ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফল রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে খুব একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। বিধানসভার ভিতরে হোক বা বাইরে – কোথাও এই উপনির্বাচনের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। সংবাদমাধ্যমও ধূপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচন নিয়ে খুব বেশি সময় খরচ করেনি। তবে ধূপগুড়ির ফলাফল থেকে উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক চিত্রটা আরেকটু স্পষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। নিজেদের পুরনো দুর্গে বিজেপির পরাজয় নিঃসন্দেহে সাংগঠনিকভাবে গেরুয়া শিবিরের জন্য খারাপ সংকেত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল, যে রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ককে তাঁদের একচেটিয়া সম্পত্তি বলে মনে করতেন বিজেপির রাজ্য নেতাদের একাংশ, তা যে আর আগের মত নেই, সেই সত্য দিনের আলোর মতই স্পষ্ট হয়ে গেল এই ফলাফলে। এমনকি অনন্ত মহারাজকে প্রচারে নামিয়েও কাজের কাজ কিছু হল না। চা বাগান এলাকায় বিজেপির একাধিপত্যেও যে বড়সড় ফাটল ধরেছে, তা স্পষ্ট। সবমিলিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ধূপগুড়ির পরাজয় বিজেপির উদ্বেগ বাড়াবেই।
কেবল রাজ্য বিজেপির নেতারাই যে উদ্বিগ্ন, তা তো নয়। উদ্বিগ্ন দিল্লির নেতারাও। সেই কারণেই উপনির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরেই তড়িঘড়ি রাজ্যে এসেছেন খোদ অমিত শাহের দূত বি এল সন্তোষ। না এসে উপায়ই বা কী? পরের বছরই লোকসভা নির্বাচন। দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটিতে কতখানি দাঁত ফোটানো যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে বিজেপির অন্দরেই। উত্তরবঙ্গের পরিচিত ঘাঁটিতেও যদি জমি হারাতে হয়, তাহলে তো মহাসংকট। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের পর থেকে বঙ্গ বিজেপির সাফল্যের লেখচিত্র রীতিমত নিম্নমুখী। একের পর এক নির্বাচনী বিপর্যয়, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সাংগঠনিক দুরবস্থা, আন্দোলনহীনতা – সব মিলিয়ে নাজেহাল গেরুয়া শিবির। ঘটনা হল, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উপনির্বাচনেই জিততে পারেনি বিজেপি। দক্ষিণবঙ্গের শান্তিপুরের পর উত্তরবঙ্গে নিশীথ প্রামাণিকের খাসতালুক দিনহাটায় হেরেছিল বিজেপি। এবার উত্তরবঙ্গেরই ধূপগুড়িতে হার হল। অর্থাৎ একুশে জেতা তিনটি আসনে হারতে হল গেরুয়া শিবিরকে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২০১৮ সাল থেকেই ধূপগুড়িতে শক্তি সংহত করেছে বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ন্ত রায় জলপাইগুড়ি আসনে ১,৮৪,০০৪ ভোটে জিতেছিলেন। ধূপগুড়ি বিধানসভাতেও ১৭,৭৬৬ ভোটে এগিয়ে ছিলেন তিনি। এরপর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ব্যবধান কমলেও বিজেপি ৪৬% রাজবংশী ভোটারের কেন্দ্র ধূপগুড়িতে জিতেছিল ৪,৩৫৫ ভোটে। আড়াই বছর পর ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে হারতে হল ৪,৩০৯ ভোটে। অর্থাৎ ব্যবধান প্রায় সমান, কেবল জয়ী আর বিজিতের অবস্থান বদলে গিয়েছে।
