দ্য কেরালা স্টোরি আমি দেখিনি। আপাতত, দেখার জন্য কেউ খানিক মোটা টাকা না দিলে, দেখার কথা ভাবছিও না। দশক দুয়েক আগে তৈরি চন্দ্রবিন্দুর একটি গানের শুরুতে ছিল, ‘কিছু কিছু বস্তু আছে শুরুতেই শেষ’। এ-ও সেরকম। কী দেখাবে, কীভাবে দেখাবে – সবই অনুমান করা যায়। আগেই ছবির নির্মাতারা বলে দিয়েছেন, এ ছবি লাভ জেহাদ নিয়ে। লাভ জেহাদ কী – তা গত দেড় দশকে, হিন্দুত্ববাদীদের কল্যাণে, আমরা প্রায় সকলেই জানি। দেশ জোড়া প্রেমের ফাঁদ পেতে বসে আছে মুসলমান যুবকরা। বাইক, মোবাইল ও হোটেল-রেস্টুরেন্টে খাওয়ার টাকা পকেটে নিয়ে, মূলত হিন্দু ঘরের মেয়েদের পটিয়ে, বিয়ে করে, ধর্মান্তরিত করে, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে তাদের ইসলামিক ধর্মযুদ্ধের দায়িত্ব পালন করার জন্য। সুতরাং হিন্দু সাবধান। মুসলমানদের হাত থেকে ঘরের মেয়েদের সামলে রাখুন। এমনকি প্রভাবশালী হিন্দুত্ববাদী নেতারা ডাক দিয়েছেন “বেটি বচাও, বহু লাও”। অর্থাৎ ঘরের মেয়েদের মুসলমানদের নজর থেকে বাঁচান আর মুসলমান ঘরের মেয়েদের নিজের ঘরে বউ করে আনুন। এতে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
দ্য কেরালা স্টোরি এই গল্পকে আরেক ধাপ উপরে নিয়ে গিয়ে বলছে, হিন্দু মেয়েদের শুধু ধর্মান্তরিতই করা হচ্ছে না, তাদের আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়া, ইরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে নির্মাতারা বললেন, এই সিনেমা এরকম ৩২,০০০ মেয়ের গল্প, যার অধিকাংশই হিন্দু আর কিছু খ্রিস্টান। যেই এই সংখ্যা নিয়ে হইচই শুরু হল, ৩২,০০০ নেমে এল মাত্র তিনে। ভাবুন। দু মিনিট চুপ করে থাকুন, পড়া বন্ধ করুন। শুধু ভাবুন যে ৩২,০০০ থেকে সংখ্যাটি রাতারাতি তিনে নেমে আসতে গেলে কী পরিমাণ মিথ্যাচার থাকতে হয় একটি ছবির নির্মাণে। একে আমি গাঁজাখুরি বলতে রাজি নই – কারণ আমি জীবনে অনেক গাঁজাখোর দেখেছি। তাদের কাউকে এই কদর্যতা করতে দেখিনি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এখন প্রশ্ন হল, এই তিন সংখ্যাটিই বা কোথা থেকে এল? সে প্রসঙ্গে আসব। ঘটনা হল, আপনি যদি এদেশের হিন্দুত্ববাদী শাসকদের দালালি করে একটি ভাষ্য তৈরি করেন, তাহলে সেই এক বালতি চোনায় যতটুকু দুধই থাকুক, তা সরকার বাহাদুর খাঁটি বলেই শংসাপত্র দেবেন। যেমন ধরুন, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে মুক্তি পাওয়া উরি: দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক। ২০১৬ সালে ভারতীয় সেনার সেই বহুচর্চিত সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে বানানো এই ছবি ওই ঘটনা সংক্রান্ত মোদী সরকারের প্রচারকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায়। পুরস্কারস্বরূপ উত্তরপ্রদেশের আদিত্যনাথ সরকার শুরুতেই সিনেমাটিকে করমুক্ত করে দেয়। একটি ছবিকে কখন করমুক্ত করার কথা? যখন তা কোনো জনকল্যাণমূলক বার্তা নিয়ে আসে। তা উত্তরপ্রদেশ সরকার মনে করল এই ছবি মোদী সরকারের সব দাবিকে চূড়ান্ত প্রচার দিচ্ছে, অতএব এর থেকে বেশি জনকল্যাণ আর কিসে আশা করা যেতে পারে?
