অসংখ্য ছবি হয়, তাই বহু মানুষ নায়ক হন। তাঁদের অনেকেই জনপ্রিয় হন, কিন্তু মাত্র কয়েকজন এমন উচ্চতায় পৌঁছন যে নিজের ইন্ডাস্ট্রিটাকে কাঁধে তুলে নিতে পারেন – একসময় টলিউডকে যেভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। আরও কম সংখ্যক শিল্পী এত বড় হয়ে ওঠেন যে সিনেমাজগৎ ছাড়িয়ে যে সমাজে, যে দেশে দাঁড়িয়ে আছেন তাকে প্রভাবিত করতে পারেন। পারলেও সাহস করে সে দায়িত্ব পালন করেন আরও কম শিল্পী। এমনকি উত্তমকুমারও পালন করেননি। তাঁর সময়ের পশ্চিমবঙ্গে ঘটে চলা রাজনৈতিক, সামাজিক সংঘর্ষ কোনোদিন তাঁর ছবিতে ঢেউ তোলেনি। সরোজ দত্তের হত্যাও কোনোদিন তাঁর কাজে উঁকি মারেনি। শাহরুখ খান সেই বিরল শিল্পী যিনি দুঃসময়ে দাঁড়িয়ে এই দায়িত্ব পালন করলেন জওয়ান ছবিতে। তিনি যখন অতখানি সাহস করেছেন, তখন আমি সামান্য সাহস দেখাই। বলেই ফেলি – এই ছবি একবার দেখার ছবি নয়, বলিউডের ইতিহাসে মাইলফলক হিসাবে যে ছবিগুলোকে ধরা হয় তাদের পাশে জায়গা হবে এই ছবির। যদি ভারত বা ইন্ডিয়া নামের দেশটা বাঁচে, আমার মৃত্যুর বহুকাল পরে এবং যাঁরা এ লেখা পড়ছেন তাঁদের সকলের মৃত্যুর পরেও মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া ছবির সঙ্গে এক বাক্যে উচ্চারিত হবে অ্যাটলির এই ছবির নাম।

না, সিনেমাবোদ্ধারা ‘মাস্টারপিস’ বলতে যা বোঝেন এ ছবি তার ত্রিসীমানায় যায়নি। এমন একটা শটও নেই যা স্রেফ দৃশ্য হিসাবেই সিনেমাবোদ্ধার চোখে লেগে থাকবে। এ ছবিতে আর পাঁচটা নাচ-গান-মারামারির ছবির মতই গাড়ি উড়ে গিয়ে পড়ে, নায়ক একাই জনা বিশেক দুর্বৃত্তকে শেষ করে দেন। এসব অপছন্দ হলে বা ঘন্টা তিনেকের জন্য বিশ্বাস করে নিতে আপত্তি থাকলে (যাকে শিল্প সমালোচনার ভাষায় সাহেবরা বলে “willing suspension of disbelief”, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় অবিশ্বাস স্থগিত রাখা) এ ছবি না দেখাই শ্রেয়। কিন্তু ঘটনা হল এ ছবি যে ঘরানার, সেই ঘরানায় এগুলো অবাস্তব নয়। নির্দেশক অ্যাটলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রযোজক গৌরী খান আর শাহরুখ কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতবেন বলে ছবি করেননি। এখানে তাঁদের লক্ষ্য যত বেশি সম্ভব দর্শকের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সেই বার্তা দিতে তাঁরা সেই চলচ্চিত্রভাষাই ব্যবহার করেছেন যে ভাষা তাঁরা গুলে খেয়েছেন এবং এ দেশের আপামর দর্শক যার সঙ্গে কয়েক প্রজন্ম ধরে পরিচিত। এ “ভাষা এমন কথা বলে/বোঝে রে সকলে/ উঁচা নিচা ছোট বড় সমান।” তাহলে এমন কী করা হল এই ছবিতে, যার জন্য বলছি এই ছবি বলিউড ছবির মাইলফলক? সেই আলোচনায় আসব। শুরুতেই বলে দিই, সাদা চোখে অন্তত চারটে স্তর দেখতে পেয়েছি এই ছবির। সেই স্তরগুলোর আলোচনাই আলাদা আলাদা করে করব। কেউ আরও বেশি স্তরের খোঁজ পেতে পারেন, যদি তাঁর উঁচু নাক, চোখ ছাড়িয়ে মস্তিষ্ককেও ঢেকে না ফেলে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রথম স্তর: ইশতেহার

