হাওড়ার পর এবার রিষড়া। রামনবমী চলে গেছে, পুলিসের উপস্থিতিতে দাঙ্গার মিছিল এখনো চলছে। ২ এপ্রিল সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়াল রিষড়ার জুটমিল সংলগ্ন জিটি রোডে। ঘটনা ঘটার পরেই আশেপাশের শহরে যেভাবে জিটি রোড জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল, বিক্ষোভের নামে বিশৃঙ্খলা হল, তা আগে থেকে পরিকল্পনা না থাকলে হতে পারে না। বিজেপি তাদের কাজ করেছে। কিন্তু রাজ্যের শাসক দল? অশান্তি না হলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ত্রাতা সাজা যাবে না বলেই এসবে মদত দিল। মদত না দিলে বিজেপির মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হত না।

ঘটনার স্থান রিষড়া ও শ্রীরামপুর পৌরসভার একেবারে সীমান্তে। জিটি রোড ধরে উত্তরে কিছুটা গেলেই মাহেশ। জগন্নাথ মন্দির ঘটনাস্থল থেকে হাঁটা পথে মেরেকেটে মিনিট দশেক, যাকে কেন্দ্র করে মাহেশের বিখ্যাত রথযাত্রা। সেই রথযাত্রাতেও বহু লোক আসেন। এই জনসমাগমের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। কিন্তু এই ধরনের অশান্তির আশঙ্কা কোনোদিনই হয়নি। যদিও ইদানীং ওই এলাকায় এমন এক ধর্মীয় স্লোগান খুব শোনা যাচ্ছে, যার সঙ্গে রথযাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

রিষড়া অঞ্চলের ঘটনার পর তৃণমূল সাংসদ নাকি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তিনি বাইরে থেকে বহু লোক আসার অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ সত্য। কিন্তু এ সম্পর্কে আগাম খবর প্রশাসনের কাছে ছিল না? অশান্তির আশঙ্কা তো আগে থেকেই ছিল, বিশেষ করে বিজেপি নেতারা যখন আসছেন। হাওড়ার ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী প্রশ্ন করেছিলেন, মিছিল কীভাবে গেল? যেন পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে সশস্ত্র মিছিল হয়েছিল। তার দুদিন পরেই রিষড়ার ঘটনা। এবার তো রাজ্যবাসী রাজ্য সরকারের কাছেই জবাব চাইবে। প্রস্তুতি চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। টোটো চালকরা পর্যন্ত আশঙ্কায় ছিলেন। বাইকে বাইকে রামনবমীর ঝাণ্ডা নিয়ে উগ্রভাবে চলাফেরা প্রশাসন বা শাসক দলের নজরে ছিল না, বিশ্বাস হয় না। এই উগ্র বিদ্বেষের পরিবেশ নির্মাণের পিছনে কারা থাকে, বাইক বাহিনীকে ভোটের সময়ে কোন দলের কাজে লাগানো হয় তা সবাই জানে। সেই উগ্রতার বিপরীতে সংখ্যালঘুদের একাংশকে তাতিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও শাসক দলের মদত ছাড়া হতে পারে না। ঘটনার পর পুলিশ বীরত্ব দেখাচ্ছে। ঘটনার আগে তারা নিজেদের কর্তব্য করলে এমনটা হত না। এটা সরকারের ব্যর্থতা নয়, মতলব।

রামনবমীর কয়েকদিন পরে এমন মিছিল হয় কী করে? এ বছর দাঙ্গাবাজরা নতুন কৌশল নিয়েছে। মিছিল হচ্ছে বেশ কয়েকদিন ধরে, যাতে উত্তেজনার রেশ ধরে রাখা যায়। একেক দিন একেক জায়গায় উত্তেজনা ছড়ালে দীর্ঘমেয়াদি লাভ। জানা নেই, রাজ্য সরকারের মহালয়া থেকেই দুর্গাপুজো শুরু করা দেখে বিজেপি অনুপ্রাণিত হয়েছে কিনা। এবার আবার রমজান মাসের রোজার মধ্যেই রামনবমী – দাঙ্গাবাজদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ। বিজেপির রাজ্য নেতার উপস্থিতিতে অশান্তি হবে, তারপর শাসক দলের সাংসদ আসবেন। যে পুলিসবাহিনী দাঙ্গার মিছিল পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবে, তারাই আবার ঘটনার পর স্থানীয় মানুষের চলাফেরার ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে কর্তব্য দেখাবে। ধর্ম আর রাজনীতির মেলবন্ধন ঘটলে এমন খ্যামটা নাচই হয়।