সেবছর ওই নির্বাচনের আগেই মুক্তি পায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিজেপি-সংঘ পরিবারের যে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব – কংগ্রেস নেতৃত্বের চক্রান্তে তাসখন্দে শাস্ত্রীর রহস্য মৃত্যু হয় – তাকে ভিত্তি করে তৈরি বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর দ্য তাশখন্দ ফাইলস। একে করমুক্ত করা হয়নি, কিন্তু বিবেকবাবুর পরের ছবিটি – দ্য কাশ্মীর ফাইলস – মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকার বুঝিয়ে দিয়েছিল, এরকম ছবি করলে তার প্রচার ও অর্থলাভের জন্য যাবতীয় চেষ্টা করা হবে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই ছবিটিকে ভিত্তি করে কাশ্মীরী পণ্ডিত ইস্যুতে বিরোধীদের জোর এক হাত নিলেন। মোদীজির স্তুতির ফলে একদিকে হলে ভিড় বেড়ে গেল, অন্যদিকে একের পর এক বিজেপিশাসিত রাজ্য ছবিটিকে করমুক্ত তকমা দিয়ে বেবাক মুনাফা করার রাস্তা খুলে দিল। দ্য কেরালা স্টোরির বেলাতেও সেই একই ঘটনা ঘটছে। কর্ণাটকে নির্বাচনী প্রচারে মোদীবাবু স্বয়ং এই ছবির দারুণ প্রশংসা করেছেন। তারপর বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি এই ছবিকে করমুক্ত করতে শুরু করেছে।
আরো পড়ুন ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ শিল্প তো নয়ই, প্রচারও নয়
বিশ্বব্যাপী জেহাদ ও ভারত
যা বলছিলাম, দ্য কেরালা স্টোরি আমার দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ ছবির প্রতিপাদ্য যেভাবে নির্মাতারা আগাম বর্ণনা করেছেন – যা ভারতীয় মুসলমানদের আইসিস-আল কায়দার বিশ্বব্যাপী জেহাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত হিসাবে চিত্রিত করে – তার অবস্থান বাস্তবের থেকে ৩১,৯৯৭ যোজন দূরে।
ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান ভারতে থাকেন। অথচ, আল কায়দা ও আইসিস পরিচালিত যে তথাকথিত বিশ্বব্যাপী জেহাদ বা ইসলামিক ধর্মীয় শাসন জারি করার সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা, তাতে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ বরাবরই অতীব নগণ্য। ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে তালিবানদের লড়াইয়ে সামিল হতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া সহ নানা দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে বহু যুবক আফগানিস্তানে ঘাঁটি গাড়ে। এদের অনেকেই পরে নিজেদের দেশে ফিরে সেখানে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম শুরু করে। কিন্তু ভারতের প্রায় কোনো অংশগ্রহণই ছিল না সেখানে। ভারতে স্বতন্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী আছে, যাদের দৌড় মূলত পাকিস্তান পর্যন্ত আর মূল কর্মক্ষেত্র কাশ্মীর। কাশ্মীর নিয়ে বহু প্রচারের পরও আল কায়দা ভারত থেকে খুব বেশি নিয়োগ করে উঠতে সক্ষম হয়নি। এমনকি বছর সাত-আটেক আগে যখন ইসলামিক স্টেট বা আইসিসের বিপুল উত্থান ঘটল সিরিয়া-ইরাক চত্বরে, সেই ঢেউ ঢাকা ও ইসলামাবাদে ধাক্কা দিলেও দিল্লি অবধি পৌঁছয়নি।