এই স্তর নিয়েই সবচেয়ে কম শব্দ খরচ করব। কারণ ছবির মুক্তির দিনই ভাইরাল হয়ে যাওয়া ক্লিপের দৌলতে সবাই জেনে ফেলেছে কীভাবে সরাসরি শাহরুখ দেশের মানুষের উদ্দেশে গণতন্ত্রের সার কথাগুলো বলেছেন, যা অনেকের মতেই দেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বার্তা। কিন্তু ওই ক্লিপটাই শেষ কথা নয়। আসলে জওয়ান এক আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি। আমরা প্রায় ভুলে গেছি যে রাজনীতি মানে শুধু এই দল আর ওই দল নয়। পরিচালক অ্যাটলি আর শাহরুখ দলাদলি বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাইরেও যতরকম রাজনীতি আছে প্রায় সবকটা নিয়ে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করেছেন। লিঙ্গ রাজনীতি থেকে পরিবেশ রাজনীতি – সবই এই ছবির বিষয়বস্তু।

নব্য উদারবাদী অর্থনীতির যুগে, ভারতের ইতিহাসে ক্রোনি পুঁজিবাদের সেরা সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয়তম তারকার ছবিতে খলনায়ক হিসাবে দেখানো হল একজন শিল্পপতিকে। কালী গায়কোয়াড় (বিজয় সেতুপথী) সমস্তরকম পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মকানুনকে কাঁচকলা দেখিয়ে কারখানা তৈরি করেন, অনুমতি না পাওয়া গেলে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করেন না। স্থানীয় মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়ায় গোটা পঞ্চাশেক কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হল – ভারতের বহু এলাকার মানুষের এই ইচ্ছাপূরণের দৃশ্যও দেখিয়ে দিয়েছেন অ্যাটলি। শুধু এই কারণেই জওয়ানকে ঐতিহাসিক বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। তবে যে কথা কেউ বলছেন না, তা হল এই ছবি শুধু নানাভাবে বিজেপিকে আক্রমণ করেনি। এ ছবিতে শুধু গৌতম আদানি বা নরেন্দ্র মোদীর ছায়া পড়েনি, রেয়াত করা হয়নি কংগ্রেস আমলকেও। এসে পড়েছে ১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা, ছায়া পড়েছে বোফর্স কেলেঙ্কারিরও।

সূক্ষ্মতর রাজনৈতিক প্রসঙ্গ পরবর্তী স্তরগুলোর আলোচনায় আসবে। আপাতত এটুকু বলে শেষ করা যাক যে সম্ভবত এতখানি সোচ্চার রাজনীতি শাহরুখের ছবিতে এসে পড়তে পারত না প্রযোজক হিসাবে তামিল ছবির নির্দেশককে না নিলে। ইদানীং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দৌলতে এবং বেশকিছু ছবি হিন্দিতে ডাব হয়ে বিশ্বজুড়ে মুক্তি পাওয়ার ফলে আমরা জানি যে তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম ভাষার ছবিতে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে আনা বা রাজনীতিকেই কেন্দ্রে বসিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে জলভাত। সে রজনীকান্তের নাচ-গান-মারামারির ছবিই হোক, আর জয় ভীম কিম্বা কান্তারা। দক্ষিণ ভারতের ছবির এই গুণ বলিউডি ব্লকবাস্টারে নিয়ে আসা হল।

দ্বিতীয় স্তর: ভারততীর্থ

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষকে ‘আমাদের’ মত দেখতে নয়, সুতরাং ‘ওরা’ ভারতীয় নয়। এই ধারণা আমাদের অনেকেরই চেতনে বা অবচেতনে বদ্ধমূল। দেশের রাজধানী দিল্লিতে অনবরত ওঁদের ‘চিঙ্কি’ শব্দটা শুনতে হয়। কলকাতার লোকেরা অনেক বেশি পরিশীলিত, বুদ্ধিমান। তাই ‘নাক চ্যাপটা’ ইত্যাদি কথাগুলো ওঁদের সামনে বলা হয় না, একান্ত আলোচনায় হয়। মণিপুর যে ভারতের মধ্যে পড়ে না তার প্রমাণ তো গত তিন মাসে ভারত সরকারের আচরণেই পাওয়া যাবে। অথচ এ ছবি শুরুই হয় চীনের সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশে। নায়কের প্রাণ বাঁচে প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে, আধুনিক চিকিৎসার সুযোগসুবিধা থেকে বহু দূরে আদিবাসী চিকিৎসা পদ্ধতিতে। সারা দেশকে যখন রামভক্ত হতে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন মরণ হতে নায়ক জেগে ওঠেন ভীষণদর্শন, বাকি ভারতের কাছে অনেকাংশে অপরিচিত, বৌদ্ধ দেবতা মহাকালের মূর্তির সামনে গ্রামের মানুষের কাতর প্রার্থনায়। চীনা সেনাবাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করেন গ্রামকে (জাতীয়তাবাদী সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা বোধহয় ওখানেই কাত। বাকি ছবিতে তাঁদের পক্ষে আপত্তিকর যা কিছু দেখানো হয়েছে, ক্ষমাঘেন্না করে দিয়েছেন)।

