পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে। সমস্যা অজস্র। স্কুলশিক্ষা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় – সবই বেহাল। সকলেই সব জানেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। রাজ্য এবং কেন্দ্র – দুই সরকারই শিক্ষার হাল ফেরানোর বিষয়ে কেবল নিস্পৃহই নন, নিজেদের মল্লযুদ্ধের ক্ষেত্র করে তুলেছেন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। স্কুলশিক্ষার অবস্থাও তথৈবচ। একটির পর একটি স্কুল বন্ধ হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি, অসংখ্য শূন্যপদ। কবে এই অবস্থার অবসান ঘটবে কেউ জানেন না।

এবার শিক্ষক দিবসে শিক্ষকরা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখে বেতন বন্ধের হুমকি শুনলেন, অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরির চেতাবনি শুনলেন। অবশ্য বঙ্গ রাজনীতির তরজায় এ আর নতুন কী? মুখ্যমন্ত্রীর এই হুমকির তিরের মুখ আসলে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের দিকে। পাল্টা প্রতিক্রিয়া বা কৌশলে অবশ্য তিনিও কম যান না। যেমন কিছুদিন আগে তিনি নিজেকে রাজ্যের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য বলে ঘোষণা করেছেন। পদাধিকারবলে যিনি আচার্য, তিনিই আবার নিজেকে উপাচার্য হিসাবে ঘোষণা করলেন! এ তো বাম হাত ডান হাতকে চিঠি লেখার উপক্রম! বাংলায় কি একুশে আইন চলছে নাকি? তবে রাজভবনের কীর্তি কেবল এটুকুই নয়। এরও আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নিয়মের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে অন্য রাজ্যের এক বিচারপতিকে এ রাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করেছেন রাজ্যপাল। এমনকি এক প্রাক্তন আইপিএসকেও উপাচার্য পদে বহাল করেছেন। তারও আগে তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই উপাচার্য নিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ। অন্যদিকে, রাজ্যপাল যাঁদের নিয়োগ করেছিলেন তাঁদের রাজ্য সরকার পরোক্ষে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। শুরু হয়েছে দুই রাজনৈতিক শক্তির সংঘর্ষ, যার জেরে কার্যত ডকে উঠেছে পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসন বলে কার্যত কিছু নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

অদ্ভুত এক হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে রাজ্যের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি। এতে সবচেয়ে বিপাকে পড়ছেন নিঃসন্দেহে ছাত্রছাত্রীর। প্রশ্ন জাগে, রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর ইগো এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে কেন বলি হতে হবে শিক্ষার্থীদের? অদ্ভুত আঁধার এখন রাজ্যের উচ্চশিক্ষায়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালগুলিতে কান পাতলে শোনা যায় শুধু হা হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাস। একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতির গেরোয় পড়াশোনার বেহাল অবস্থা। পরিকাঠামো নেই, নতুন শিক্ষক/অধ্যাপক নিয়োগ নেই। তার উপর চার বছরের ডিগ্রি কোর্স চালুর মত পদক্ষেপ ভাবাচ্ছে রাজ্যের অধ্যাপককুলসহ সমস্ত সচেতন মানুষকে। শিক্ষার পাঠক্রম পরিবর্তন নিয়েই একটা অন্য বড় আলোচনা হতে পারে। শিক্ষার পরিবেশ, যা না থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে, তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে আসলে সীমাহীন নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আমাদের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকদের। রাজ্য সরকার বনাম রাজ্যপাল – এই যুদ্ধে অংশগ্রহণে আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে। সত্যিই কি এই যুদ্ধে আমাদের কোনো পক্ষের সৈনিক হওয়ার প্রয়োজন আছে?