এ নিয়ে নানা স্তরে লেখালিখি, আলোচনা হয়েছে। আমি কয়েকটির সামান্য উল্লেখ করছি। ২০১৫ সালে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ অজয় সাহনি, যিনি ইন্সটিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট ও সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, একটি নিবন্ধে লেখেন যে যেখানে ইউরোপের স্বল্প জনসংখ্যার দেশগুলি থেকে শয়ে শয়ে যোগদান দেখা গেছে আইসিসে, সেখানে ভারত থেকে যোগ দিয়েছিল মাত্র ১৮ জন। (ছ বছর পরে ২০২১ সালে মার্কিন রিপোর্টে এই সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৬৬)।
সাহনি দেখান, উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দী ভাবধারা এবং দক্ষিণ ভারতের আবুল আ’লা মওদুদীর জামায়াত-এ-ইসলামির চিন্তা ও কাজের মধ্যে মৌলবাদী তথা সন্ত্রাসবাদী চিন্তাভাবনার অনেক খোরাক থাকলেও (দেওবন্দ বরাবর হিংসার বিরোধিতা করেছে), এবং এই দর্শন মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াতেও উগ্র ইসলামিক চিন্তাকে প্রভাবিত করলেও, ভারতে ইসলামিক সন্ত্রাস মূলত পাক-মদতপুষ্ট সন্ত্রাসেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। রাষ্ট্রশক্তির বাইরে শুধু ধর্মীয় শক্তি হিসাবে মুসলিম সন্ত্রাসবাদ এদেশে মাথা চাড়া দেয়নি।
তাঁর বিশদ আলোচনার সমস্তটায় না গিয়ে, নিবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদের অনুবাদ এখানে তুলে দিচ্ছি
“সমাপ্তিতে এটুকু বলার, যে উগ্রবাদী মুসলিম আদর্শ ভারতীয় মুসলিমদের সহজে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। ভারতের মুসলিম সমাজ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ও তাদের সাথে নিয়মিত আদানপ্রদানে অভ্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে, অন্যদের মনুষ্যেতর গণ্য করে তাদের মৃত্যু ও চিরন্তন অভিশাপের পরোয়ানা জারি করা কঠিন। ধর্মীয় সহনশীলতার এক সাধারণ সংস্কৃতি – শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও আইনি পরিভাষার ধর্মনিরপেক্ষতা নয় – ধর্মীয় চেতনাকে প্রভাবিত করে। দেশের সাংবিধানিক ও সভ্যতাগত ধর্মনিরপেক্ষতার যে অন্তর্নিহিত নির্যাস, তা-ই নিরাপত্তা সংক্রান্ত খামতি সত্ত্বেও উগ্র ইসলামিক সংগঠনের বিরুদ্ধে ভারতের বর্তমান সাফল্যের মূল কারণ। অবশ্যই একথা সত্য যে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও কয়েক শতাব্দীর মেলামেশা সত্ত্বেও, ভারতের সমাজ ও রাজনীতি এখনও সামাজিকভাবে এবং আবেগের দিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝেই জ্বলে ওঠা সাম্প্রদায়িক উদ্দীপনা এর প্রমাণ। তথাপি, পাকিস্তানি গবেষক ও রাজনীতিক হুসেইন হক্কানির ভাষায়, “ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক সংবিধান দেশের মুসলিমদের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের চেয়েও বেশি ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে, আর গঠনগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলির কারণে উগ্রবাদীরাও ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।”