প্রান্তিক, সংখ্যালঘু মানুষকে কাহিনির কেন্দ্রে স্থাপন করার এই ধারা বজায় থেকেছে গোটা ছবি জুড়ে। অরুণাচলের ওই গ্রামের এক বাসিন্দা চিত্রনাট্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গত শতকের আটের দশক পর্যন্তও হিন্দি ছবিতে আমরা যা দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, সেই ধারা মেনে এই ছবিতে শাহরুখের ঘনিষ্ঠরা সবাই ভারতের নানা সংখ্যালঘু বা নিপীড়িত সম্প্রদায়ের মানুষ। মুসলমান, শিখ, গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান অথবা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে পর্যন্ত হিন্দি ছবিতে নায়ক হিন্দু হলেও তার প্রাণের বন্ধু হবে একজন মুসলমান – এটা প্রায় নিয়ম ছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে হিন্দি ছবির মুসলমানরা হয়ে গেলেন দুরকম – হয় সন্ত্রাসবাদী, নয় অতিমাত্রায় দেশভক্ত পুলিসকর্মী বা সৈনিক। যে ভারততীর্থের স্বপ্ন দেখতেন রবীন্দ্রনাথ, তা বাস্তবে না থাক, অন্তত বলিউডি ছবিতে দেখা যেত। বহুকাল পরে এই ছবিতে ফেরত এসেছে।

আজকের ভারতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত যেসব জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে অবশ্যই পড়েন মেয়েরা। শুধু যে অনেক জায়গায় ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নয়। এতকাল ধরে অর্জিত মেয়েদের সামাজিক অধিকারগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলাও আরম্ভ হয়ে গেছে। জিনস পরা, চাউমিন খাওয়া খারাপ মেয়ের লক্ষণ – এমন হাস্যকর কথা বলার পাশাপাশি বিরুদ্ধ মতের মহিলাদের কুৎসিত ভাষায় সংগঠিত ট্রোলিং, বেছে বেছে মুসলমান মেয়েদের অনলাইন নিলাম – এসবও চালু হয়েছে। ক্রমশ পিছন দিকে হাঁটতে থাকা, বিষাক্ত পৌরুষের উদযাপনে জবজবে এই ভারতে শাহরুখ তাঁর অতিমানবিক কাজকর্ম করেন এক দল মেয়েকে নিয়ে। তাঁর দুই নায়িকার এক নায়িকা ঐশ্বর্য (দীপিকা পাড়ুকোন) কুস্তিতে তুলে আছাড় মারেন শাহরুখকে। অন্য নায়িকা নর্মদা (নয়নতারা) একজন কুমারী মা। ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলা যে দেশে ফ্যাশন সে দেশে ‘মা’ শব্দের অনুষঙ্গে মুসলমানবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বার্তাও দেওয়া হয়েছে ছবির গোড়ার দিকেই। কীভাবে? সে আলোচনায় যাব না, কারণ তাতে স্পয়লার দেওয়া হবে।

এমন ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ বলিউডি ছবিতে আর কখনো দেখা যাবে না – এ আশঙ্কা গত দু-তিন দশকে জোরালো হয়ে উঠেছিল, এখনো সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসমুদ্রহিমাচলকে ৫৭ বছর বয়সেও উদ্বেল করতে পারা নায়ক অন্তত শেষবার করে দেখালেন।

তৃতীয় স্তর: বলিউড অমনিবাস

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, প্রস্থেটিক মেক আপ, ঝাঁ চকচকে সেট সত্ত্বেও এই ছবির আত্মার খোঁজ করলে দেখা যাবে সেটা জওহরলাল নেহরুর আমলের বিনোদনমূলক অথচ সামাজিক বার্তা দেওয়া, এমনকি ভেদাভেদহীন দেশ গঠনের, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখানো ছবির আত্মা।

