আজ ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং ডে বা আন্তর্জাতিক তথ্য যাচাই দিবস। তথ্য যাচাই করুন রোজ। সবসময়।

কোনো ঘটনার ভিডিও আপনার হাতে এলে আপনি প্রথমেই কী করেন? ভেবে দেখবেন, আপনি প্রথমেই আবেগতাড়িত হন। হয় আপনি আপ্লুত হয়ে পড়েন বা খুব আমোদিত হন। নয়ত আপনি খুব রেগে যান, অথবা খুব খুশি হন। আপনি যা বিশ্বাস করেন, ভিডিওটা সেই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে। আপনার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলে তাকে ভুয়ো বলে দেগে দেন। এর কোনো একটা আবেগের বশেই আপনি ভিডিওটা আপনার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের মধ্যে শেয়ার করে ফেলেন। ভিডিওটা ঠিক না ভুল তা যাচাই না করেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এটাই সাধারণ মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার উপর ভরসা করেই সোশাল মিডিয়ার কারবারিরা হয় টাকা কামাচ্ছে, নয়ত নিজেদের দর্শন-আদর্শকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভুয়ো খবরের মাধ্যমে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

রামনবমীকে ঘিরে দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে টুকরো টুকরো গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনার কথা আমরা জানতে পারছি। তার বেশিরভাগটাই সোশাল মিডিয়ার দৌলতে। আমি নিশ্চিত আপনি বেশ কয়েকটা জায়গার ভিডিও হাতে পেয়েছেন সোশাল মিডিয়ার সৌজন্যেই। হয়ত সেই ভিডিও শেয়ার করেছেন বা করেননি। ভেবে দেখবেন, সেই ভিডিও দেখে আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়ার উপরই নির্ভর করেছে যে আপনি ওটা শেয়ার করেছেন কিনা বা সঠিক বলে বিশ্বাস করেছেন কিনা। হয়ত আপনি ভয় পেয়ে সেটা আর শেয়ার করেননি। ভয়ও কিন্তু একটা আবেগ।

মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ‘গেট কিপিং’ বলে একটা প্রক্রিয়া থাকে। অর্থাৎ রিপোর্টার থেকে চিফ রিপোর্টার হয়ে সম্পাদকের টেবিল হয়ে, সাব-এডিটর বা কপি এডিটরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে একটা খবর প্রকাশ হয়। বিভিন্ন ধাপে খবরটার সত্যতা যাচাই করার একটা পদ্ধতি রয়েছে। যখনই সেই ধাপগুলো না পেরিয়েই একটা খবর প্রকাশ হয়ে যায় (বা আজকাল যখন মূলধারার সংবাদমাধ্যমও কোনো না কোনো রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে খবর করে) তখনই বিপত্তি হয়। ভুয়ো খবরও চলে আসে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে।

সোশাল মিডিয়ায় এত ধাপ বা প্রক্রিয়ার বালাই নেই। একটা স্মার্টফোন থাকলে সবাই রাজা। সরাসরি পোস্ট। কাজেই তথ্য যাচাই করা হল কী না হল, তার কোনো দায়িত্ব কারোর নেই। ফলে ভুয়ো খবর আর সঠিক খবর গুলিয়ে যাবেই। আগেই বললাম, এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলেই কিছু লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ভুয়ো খবর ইচ্ছে করেই ছড়ায়। আপনার আগের পুষে রাখা বিশ্বাস, ঘৃণা, রাগ যাতে আরও বাড়ে তার জন্য। যাতে আপনি সেই আবেগ থেকে এই খবর আরও ছড়িয়ে দেন, তার জন্য। আমরা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সব খবর না পেয়ে সোশাল মিডিয়ার উপরেই বেশি ভরসা করি এই সব দাঙ্গার খবর, ছবি, ভিডিওর জন্য।

