পরিণত বয়সেই মারা গেলেন সেলিম আজিজ দুরানি। ভারতীয় ক্রিকেটের এক রংদার, দিলদার চরিত্র। সেলিম দুরানি মানেই এক অন্যতর আকর্ষণ।
খবরটা পাওয়া মাত্র বহু স্মৃতি ভিড় করে আসছে। সেসব হাতড়াতে গিয়ে চিলেকোঠার ঘরে অগোছালো বইপত্তরের মাঝে পেয়ে গেলাম আমার কিশোর বয়সের এক স্ক্র্যাপবুক। অধুনা কীটদষ্ট। ১৯৭১ সালে অজিত ওয়াড়েকরের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকালে তখনকার যুগান্তর কাগজে প্রকাশিত ছবি এবং সেইসঙ্গে এক বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিবেদন — দুয়ের সমাহারে তৈরি সেই খাতাটি। অনেক আবেগ, অনেক রোমাঞ্চ তার প্রতিটি অক্ষরে। সেই প্রসঙ্গ পরে আসছি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সেলিম মানেই যেন একরাশ তাজা হাওয়া। অলরাউন্ডার – তেজি বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিন বোলার। দলের প্রয়োজন তাঁর কাছে সর্বাগ্রে, আবার জনতার আবদারও অগ্রাহ্য করতেন না। ব্যাট হাতে টেল-এন্ডার হয়েছেন, আবার মিডল অর্ডারেও নেমেছেন। প্রথম টেস্ট ১৯৬০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। শেষ টেস্ট ১৯৭৩ সালে, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। দুটোই মুম্বইয়ের ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে। প্রথম টেস্টে টেল-এন্ডার হিসেবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম বলেই রান নিয়েছিলেন। বিরুদ্ধ-বোলার ছিলেন কিংবদন্তি রে লিন্ডওয়াল।
জন্মসূত্রে আফগান সেলিমের বাবা আবদুল আজিজ দুরানিও ছিলেন ক্রিকেটার। ১৯৩৫-৩৬ সালে সফররত অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে দুটো বেসরকারি টেস্টে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন। রঞ্জি ট্রফিতে খেলেছেন অবিভক্ত ভারতের সিন্ধুপ্রদেশ ও নভনগর দলের হয়ে। সেলিম রঞ্জি খেলেছেন সৌরাষ্ট্র, গুজরাট ও রাজস্থানের হয়ে। ১৯৬২ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের মাঝখানে ভারতীয় অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর আহত, অবসৃত হওয়ার পরে মনসুর আলি খান পতৌদির নেতৃত্বে কুইন্স পার্ক ওভাল (পোর্ট অব স্পেন) টেস্টে সেলিম এক চোখধাঁধানো শতরান করেন। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর একমাত্র শতরান। ১৯৬৪ সালে কানপুরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাত্র ২৯ মিনিটে পূর্ণ করা তাঁর অর্ধশতক এখনো টেস্ট ক্রিকেটে সময়ের হিসাবে দ্রুততম অর্ধশতরানের তালিকায় চতুর্থ স্থানে। সামনে শুধু পাকিস্তানের মিসবা-উল হক (২০১৪), বাংলাদেশের মহম্মদ আশরাফুল (২০০৭) আর ইংল্যান্ডের জন ব্রাউন (১৮৯৫)।
আসলে সেলিম দুরানির মত ক্রীড়াবিদরা কখন কী করবেন কেউ বলতে পারে না। খেলার মধ্যে জীবনের যে ছন্দ ও আনন্দ তাঁরা খুঁজে পান, তা ছড়িয়ে দেন জনতার মধ্যে। দলের প্রয়োজনে কখনো রক্ষণাত্মক ব্যাট করেছেন, কখনো বা আগ্রাসী। বিশ্বের সেরা বোলারদের দুরমুশ করেছেন। বোলিংয়ে মাঝেমধ্যেই চমকপ্রদ সাফল্য। বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা তাঁর শিকার হয়েছেন। দীর্ঘকায় সুদর্শন চেহারা, জনতার নয়নের মণি, তরুণীদের হার্টথ্রব। মাঠে নামছেন – জামার কলার তোলা। হাঁটছেন না, যেন ভেসে চলেছেন। ব্যাট করতে এলে দর্শকদের অবধারিত দাবি থাকত – ছক্কা। তা মেটাতেও কসুর করতেন না। মনে পড়ছে, ১৯৭৩ সালে টনি লুইসের এমসিসি (ইংল্যান্ড) দলের বিরুদ্ধে নিজের শেষ টেস্ট সিরিজে কলকাতার ইডেন উদ্যানেও সেরকম ঘটেছিল। জনতা আবদার করল, সেলিম ছক্কা হাঁকালেন।
আজ খুঁজে পাওয়া আমার স্ক্র্যাপবুকের লাগসই একটি পৃষ্ঠায় দেখছি এইসব লিখেছিলাম