ভারতবর্ষের প্রথম জুটমিল হল ওয়েলিংটন জুটমিল। অতিমারীর সময়ে বন্ধ হয়েছিল, মাঝে কিছুদিন চলার পর এখন আবার দীর্ঘকাল বন্ধ। রিষড়া এলাকার এই জুটমিলের উল্টোদিকের মসজিদের সামনেই গত ২ এপ্রিল রামনবমীকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বড় অশান্তি হয়। পাশেই হেস্টিংস জুটমিল। চারিদিকে ঘিঞ্জি বস্তি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তার মধ্যেই রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ওঠা কিছু মাতব্বরের বাস। ধর্ম, রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে থাকেন। বেশিরভাগই ছিলেন বিভিন্ন মিলের শ্রমিক, অনেকেই কাজ করতেন ওয়েলিংটনে। এই জুটমিলে এখনো সংঘ পরিবার বা তৃণমূলের ধামাধরা ট্রেড ইউনিয়ন দুর্বল। রাজ্যে যা এখন বিরল। সর্দারির সুযোগ কম বলেই এই মিলের উপর শাসক দলের কুদৃষ্টি পড়েছে। আজকাল জুটমিল মানেই নানা নামের কম মজুরিতে খাটা অস্থায়ী শ্রমিকদের প্রাধান্য। এঁদের কাজের নিশ্চয়তা নেই, কাজ দেওয়ার নামে বাহুবলী নেতারা রাজনৈতিক ছড়ি ঘোরান। তাঁদের অনেকে আবার পৌরসভার ‘জনপ্রতিনিধি’, এলাকার ভোট নিয়ন্ত্রক। ওয়েলিংটন জুটমিলে বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় মিল খোলা নিয়ে এই নেতাদের বিশেষ উৎসাহ নেই। এই মিলের শ্রমিকদের অনেকে পাশের হেস্টিংস মিলে আগের থেকে কম মজুরিতে কাজ করছেন। কেউ বা নির্মাণ শ্রমিক, ঠ্যালাওয়ালা, হকার বা অন্য কিছু হয়ে গেছেন। তাঁদের ঠ্যালা গাড়ি, ছোট দোকান, টোটো সেদিনের অশান্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পারস্পরিক বিশ্বাস।

দ্রুত বদলে যাচ্ছে এই শিল্পাঞ্চলের অর্থনীতি-সংস্কৃতি-জনবিন্যাস। দেশের বিকাশ আর রাজ্যের উন্নয়নের লিজ নেওয়া বিজেপি ও তৃণমূল সরকারের কর্মযজ্ঞে এখন বন্ধ কারখানার জমিতে বহুতল হওয়াই আধুনিকতার পরিচয়। ছোট থেকে বড় হওয়া এই অঞ্চলে পরিবর্তনটা টের পাচ্ছিলাম বিগত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে। ছেলেবেলায় ঘুম ভাঙত মিলের ভোঁয়ের শব্দে। একটা মিলের নয়, অনেকগুলো মিলের। সবই এখন প্রায় ইতিহাস। মিলকে কেন্দ্র করে নানা ধর্ম, ভাষার লোকের বাস। বাজার, দোকান। শ্রমিকদের বেতনের দিন মিলের গেটের কাছে পসরা নিয়ে বসা হকার, সেখানে উপচে পড়া ভিড়। কোনো মিল লক আউট হলেই ছোট ব্যবসায়ীর রুজিতে টান। এই নিয়েই ছিল এক নিজস্ব জগৎ। অনেক রেশন দোকানে রবিবারের থেকে শুক্রবারে বেশি ভিড় হত। কারণ অনেক মিল শুক্রবার বন্ধ থাকত। মিলগুলোর শ্রমিক ছিলেন প্রধানত বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ওড়িয়াভাষী মানুষ। দক্ষিণ ভারত থেকেও অনেকে কাজ করতে আসতেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন আর দেশভাগের পর উদ্বাস্তুদের বসবাসের অধিকার নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলন এখানে বামেদের ভিত মজবুত করেছিল। বেশিরভাগ মিল এখন বন্ধ। যে কয়েকটা চালু আছে, তার মধ্যেও বেশিরভাগ ধুঁকছে।