সব ভিডিও বা ছবি বা খবরই যে মিথ্যে তা নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ভিডিওটা হয়ত অর্ধসত্য। অর্থাৎ শুধু এক পক্ষের কথা বলছে। আবার দেখা যায়, ভিডিওটা হয়ত কোনো পুরনো ঘটনার। এখনকার বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেকসময় ছবি বিকৃত করে চালিয়ে দেওয়া হয়। কারোর মুখ অন্য কারোর মুখের উপর বসিয়ে দেওয়া হল। ভিডিওর আওয়াজ হয়ত অন্য কোনো ভিডিও থেকে বসিয়ে দেওয়া হল। কেউ হয়ত কোনো একটা কথা আদৌ বলেননি, কিন্তু তাঁর নামে সেটা চালিয়ে দেওয়া হল। তথ্য যাচাই না করেই, কানাঘুষো কিছু শুনে অনেকে এমনি এমনিই অনেক ভুয়ো তথ্য সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন।

এখন আপনাকেই ঠিক করতে হবে, আপনি এই ফাঁদে পা দেবেন, নাকি দেবেন না। মনে রাখবেন, আপনি হয়ত ইচ্ছে করে ভুয়ো খবর বা ফেক নিউজ ছড়িয়ে দিচ্ছেন না। আপনার ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির জন্যও হয়ত আপনি ভুয়ো খবর শেয়ার করে বসেননি। আপনার হয়ত মনে হয়েছে, আরে! এটা তো সবার জানা দরকার। ব্যাস, আপনি সেই তথ্য যাচাই না করেই সেটা ছড়িয়ে দিয়েছেন সরল মনে।

তাতে কিন্তু আপনার অপরাধ বিন্দুমাত্র কমে যাবে না। আপনি সেই ফেক বা ভুয়ো খবর বা ছবি বা ভিডিওটা তৈরি না-ও করে থাকতে পারেন। আপনি হয়ত প্রথম ব্যক্তি নন, যিনি ওটা পোস্ট করেছেন। কিন্তু আপনি যদি কোনো ভুয়ো তথ্য বা ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেন বা ফরোয়ার্ড করেন, আপনি কিন্তু সমান দোষী। পুলিশ কিন্তু ভারতীয় দণ্ডবিধি বা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বলে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই পারে। মনে রাখবেন, অনেকে শুধু মজা করার জন্যও অনেক সময় ভুয়ো ছবি বা ভিডিও বা তথ্য শেয়ার করে থাকেন এটা জেনেও, যে তথ্যটা ভুয়ো। তাঁরাও কিন্তু আইনের চোখে সমান দোষী।

কিন্তু এই ভুয়ো খবর বা ফেক নিউজ থেকে বাঁচার জন্য আপনি কী কী করতে পারেন?

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, প্রথমেই আপনার আবেগকে সংযত করতে হবে। যতই রাগ, ঘৃণা, মজা, আনন্দ হোক; যতই আপনার মনে হোক “এটাই তো আমি বলছিলাম, দেখলে তো মিলে গেল”। শুধুমাত্র আবেগের বা বিশ্বাসের বশে কোনোকিছু সঠিক বলে মেনে নেবেন না, শেয়ার বা ফরোয়ার্ড করে দেবেন না।

আগে তথ্যটা সঠিক না ভুল তা যাচাই করুন। যাঁরা অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করেন, তাঁরা ছবির ক্ষেত্রে গুগল লেন্সে ছবিটার ব্যাপারে আরও খোঁজখবর করতে পারেন। অথবা ওয়েব ব্রাউজারে গিয়ে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ টাইপ করে ছবিটা আপলোড করতে পারেন। ভিডিও হলে, সেই ভিডিওর কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশের স্ক্রিনশট নিয়ে তাও রিভার্স ইমেজ সার্চের জন্য আপলোড করতে পারেন। যেভাবে শব্দ টাইপ করে গুগলে সার্চ করেন, এটাও সেই একই পদ্ধতি। শুধু শব্দের জায়গায় আপনি ছবি দিচ্ছেন সার্চ করার জন্য। এতে যে সার্চ রেজাল্ট পাবেন, তাতে বুঝতে পারবেন ছবি বা ভিডিওটা এর আগে অন্য কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। নাকি সত্যিই এটা নতুন বা বর্তমান কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

