছে। প্রান্তিক বা অন্যের জমিতে চাষ করা কৃষক আরও কোণঠাসা হচ্ছেন। বীজ সংরক্ষণের জন্য হিমঘরে ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতি মরসুমে কালোবাজারে বীজ কিনতে হচ্ছে। এমনিতেই রাজ্যে কৃষি জমিতে জোতের পরিমাণ কম। অনেক প্রান্তিক চাষি, নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমিতে ভাগে বা চুক্তিতে চাষ করেন। আবার আলু তোলার সময়ে অন্যের জমিতে জনও খাটেন। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিই একাধারে নিজের জমির প্রান্তিক কৃষক, ভাগচাষি। আবার ক্ষেতমজুর। রাজ্যে এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। চাষের খরচ জোগাড় করতে না পেরে অনেকে অন্যকে জমি ভাড়া বা বন্ধক দিচ্ছেন। প্রান্তিক চাষি জমি ধরে রাখতে পারছেন না। এই সুযোগেই কর্পোরেট সংস্থাগুলি চুক্তি চাষের জন্য আসরে নামবে। কৃষকের থেকে সরাসরি আলু কেনার ব্যবস্থা সরকারের নেই, কিন্তু নানা কোম্পানি সেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে। তৃণমূল সরকার চুক্তি চাষের সুবিধা করে দিতে আইনও সংশোধন করেছে। আলু ও অন্যান্য ফসলের কৃষকের প্রতি এই অবিচার সরকারের অপদার্থতা নয়। এটাই সরকারের নীতি।
ভূমি সংস্কারের পর সমবায় প্রথায় চাষকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আর এখন তৃণমূল সরকার তো ভূমি সংস্কারের অর্জিত সাফল্য কেড়ে নিতে চায়। কৃষকদের নিজেদের গোষ্ঠী গড়ে উঠছে। কিন্তু সাফল্যের হার আশানুরূপ নয়। গোষ্ঠীর মাধ্যমে ব্যক্তিগত কৃষিঋণ পেতেই বেশি উৎসাহ থাকে, সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার অভ্যাস গড়ে উঠছে না। কৃষিগোষ্ঠীগুলির মাধ্যমে যৌথ খামারের ধারণা গড়ে উঠতে পারে। রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে জৈব সারে চাষের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অতি ফলনের ফাঁদে জমির উৎপাদনশীলতা কমছে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশেরও বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। কৃষিগোষ্ঠীর মাধ্যমে জৈব পদ্ধতিতে চাষ, বীজ সংরক্ষণ নিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করা দরকার। সরকার এসবই জানে, এসব নিয়ে প্রচারও করছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। বরং কোম্পানিগুলি এসবের বাজারও দখল করছে। বড় বড় কোম্পানি এখন জৈব সারের ব্যবসাও করে। প্রচারেও তাদের ঘাটতি নেই। অথচ কৃষকরা বহু পুরুষ ধরে এসবের ব্যবহার জানেন। কিন্তু এখন তাঁদের সেসব ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বীজ সংরক্ষণের জন্য কৃষকরা যৌথভাবে উদ্যোগী হতে পারেন। তাহলে বীজের খরচ অনেক কমবে। আলুকে কেন্দ্র করে গ্রামে ছোট ছোট শিল্প সমবায় ভিত্তিতে গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। তৃণমূলের আমলে সমবায় মানেই অর্থ উপার্জন। সমবায়ের ধারণা ধ্বংস হয়েছে। সমবায়ের ভিত্তিতে চলা অনেক হিমঘরও বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট পরিসরে সমবায়ের ভিত্তিতে চাষ, আলু সংরক্ষণ, শিল্প গড়ে তুলে মানুষকে সেই বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। ক্রেতা-বিক্রেতার সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়েও ভাবনা দরকার। তাতে কৃষক যেমন ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন, ক্রেতাও কম দামে কিনতে পারবেন।
কাজটা বলা সহজ, কিন্তু বাস্তবায়িত করা কঠিন। কৃষকের ব্যক্তিগত জমির প্রতি ঝোঁক থাকে। তাই নিজের নামে জমির পরচা বা বর্গা পেতে উৎসাহ থাকে। তার জন্য লড়াইতেও তাঁরা প্রস্তুত। অথচ যৌথ খামারের ধারণাকে তাঁরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। প্রান্তিক, মাঝারি, বড় চাষি, অন্যের জমিতে চাষ করা কৃষকদের মধ্যেও নানা স্বার্থের সংঘাত থাকে। আবার জৈব সার ও বীজ সংরক্ষণের অভ্যাস নষ্ট হওয়ার পর পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও মানসিক বাধা থাকে। কর্পোরেট ও তাদের তল্পিবাহক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইটা অসম। কৃষিক্ষেত্রে পুঁজির অনুপ্রবেশ যত বাড়ছে, কাজটা তত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কৃষকদের মধ্যে সমবায়িক চেতনা জাগানো আজ ভীষণ জরুরি। সেই বিকল্প লড়াই একসময় কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। বিকল্প অনুশীলন গড়ে তুলবে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দান। রাজ্যে ছোট ছোট এ ধরনের চেষ্টা শুরুও হয়েছে। অনেকেরই সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে পথ চলতে চলতেই সীমা অতিক্রম করা যায়। বামেরা কি পারবে এ ধরনের বিকল্প অনুশীলনকে নিজেদের কর্মসূচিতে নিয়ে আসতে? নিছক সরকারবিরোধিতা বা ভোটে লড়াই তো বামপন্থীদের কাজ নয়। তাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে কর্পোরেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ ও বিকল্প অনুশীলনের যৌথ কর্মসূচি পারে সেই লড়াইকে শক্তিশালী করতে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।