মনে রাখা ভাল যে নেহরু-ঘনিষ্ঠ রাজ কাপুর, দিলীপকুমার, দেব আনন্দরা সেই হিন্দি সিনেমার মুখ হলেও চিত্রনাট্য, পরিচালনা, গান লেখা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় স্বমহিমায় ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত একগুচ্ছ মানুষ। অর্থাৎ হিন্দি সিনেমা শাসন করতেন নেহরুর মত নরম সমাজবাদীর কাছের লোকেরা আর সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ক্রমশ সেই প্রভাব কমতে শুরু করে। ভারতীয় বামপন্থীরা ক্রমশ যাহা জনপ্রিয় তাহাই নিকৃষ্ট – শিল্প সম্পর্কে এই অবৈজ্ঞানিক ধারণায় নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেন। যেহেতু এ দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় বলিউড, সেহেতু ওটাই যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তাতে আর সন্দেহ কী? ফলে বামপন্থীরা বলিউড দখলে রাখার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। বলিউড যে দেশের গরিবগুরবো মানুষের ভাবনা তৈরি করায় বড় ভূমিকা নেয় সেসব তাঁরা বোঝেননি। তবু দেশের রাজনীতির সার্বিক ঝোঁক বাঁদিকে ছিল বলে এবং বলিউডে একদা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের তখনো উপস্থিতি ছিল বলেই হয়ত আটের দশকেও রেলের কুলিকে নায়ক বানিয়ে ছবি হয়েছে এবং কুলি (১৯৮৩) ছবির পোস্টারে দেখা গেছে অমিতাভ বচ্চনের হাতে কাস্তে, হাতুড়ি – একেবারে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীক যে বিন্যাসে থাকে সেই বিন্যাসেই।

শাহরুখ
উৎস: পিন্টারেস্ট

কিন্তু শাহরুখ যতদিনে বলিউডে এসেছেন ততদিনে সেসব প্রভাব প্রায় অদৃশ্য। দেশের রাজনীতিও ডানদিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ১৯৯১ সালে নেহরুর সমাজবাদকে তাঁর দলই আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে বাজার অর্থনীতি চালু করে। পরের বছর জুন মাসে মুক্তি পায় শাহরুখের প্রথম ছবি দিওয়ানা। তার ছমাসের মধ্যেই ধূলিসাৎ করা হয় বাবরি মসজিদকে। হিন্দি সিনেমা থেকে ক্রমশ উধাও হতে শুরু করে গরিব, মধ্যবিত্ত। তারপর থেকে নায়করা বিত্তশালী। প্রাসাদোপম বাড়ি, গাড়ি, নিজস্ব হেলিকপ্টার, অনেকে আবার অনাবাসী ভারতীয়। অথচ সাবেকি হিন্দু ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি সেই নায়করা ভারি বিশ্বস্ত। মেয়ের বাবার অমতে প্রেমিকাকে বিয়ে করে না। অন্তরঙ্গ মেয়ে বন্ধু প্যান্ট পরলে, খেলাধুলো করলে তাকে বিয়ে করার যোগ্য মনে করে না। করে যখন সে ‘মেয়েলি’ হয়ে যায় তখন। পালক পিতা নিজের পরিবারের চেয়ে নিচু শ্রেণির মেয়েকে বিয়ে করতে চাওয়ায় বাড়ি থেকে বার করে দিলেও শ্রদ্ধা টোল খায় না। শাহরুখ নিজের সেরা সময়ে সেইসব ছবিতেই অভিনয় করে এসেছেন। আজ, তিন দশকের বেশি সময় ইন্ডাস্ট্রিতে কাটানোর পর যখন নিজের মনোমত সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন, তখন কিন্তু শাহরুখ দেখালেন নেহরুর আমলের হিন্দি ছবি। একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে জন্ম নেওয়া, ছোটবেলাতেই অনাথ নায়ক। নিশ্চয়ই সমাপতন নয় যে এই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়া বিস সাল বাদ ছবির দারুণ জনপ্রিয় গান ‘বেকরার কর কে হমে য়ুঁ ন যাইয়ে’ আর ১৯৫৫ সালের রাজ কাপুর অভিনীত শ্রী ৪২০ ছবির ‘রামাইয়া ওয়স্তাওয়ইয়া’।