এত কিছু না পারলে যে তথ্য আপনার কাছে আছে, সেই সংক্রান্ত কয়েকটা শব্দ দিয়ে সাধারণ গুগল সার্চ করুন। যদি খবরটা ভুয়ো হয় আর কোনও ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা সেটা ভুয়ো বলে ইতিমধ্যেই প্রমাণ করে থাকে, তবে সেই সংক্রান্ত খবর আপনি সার্চ রেজাল্টের একদম উপরেই পেয়ে যাবেন। গুগল এই ব্যবস্থা অনেকদিন হল চালু করেছে।

সবসময়ই যে এত সহজে বুঝে যাবেন যে খবরটা ভুল না ঠিক, তা নাও হতে পারে। তখন যে এলাকা থেকে খবরটা এসেছে, সেই এলাকায় পরিচিত কেউ থাকলে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে জানার চেষ্টা করুন, ঘটনাটা ঠিক না ভুল। কোনো বিশেষজ্ঞকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন কোনো তথ্য সম্বন্ধে। যেমন মনে করুন যদি আপনার কোনো পুলিশ বন্ধু থাকেন, তাঁকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেন। সবসময় যে তাঁরা একশো শতাংশ সঠিক তথ্য দিতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই নিজের বুদ্ধি কাজে লাগান। বোঝার চেষ্টা করুন কোন যুক্তিতে তথ্যটা সঠিক বা ভুয়ো।

অনেক ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট রয়েছে। যেমন অল্টনিউজ.ইন, বুমলাইভ, কুইন্টের ওয়েবকুফ, ইন্ডিয়া টুডের ফ্যাক্টচেক, সরকারি খবর হলে পিআইবি ফ্যাক্ট চেক। তাদের কাছেও আপনি খবরটা ঠিক না বেঠিক জানার জন্য পাঠাতে পারেন। এরা যাচাই করে আপনাকে সঠিক তথ্য দিতে পারে।

আরো পড়ুন তীব্র মেরুকরণ হওয়া সমাজে ফ্যাক্ট চেকিং যথেষ্ট নয়: প্রতীক

মোট কথা, যতক্ষণ না আপনি একশো শতাংশ নিশ্চিত হচ্ছেন যে কোনো তথ্য, খবর, ছবি বা ভিডিও সঠিক, ততক্ষণ পর্যন্ত তাতে বিশ্বাস করবেন না। আবেগতাড়িত হয়ে অন্যকে শেয়ার বা ফরোয়ার্ড তো একদমই করবেন না।

শুধু দাঙ্গা সংক্রান্ত খবর নয়, যে কোনো খবরের ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মেনে চলুন। আর সোশাল মিডিয়ায় ‘সৎসঙ্গ’ করুন। অর্থাৎ যাঁরা সচরাচর ভুয়ো খবর ছড়ান না, তাঁদের সঙ্গে সোশাল মিডিয়ায় বন্ধুত্ব করুন, তাঁদের পোস্ট ফলো করুন, ভাল লাগলে লাইক করুন, কমেন্ট করুন। তাহলে সোশাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম বুঝতে পারবে আপনি কেমন খবর চান। সেই মত আপনার বন্ধুদের পোস্টই সে বেশি করে আপনার কাছে পৌঁছে দেবে। যারা একপেশে তথ্য দেয়, তাদের থেকে দূরে থাকুন। সোশাল মিডিয়াও বুঝে যাবে আপনার ব্যবহার। আপনি অনেকটা সুরক্ষিত থাকবেন।

তবে সব খবর বা তথ্যই যে অবিশ্বাস করতে হবে, তা নয়। শুধু নিজের বুদ্ধি-যুক্তি ব্যবহার করে তথ্যটা যাচাই করে নিন, বুঝে নিন। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র বা মানুষের থেকে কোনো খবর বা ছবি পেলেও তাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেবেন না। যাচাই করে নিন। অর্ধসত্য কিন্তু আসলে অর্ধমিথ্যাও।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.