এই উপনির্বাচনে জিততে মরিয়া ছিল বিজেপি। পঞ্চায়েত নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পর রাজবংশী নেতা অনন্ত রায়কে (মহারাজ) রাজ্যসভায় পাঠানো হয়েছিল। তিনি প্রচারও করেছেন। কিন্তু তাতেও আটকানো যায়নি রাজবংশী ভোটে ধ্বস। বরং ফলপ্রকাশের পর অনন্ত মহারাজের মন্তব্য বিজেপির অস্বস্তি বাড়াবে। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “রাজবংশী সমাজের মনোভাব বুঝতে হবে। তাঁদের চাহিদা না মিটলে সমর্থন পাওয়া যাবে না।” কী সেই চাহিদা? অনন্ত মহারাজের কথায়, “রাজবংশীরা চান পৃথক রাজ্য। এটা আমার চাওয়া নয়। জনতা জনার্দনের চাওয়া।” ‘মহারাজ’ আরও বলেছেন, “আমি তো আর রাজ্যসভায় যাওয়ার জন্য লালায়িত ছিলাম না।” সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বিজেপির জন্য খুব সুবিধার নয়।
২০২১ সালের পর থেকেই অবশ্য বিজেপির রাজবংশী সমর্থনের ভিত্তিতে ফাটল ধরেছে। ২০১৯ সালের লোকসভায় সবচেয়ে বেশি রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের বাস যে কেন্দ্রে, সেই কোচবিহার থেকে বিরাট ব্যবধানে জিতে সাংসদ হন বিজেপির নিশীথ। ২০২১ সালে তিনি দিনহাটা বিধানসভায় প্রার্থী হয়ে জেতেন মাত্র ৫৭ ভোটে। এরপর সাংসদ নিশীথ ওই বিধানসভা আসন ছেড়ে দেওয়ায় যে উপনির্বাচন হয়, তাতে তৃণমূলের কাছে বিজেপি দেড় লক্ষেরও বেশি ভোটে হারে। সেই শুরু। এরপর থেকে আর বিজেপির রাজবংশী ক্ষত নিরাময় হয়নি। চেষ্টার কিন্তু কসুর ছিল না। রাজবংশী নিশীথকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করা হয়, বাংলা থেকে প্রথম সুযোগেই রাজ্যসভায় পাঠানো হয় রাজবংশী সমাজের ‘মহারাজা’ অনন্ত রায়কে। কিন্তু কোনোকিছুতেই কাজ হয়নি।
ধূপগুড়িতে সবকটি দল এবং নির্দল মিলিয়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন সাতজন। সকলেই রাজবংশী। ফলাফলে দেখা গেল বিজেপির রাজবংশী ভোটে বড়সড় থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। অন্যদিকে সাগরদীঘির উপনির্বাচনে মুসলমান ভোটারদের বড় অংশ বাম-কংগ্রেস জোটের পক্ষে দাঁড়ালেও ধূপগুড়িতে সংখ্যালঘু ভোটের অধিকাংশই পেয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে রিগিং এবং গা জোয়ারির অভিযোগ ছিল, উপনির্বাচনে তা হয়নি। প্রায় কোনো অভিযোগ করেননি বিরোধীরা। তারপরেও কার্যত মসৃণ জয় পেল শাসক দল।
আরো পড়ুন নির্বাচনে প্রহসন হওয়া সত্ত্বেও বিজেপির ক্ষতি, তৃতীয় শক্তির লাভ স্পষ্ট
উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে ধূপগুড়িকে পৃথক মহকুমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জি। নিঃসন্দেহে ভোটারদের একাংশ তাতে প্রভাবিত হয়েছেন। কিন্তু তাতে বিজেপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ঢাকে না। ২০১৯ সালে বিজেপি যে কটি পকেটে দারুণ ফল করেছিল, সেগুলির মধ্যে জঙ্গলমহলে ইতিমধ্যেই সংগঠন তলানিতে। দক্ষিণবঙ্গের অন্যত্রও অবস্থা তথৈবচ। ভরসা বলতে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী এবং রাজবংশী ভোট। ধূপগুড়ি উপনির্বাচনের ফল দেখিয়ে দিল, অবস্থার তেমন পরিবর্তন না হলে চব্বিশের ভোটে বঙ্গ বিজেপির ‘সর্বরোগহর’ মোদী ম্যাজিক বাদে তেমন আশা করার মত কিছু থাকবে না।
অবশ্য যদি ততদিন পর্যন্ত মোদী ম্যাজিক বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।