এখানেই শেষ নয়। বস্তুত, যদি আপনার স্মৃতি ঠিকঠাক কাজ করে, জওয়ান ছবির মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন বলিউডের এতকালের কিছু আইকনিক ছবিকে। শাহরুখের চরিত্রে খুঁজে পাবেন তাঁর পূর্বসুরীদের। জিস দেশ মেঁ গঙ্গা বহতি হ্যায় (১৯৬০) ছবির রাজ কাপুর, আরাধনা (১৯৬৯) ছবির রাজেশ খান্না, দিওয়ার (১৯৭৫) ছবির শশী কাপুর, শাহেনশাহ (১৯৮৮) ছবির অমিতাভকে খুঁজে পেতে খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যাঁরা দেখে ফেলেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন জওয়ানের শরীরে শোলে (১৯৭৫) ছবির চিহ্নগুলোও। বলা বাহুল্য, শাহরুখ মাঝেমধ্যেই উস্কে দিয়েছেন নিজের রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করা ছবিগুলোর স্মৃতিও।

অথচ যা নেই তা হল এই শতকের হিন্দি ছবির কোনো প্রভাব, কোনো সংযোগ। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা আদর্শবাদী পুলিস অফিসারকে হিন্দি ছবিতে আমরা শেষ দেখেছি সম্ভবত মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত শূল (১৯৯৯) ছবিতে। এই শতকের বলিউডি পুলিস অফিসার মানেই তো ট্রিগারমত্ত, যা আজকের বুলডোজার রাজের মঞ্চ তৈরি করেছে। অব তক ছপ্পন (২০০৪) ছবির নানা পাটেকর, শুটআউট অ্যাট লোখাণ্ডওয়ালা (২০০৭) ছবির সঞ্জয় দত্ত, সুনীল শেঠি, আরবাজ খানরা আইন-আদালতের ধার ধারেন না। তাঁরা ‘শুট টু কিল’ নীতিতে বিশ্বাসী। আর আছেন দাবাং সিরিজের সলমান খান, সিঙ্ঘম সিরিজের অজয় দেবগনরা। জওয়ান ছবির পুলিস অফিসার কিন্তু একেবারেই গত শতকের হিন্দি ছবির পুলিস অফিসারদের মত। সমাপতন কিনা জানি না, উইকিপিডিয়া বলছে শূল ছবিটার স্বত্ব এখন গৌরী-শাহরুখের রেড চিলিজ এন্টারটেনমেন্টের হাতেই। এ ছবিতে অবশ্য আছেন এক দেশপ্রেমিক বিক্রম রাঠোর, যাঁর মানুষ খুন করতে হাত কাঁপে না। কিন্তু তিনি অক্ষয় কুমার অভিনীত রাউডি রাঠোর (২০১২) ছবির সমনামী নায়কের মত পুলিস অফিসার নন। তরুণ নির্দেশকের হাত ধরে প্রবীণ শাহরুখ বোধহয় বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোন ধরনের ছবির পক্ষে।

বামপন্থীরা বলিউডকে অবজ্ঞা করেছিলেন, দক্ষিণপন্থীরা করেনি। তাই ক্রমশ তাদেরই হাতে চলে যাচ্ছে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যমের রাশ। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যায় সাজানো প্রোপাগান্ডা ছবি তৈরি হচ্ছে। কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরি-র পর আসছে দ্য ভ্যাক্সিন ওয়ার। ২০২৪ সালে বিজেপি ফের জয়যুক্ত হলে বলিউডি ছবিকে যে আর চেনাই যাবে না তাতে সন্দেহ নেই। জওয়ানের গুরুত্ব সেক্ষেত্রে হয়ে যাবে দ্বিগুণ, কারণ এই একখানা ছবিতে ধরা রইল হিন্দি ছবির সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য যা তাকে স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম ঐক্য বিধায়ক করে তুলেছিল। এমনি এমনি জওয়ানকে মাইলফলক বলিনি। এখানেই অবশ্য বলতে হবে এই ছবির একমাত্র ব্যর্থতার কথা। সমস্ত আইকনিক হিন্দি ছবির প্রাণ ছিল গান। সঙ্গীত পরিচালক অনিরুধ রবিচন্দর কিন্তু গানগুলোকে সেই উচ্চতার ধারে কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। এমন একটা গানও নেই যা মনে গেঁথে যায়।