১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে প্রায় বছর চারেক জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে নজর কাড়া কৃতিত্বে আবার জাতীয় দলে ফেরেন। নতুন অধিনায়ক অজিত ওয়াড়েকরই তাঁকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। পোর্ট অব স্পেনের সেই ঐতিহাসিক জয়ে দুরানির অবদান অনস্বীকার্য। উইকেট তখন ভাঙছে, ভারতের স্পিন জাদুতে (বিশেষ করে শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনকে নিয়ে) ওয়েস্ট ইন্ডিজ রীতিমত বিব্রত। তবু চার্লি ডেভিস আর ক্লাইভ লয়েডের জুটি জমে যাচ্ছে। ভাঙতে হবে। দুরানি এম এল জয়সীমাকে দিয়ে ক্যাপ্টেনকে বলালেন, তাঁকে বল করতে দেওয়া হোক। আবেদন মঞ্জুর। পিচের ফাটল ব্যবহার করে বল ঘোরালেন, লয়েড ঝুঁকির শট মারতে গিয়ে ওয়াড়েকরের হাতে জমা পড়লেন। এরপর স্যার গারফিল্ড সোবার্স। পিচের ক্ষতস্থান ব্যবহার করে এক মোক্ষম ডেলিভারিতে সোবার্সকে বোল্ড আউট করলেন শূন্য রানে। ভারতের জয় তখনই পাকা হয়ে গিয়েছিল।
সেলিমের মত বর্ণময় চরিত্র শুধু ক্রিকেটের মধ্যেই জীবনের ছন্দ ও আনন্দ খুঁজে পাবেন, তা ভাবা ভুল। ট্রেনে শীতে কাঁপছেন সুনীল গাভস্কর; নিজের কোট সুনীলের গায়ে চাপিয়ে দিয়ে সারারাত নিজে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কাটিয়ে দিলেন। রাস্তায় দীনদরিদ্র অসহায় মানুষকে দেখলে সাধ্যমত সাহায্য করতেন। একবার এক শীতের রাতে এক দুঃস্থ মহিলাকে নিজের ক্রিকেট মাঠের সোয়েটারটাই দিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। অফিসিয়াল পরিচ্ছদ এভাবে হাতছাড়া করা শৃঙ্খলাভঙ্গ, একথা সতীর্থরা মনে করিয়ে দিলে পরে সেই বৃদ্ধার খোঁজ করেছিলেন। পাওয়া যায়নি।
আরো পড়ুন তুলসীদাস বলরাম: নিভৃত প্রাণের দেবতা
তিনিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাঁকে সিকে নাইডুর নামাঙ্কিত জীবনকৃতি সম্মান দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের এমসিসির বিরুদ্ধে কানপুর টেস্টে যখন বাদ পড়েন, আওয়াজ ওঠে “নো দুরানি, নো টেস্ট”। বিপাকে পড়ে যায় বোর্ড, ফলে মুম্বই টেস্টে দলে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেটিই তাঁর শেষ টেস্ট। তবে প্রথম শ্রেণির ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে গেছেন আরও বছর তিন-চারেক।
সমাজের বিভিন্ন মহলের মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। মানুষের ভালবাসা ও সমীহ – দুটোই পেয়েছেন। চলচ্চিত্র জগতে দেব আনন্দ, মীনাকুমারী, অশোককুমার প্রমুখের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। দেব আনন্দের আগ্রহেই সিনেমায় নামেন। চরিত্র ছবিতে (১৯৭৩) তাঁর নায়িকা ছিলেন পারভীন ববি।

বক্স অফিসে অসফল সে ছবির আগেও অবশ্য অভিনয় করেছেন এক মাসুম (১৯৬৯) ছবিতে।
আজকের প্রজন্ম সেলিম দুরানির পরিসংখ্যান অতি সহজে জানতে পারলেও তাঁকে উপলব্ধি করতে পারবে কিনা বলা কঠিন। প্রায় আড়াই দশক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন। ক্রিকেট খেলার বিবর্তন দেখেছেন। দেশের জন্য খেলেছেন, দলের জন্য খেলেছেন, অবশ্যই নিজের ছন্দে-আনন্দে। কোনো মতলবে কখনো ছিলেন বলে জানা নেই। এঁদের জন্য থেকে যায় নিখাদ শ্রদ্ধা। অবশ্য পাঁচ দশক আগেকার মাপজোক এখনকার কালাঙ্কে স্থাপন করা যাবে কিনা কে জানে! আজ খেলতে নামলে সেলিমকে কি দেশভক্তির পরীক্ষা দিতে হত? তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে কি প্রশ্ন উঠত? মহম্মদ শামিকেই যখন কটূক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেলিমকেও যে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হত না তা হলফ করে বলা যায় না।
ভাগ্যিস তিনি পাঁচ দশক আগে খেলা শেষ করেছেন!
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।