আসলে এই যুদ্ধ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের। আমরা যারা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাদের তো এই যুদ্ধে থাকারই কথা নয়। তাহলে কেন সেদিকে আমাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? কেনই বা এই চাপান উতোরে শিক্ষা ক্রমশ ন্যুব্জ হবে? শিক্ষার স্বাধিকারের প্রশ্ন, শিক্ষার ব্যয়ভার কে বহন করবে, সার্বজনীন গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার দাবি – সবকিছুকেই পিছনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে যেমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার খর্ব করা হত, আজও তাই চলছে। তখনকার সাম্রাজ্যবাদী শাসক আর আজকের স্বাধীন দেশের শাসকদের মধ্যে কোনো নীতিগত কোনো ফারাক আছে কিনা – এই প্রশ্ন জাগে। ইদানীং যা চলছে তাকে তো অলীক কুনাট্যরঙ্গ বলা ছাড়া উপায় নেই।

বাংলার বাঘ নামে পরিচিত একদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সেনেটের সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন “বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীতদাস তৈরির কারখানা হবে না। আমরা সত্যি সত্যি চিন্তায় নিমগ্ন হতে চাই। আমরা স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে চাই। আমরা উদীয়মান প্রজন্মকে উচ্চস্তরের এবং শক্তি প্রদান করে এমন ভাবনা ও ধারণা দিয়ে প্রেরিত করব। আমরা সরকারের সেক্রেটারিয়েটের অংশ হব না।

কী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে? আড়াই লক্ষ টাকা! আর আপনারা ভারি ভদ্রভাবে বলছেন এর বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেওয়া উচিত। সারা বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ জন্য আমাদের ধিক্কার জানাবে না? আমরা ন্যায়সঙ্গত বিষয় নিয়ে কাজ করছি এবং আমরা অপমানজনক শর্তাবলী মেনে নেব না। আমাদের স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষকরা স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়ার চেয়ে না খেয়ে থাকবেন।

সেনেটের সদস্য হিসাবে আমি আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবার আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলার সরকারকে ভুলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটর হিসাবে, আপনাদের নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সত্যিকারের সন্তান হিসাবে নিজের কর্তব্য পালন করুন। স্বাধীনতা প্রথম, স্বাধীনতা দ্বিতীয়, স্বাধীনতাই সর্বদা – অন্য কোনোকিছুই আমাকে সন্তুষ্ট করবে না

(The University will not be manufactory of slaves. We want to think truly. We want to teach freedom. We shall inspire the rising generation with thoughts and ideas that are high and enabling. We shall not be a part of the Secretariat of the Government.

What is the offer? Two and a half lacs! And you solemnly propose that we should barter away our independence for it. Will not future generations cry shame through Bengal? Our cause is just and we shall not submit to humiliating conditions. Our post-graduate teacher would starve themselves rather than give up their freedom.

I call upon you, as members of the Senate, to stand up for the rights of your university. Forget the Government of Bengal. Forget the Government of India. Do your duty as Senators of the University, as true sons of your Alma Mater. Freedom first, freedom second, freedom always – nothing else will satisfy me.)।”

১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি আরও বলেন, “পড়াশোনার বিষয়ের সম্ভার এবং অধ্যাপনা ও গবেষণা প্রণালীর ব্যাপারে উপর নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে বাইরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে দুরকম পায়ের বেড়ি থেকেই মুক্ত রাখতে হবে – রাষ্ট্রের তৈরি রাজনৈতিক বেড়ি আর ধর্মীয় সংগঠনগুলোর তৈরি ধর্মীয় বেড়ি…

(The university must be free from external control over the range of subjects of study and methods of teaching and research. We have to keep it equally free from the trammels in other directions – political fetters from the state, ecclesiastical fetters from religious corporations…)।”

প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আদৌ এগোতে পারলাম একশো বছরে?

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী উমাশঙ্কর যোশী বলেছিলেন, “গণতন্ত্রে শিক্ষাব্যবস্থা চালানো উচিত অভিভাবক, শিক্ষাবিদ প্রমুখকে নিয়ে তৈরি পাবলিক কমিটির। সরকারের উচিত এই প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ না করে সাহায্য করা, আর্থিক সাহায্য দেওয়া যাতে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ শিক্ষা পেতে পারেন এবং শিক্ষা নিয়ে নতুন গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া।

(In democracy, education should be done by public committees formed by parents, educationists etc. Government should not interfere but help the process, provide financial help so that economically backward people can get education and encourage new researches of education.)”