সাহনি একা নন। ২০১৯-এ সরকার ঘেঁষা, আম্বানি প্রভাবিত অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রকাশিত একটি নিবন্ধে কবীর তানেজা ও মহম্মদ সিনান সিয়েচ লেখেন, “বিশ্লেষকরা ভারতকে আইসিসের বিদেশী সেনাবাহিনীর জন্য আদর্শ নিয়োগক্ষেত্র ভেবেছিলেন। কিন্তু এ দেশ সেই সব বিশ্লেষকদের ভুল প্রমাণ করেছে, হাতেগোনা কিছু আইসিসপন্থী ঘটনা পাওয়া গেছে এখানে।“
মনোহর পারিক্কর ইন্সটিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের গবেষক আদিল রশীদও তাঁর ২০২০ সালের গবেষণায় প্রায় একই কথা বলেছেন। ওই ২০২০ সালেই ফরেন পলিসি পত্রিকায় একটি লেখায় রাফায়েলো পান্টুচ্চি আইসিসের যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু কেরলের বাসিন্দা এবং তিন কাশ্মীরীর মৃত্যুর উল্লেখ করে বলেন, যদিও সংখ্যার বিচারে এটি খুবই নগণ্য, তবু একে প্রবণতা হিসাবে অগ্রাহ্য করা অনুচিত।
তিনি নিশ্চয়ই ঠিকই বলেছেন। কারণ যে কোনো ধর্মীয় উগ্রতা, যা সন্ত্রাসের রূপ নিতে পারে, তাকে গোড়াতেই সমূলে উৎপাটিত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আপত্তি করবেন না। লেখক ভারতে হঠাৎ জেহাদি প্রচার বৃদ্ধির পিছনে মোদীর নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর মুসলিমবিরোধী নীতির বিশেষ ভূমিকা দেখেছেন।
একইভাবে সাহনির লেখাটির কথা ভাবুন। তিনি ভারতের যে অন্তর্নিহিত সহনশীলতার জন্য এদেশের মাটিতে ইসলামিক উগ্রতা জমি পায়নি বলে দেখিয়েছেন, সেই সহনশীলতাকেই আজ গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদীরা। ভারতীয় মুসলমানদের জোর করে উগ্রতার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে এই উগ্রবাদী হিন্দুত্ব প্রচারকরা। যে জমি নেই, সেই জমি তৈরি করার চেষ্টা করছে এরা, যাতে মুসলমানদের ভয় দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিরত রাখা যায় আর্থসামাজিক ব্যর্থতা ও উন্নয়নের নামে জনগণের সম্পদ লুঠ নিয়ে প্রশ্ন করা থেকে। এইরকম পরিস্থিতিতে শয়ে শয়ে নয়, হাজারে হাজারে ধর্মান্তরিত সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের আষাঢ়ে গল্প শোনাতে এলে তা কি আদৌ কারোর দেখার বা শোনার প্রয়োজন আছে?
ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরেই প্রায় সব মূলধারার সংবাদমাধ্যমেই রিভিউতে ছবিটির গুষ্টির তুষ্টি করা হয়েছে। মানে প্রায় সব সমালোচকই লিখেছেন এটি পচা, ভুষি মাল। কিন্তু আমার একটি ভিডিও চোখে পড়ল, যা ফেসবুকে ঘুরছিল। সিনেমা দেখে বেরোচ্ছেন এরকম এক পরিবারের এক মধ্যবয়স্ক মহিলা সদস্যকে প্রশ্ন করলেন এক মহিলা সাংবাদিক। দর্শকটি, প্রথমে ভাল লেগেছে বলেই, আগে জিজ্ঞেস করে নিলেন সাংবাদিকটি হিন্দু না মুসলমান। সাংবাদিক হিন্দু শুনে তিনি একটু আশ্বস্ত হয়ে বললেন “খুব ভাল লেগেছে। সব হিন্দুর দেখা উচিত। (সিনেমায়) মুসলিমদের দেখে ভয় লেগে গেল!”