চতুর্থ স্তর: যা ব্যক্তিগত তাই সর্বজনীন

ছবির আলোচনায় এখন পর্যন্ত একবারও শাহরুখের চরিত্রের নাম করিনি। তার একটা কারণ অবশ্যই স্পয়লার দিতে না চাওয়া। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় কারণ ছবিটা নিজে। এখানে ব্যক্তি শাহরুখ একাধিকবার চরিত্রের খোলস ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছেন। প্রসেনিয়াম থিয়েটারে চরিত্রের দর্শকাসনে নেমে আসার মত ব্যতিক্রম ঘটিয়ে একেবারে শেষ পর্বে যে তিনি পর্দার বেড়া ভেঙে সরাসরি দর্শকদের উদ্দেশে কথা বলার উপক্রম করেছেন তা তো সবাই জেনেই গেছেন। কিন্তু তার আগেই বেশ কয়েকবার যখনই ক্যামেরা তাঁকে ক্লোজ আপে ধরেছে, তিনি ভক্তদের উদ্বেল করে দেওয়ার মত কোনো অঙ্গভঙ্গি করেছেন, তখন নেপথ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে বেজেছে কয়েকটা কলি যার সবটা বুঝতে পারা শক্ত। বোঝার আগ্রহও প্রেক্ষাগৃহের কারোর তেমন ছিল না। এটুকুই যথেষ্ট যে তার মধ্যে ‘কিং খান’ কথাটা ছিল। শাহরুখ অভিনীত চরিত্রের নামে কিন্তু খান নেই।

এইভাবে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে সামনে এনেছেন বলেই, না ভেবে উপায় থাকে না যে নিজের ব্যক্তিজীবনকে এই ছবির আখ্যান বোনার সুতো হিসাবে ব্যবহার করেছেন শাহরুখ। তাঁর ভক্তরা নিশ্চয়ই জানেন, যাঁরা জানেন না তাঁরা ফরীদা জালালের নেওয়া এই সাক্ষাৎকার শুনলে জানতে পারবেন যে শাহরুখের বাবা মীর তাজ মহম্মদ খান স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের জেনারেল শাহনওয়াজ খান মীরের ঘনিষ্ঠ এবং আত্মীয়।

জওয়ান ছবিতে শাহরুখ অভিনীত একটা চরিত্রের নাম আজাদ। সে মেয়েদের নিয়ে নিজের এক ফৌজ গড়ে তোলে। সে ফৌজের লক্ষ্য দেশের ভাল করা। এক অর্থে আজাদ হিন্দ ফৌজই বটে। মজার কথা, এ দেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীতে মেয়েদের নিয়ে আলাদা ব্রিগেড গড়ে তোলার ঘটনা আজাদ হিন্দ ফৌজেই প্রথম। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের রানী লক্ষ্মীবাঈ ব্রিগেডের সঙ্গে শাহরুখের মহিলা ব্রিগেডের আরও একটা সাদৃশ্য ছবিটা দেখামাত্রই ধরা পড়বে। সেকথা উহ্য রাখলাম স্পয়লার দেব না বলেই।

শাহরুখের একখানা সংলাপ নিয়ে বিজেপিবিরোধীরা বিশেষ উল্লসিত এবং বলা হচ্ছে ওটা তাঁর ছেলে আরিয়ানকে যারা গ্রেফতার করেছিল তাদের উদ্দেশে বলা – ‘বেটে কো হাথ লগানে সে পহলে বাপ সে বাত কর’। এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে সেকথা ভেবেই ওই সংলাপ লেখা হয়েছে, কিন্তু উপরের সাক্ষাৎকার শুনলে মনে হয় জওয়ান ছবিটা অনেক বেশি করে নিজের বাবার প্রতি শাহরুখের শ্রদ্ধাঞ্জলি। সাক্ষাৎকারের শেষ ৩-৪ মিনিটে বাবা দেশ এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে কী কী বলেছিলেন শাহরুখ তার বিবরণ দেন। সে বিবরণে জওয়ানের পদশব্দ শোনা যায়। নেহাত ঠাট্টা করেই ছবির শেষের দিকে আনা হয়েছে লায়ন কিংপ্রসঙ্গ। কিন্তু ঠাট্টার আড়ালে লুকিয়ে আছে চোখের জল। সিম্বার মত ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছিলেন শাহরুখ। অ্যাটলির মুনশিয়ানায় বার্ধক্যের দ্বারে পৌঁছে মহাতারকা প্রায় দর্শকের অলক্ষ্যে পূরণ করে নিলেন বাবার সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার অপূর্ণ ইচ্ছা। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবার থেকে যা শিখেছেন সবটুকু নিংড়ে দিলেন দর্শকের জন্য, দেশের দারুণ দুঃসময়ে।

শিল্পীরাই এসব করতে পারেন। একজন শিল্পী এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা পারেন?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.