এই তো শিক্ষার প্রকৃত স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা। আজ কি এগুলি রক্ষিত হচ্ছে? নাকি কেবল রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষায় বশংবদদের নিয়োগ করা হচ্ছে বিভিন্ন পদে?

আজ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বলেছেন, তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবরোধ তৈরি করবেন। দু পক্ষের শস্তা রাজনীতি আজ শিক্ষাজগতে অচলাবস্থা ডেকে আনছে। আজ বঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায় যে অমানিশা তা থেকে বেরনোর রাস্তা কোথায়? আমরা যাদের ভারতভাগ্যবিধাতা বানিয়েছি, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাদের জন্যে শব্দটি প্রয়োগ করেননি। এ দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের আপোসহীন লড়াই কি ভুলে গেলাম স্বাধীনতার ৭৬ বছরে?

আসলে শিক্ষার জগতে এই নৈরাজ্য, নীতিহীনতা এক দিনে তৈরি হয়নি। আজকের মুখ্যমন্ত্রী বা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী একাধিকবার নানা ভাষায় যা বলেছেন তার সারমর্ম হল – আমরাই তো বেতন দিই। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ‘আমরা যে টাকা পাঠাই, তা বন্ধ করে দেব’ জাতীয় মন্তব্য আকছার করে থাকে। আমাদের ভাবতে হবে টাকা দেওয়া কি তাঁদের দয়া, না দায়িত্ব? এই যে দুই পক্ষের বিবাদ তার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কতটুকু? এই বিবাদের লক্ষ্য কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা? নাকি এই দ্বন্দ্ব আসলে ক্ষমতা দখল এবং প্রদর্শনের জন্য? কথায় আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এখানে উলুখাগড়া হল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অধ্যাপকরা। এই দ্বৈরথে পিছনে চলে যাচ্ছে আশু সমস্যা। সম্প্রতি র‍্যাগিংকে কেন্দ্র করে পড়াশোনার পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হল। কে এর ভরপাই করবে জানা নেই। এদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি চালু করতে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন তা নেই।

আরো পড়ুন কলেজ সংকট: ছাত্রছাত্রী সব গেল কোথায়?

এছাড়া রয়েছে কলেজ সার্ভিস কমিশনের বিরুদ্ধে আছে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। যে স্বল্পসংখ্যক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীর নাম প্রকাশিত হয়েছে তাদের প্রাপ্ত নম্বর উল্লেখ করা নেই। তফসিলি জাতি, উপজাতির তালিকা ঘিরেও ব্যাপক গরমিলের অভিযোগ আছে। ইতিমধ্যেই স্কুল স্তরে ছাত্রছাত্রীর অভাব দেখিয়ে সরকার ৮২০৭টি স্কুলের অনুমোদন বাতিল করেছে। অন্যদিকে বহু স্কুলে শিক্ষক নেই। অল ইন্ডিয়া সার্ভে ফর হায়ার এডুকেশন ২০২০ (সরকারি) তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী/অস্থায়ী শিক্ষক সংখ্যা ৫০,০৯৩। অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ইউজিসি গাইডলাইন অনুযায়ী হওয়া উচিত ২০:১, কিন্তু রয়েছে ৪০:১। সোজা কথায়, শিক্ষক প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক। লক্ষ লক্ষ আসন খালি। এসব নিয়ে দুই সরকারের কারোর মাথাব্যথা নেই।

সময় এসেছে সমাজটা কোন দিকে যাবে তা ভাবার। অধিকারের প্রশ্ন তোলার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। অবস্থার দাসত্ব ছেড়ে বদল মানুষকেই করতে হয়। ইতিহাস সেই শিক্ষাই দেয়।

-মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.