ভারতের কাঠামোর উপর এই যে আঘাত, তা দেখে আঁতকে উঠে অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই দ্য কেরালা স্টোরি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন। কিন্তু সে এক সহজ সমাধানের রাস্তা – যা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে পারবে না। তা করতে হলে প্রকৃত বাস্তব মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার। ধর্মের নেশায় মত্ত একদল শাসক-অনুগামী ও তাদের পেটোয়া প্রচারকদের বিরুদ্ধে লড়ে ভারতীয় সমাজের মূল কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে হলে আরও বেশি কিছু করা দরকার।
চার জঙ্গি বিধবা
দ্য কেরালা স্টোরির কাহিনীর মূল উৎস হল ২০২০ মার্চে মুক্তি পাওয়া একটি ভিডিও, যার নাম খোরাসান ফাইলস: দ্য জার্নি অভ ইন্ডিয়ান ইসলামিক স্টেট উইডোজ। দিল্লির স্ট্র্যাট নিউস গ্লোবালের এই ২৭ মিনিটের ভিডিওতে এমন চারজন মহিলাকে দেখানো হয়, যাঁরা কেরল থেকে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন ২০১৬-১৮ সালের মধ্যে, আইসিসের খোরাসান প্রদেশের বাহিনীতে যোগ দিতে। ২০১৯ সালে যখন আফগানিস্তানে আইসিস জঙ্গিদের একটি বড় অংশ প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে, এই চার মহিলাও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। এঁদের সকলের স্বামীই যুদ্ধে নিহত। ভিডিওটিতে ভারতীয় নিরাপত্তা আধিকারিকরা যে এঁদের জেরা করছেন তা বোঝা যাচ্ছে। রিপোর্টটির দাবি অনুযায়ী, কেরল থেকে মোট ৬০ জন খোরাসানে গিয়েছিলেন আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করতে।
এঁদের মধ্যে সোনিয়া সেবাস্টিয়ান খ্রিস্টধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন, নাম হয় আয়েশা। মেরিন জ্যাকবও খ্রিস্টান থেকে মুসলমান হন, নাম হয় মিরিয়ম। রেফিলা মুসলমান পরিবারেরই মেয়ে, আর হিন্দু নিমিশা সম্পথ ধর্ম ও নাম পাল্টে হন ফতিমা। এর মধ্যে নিমিশা ও মেরিনের স্বামীরা কিন্তু আদতে মুসলমান ছিলেন না। তাঁরা দুই ভাই – বেস্টিন ও বেক্সন – ছিলেন খ্রিস্টান। বিয়ের পর তাঁরা চারজনই, সম্ভবত একসাথেই, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ২০১৬ সালের কোনো এক সময়ে আইসিসে যোগ দিতে দেশ ছাড়েন। এই নিমিশা তথা ফতিমাই দ্য কেরালা স্টোরির কেন্দ্রীয় চরিত্র। এই একজন মহিলার কথাই জানা গেছে, যিনি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে জঙ্গি হয়ে যান। এঁকে কেন্দ্র করেই ৩২,০০০ ধর্মান্তরিত জঙ্গির গল্প ফেঁদে বসেছেন পরিচালক সুদীপ্ত সেন।
দ্য কেরালা স্টোরি ছবির নির্মাতা যে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটি তিনে নামিয়ে এনেছেন, তার কারণ রেফিলা মুসলমান পরিবারেরই মেয়ে বলে তাঁকে বাদ দিলে সোনিয়া, মেরিন ও নিমিশা মিলে তিন ধর্মান্তরিত কন্যার গল্প পাওয়া যায়। তিনকে ৩২,০০০-এ পরিণত করে তিনি বাঙালির দীর্ঘদিনের প্রবচন – তিলকে তাল করা – কাকে বলে তা দেখিয়ে দিলেন।
ও হ্যাঁ, কেরালা নিয়ে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই তিনি সরকারি কদর পেয়ে গেছেন। এ বছর গোয়ায় ভারতের মুখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে – ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া বা ইফফি – তিনি বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন। কোন যোগ্যতায়, তা খুঁজতে সময় লাগবে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।