এইসব অঞ্চলে ধর্মীয় বা ভাষাগত বিভেদকে কেন্দ্র করে দূরত্ব আগেও ছিল। শ্রমিক আবাসনগুলোতেও এই বিভেদ টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। তার পিছনে ছিল মালিকদের রাজনীতি। অশান্তি যে একেবারে হয়নি তা নয়। কিন্তু এমন সাংঘাতিক চেহারা কোনো দিন নেয়নি। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের পরেও নয়। ঘটনাস্থলের কাছেই আমার শিশু ভবন থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া স্কুল। ছেলেবেলায় সেই স্কুলে যেতাম বশিরদার ভ্যান রিকশায়। বশিরদা ছিলেন শিশুদের, অভিভাবকদের বড় ভরসা। মনে পড়ে, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ডের পর চারিদিকে অশান্ত পরিবেশ। তখন আমি প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র। বশিরদা আমাদের সকলকে ঠিকমত বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও বশিরদা ছিলেন কর্তব্যে অবিচল। আজীবন দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে চলা বশিরদার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে আমাদের বা অভিভাবকদের মনে কোনোদিন অবিশ্বাস জন্ম নেয়নি। স্কুলের আশেপাশে দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই বাস, রয়েছে ভাষার বৈচিত্র্য। কিন্তু তার জন্য কোনোদিন আমাদের নিরাপত্তার অভাব বোধ হয়নি। যে পথে আমরা এগোনোর নামে পিছিয়ে চলেছি, তাতে জানা নেই সেই বিশ্বাসের পরিবেশ থাকবে কিনা। ধর্ম, ভাষার পরিচয়ে আমাদের মনে অজান্তেই বিষ ঢোকার প্রবল আশঙ্কা।

বশিরদা দিনের বেলায় স্কুল ভ্যান, রিকশা চালাতেন আর রাতে রামপুরিয়া কটন মিলে কাজ করতেন। অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন জীবনভর। সেই রামপুরিয়া কটন মিল বহু বছর বন্ধ। এখন ফ্যাশনদুরস্ত নামের বহুতল হচ্ছে। শ্রীরামপুর পৌরাঞ্চলে রামপুরিয়ার মতোই ছিল বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল, রিষড়া অঞ্চলে লক্ষ্মীনারায়ণ। এই তিনটে কটন মিল ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ন্যাশনাল টেক্সটাইল কর্পোরেশনের (এনটিসি) অধীনে। নয়া উদারনীতির অসীম কৃপায় তিনটেই এখন বন্ধ। সেই জমিতে বহুতল এখন উন্নয়নের প্রতীক।

বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলের বিশাল জায়গা জুড়ে আকাশচুম্বী সব বিল্ডিং, যেন আস্ত একটা উপনগরী। গালভরা তার নাম। ছেলেবেলায় দেখা বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলস রোড ছিল সবসময় প্রাণচঞ্চল। এখন সেসব ছোট ছোট দোকানের বেশিরভাগ বন্ধ। বিকেলে বসত আনাজ বাজার। সেখানকার গগনচুম্বী আলো ঝলমলে বিল্ডিংগুলি আমার বাড়ির দোরগোড়ায়। ওয়েলিংটন জুট মিলের শ্রমিক মহল্লা থেকেও সেই আলো ঝলমলানি দেখতে পাওয়া যায়। সেই আবাসনের শ্রমিকরা জানেন না, কাল তাঁদের বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ থাকবে কিনা। কম ভোল্টেজে প্রচণ্ড গরমে ঘিঞ্জি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন তাঁরা। এইসব বহুতলকে কেন্দ্র করে জনবিন্যাসের পাশাপাশি বদলাচ্ছে দোকান, বাজার সবই। জিটি রোড জুড়ে এখন ব্র্যান্ডেড দোকান, রকমারি খাবারের দোকান, হাল ফ্যাশনের সেলুন, শপিং মল। সেসব ভাগ বসাচ্ছে ছোট ছোট দোকানদারদের রুজিতে। বহু দরজির দোকান হয় বন্ধ, নয় ধুঁকছে। কারখানা বিশেষ নেই, তাই কাজও নেই। বহুতল নির্মাণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে এক অন্য অর্থনীতি। কারখানার মজুর বা তাঁদের পরের প্রজন্ম অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক হয়ে গেছেন, অনেকে টোটো বা অটো চালক।

ঝাঁ চকচকে এই উন্নয়ন ধামাকার সঙ্গে সহবাস অসংখ্য গরিব, নিম্নবিত্ত মানুষের। করোনা অতিমারী তাঁদের অনেকের জীবিকা বদলে দিয়েছে। এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। আজ এক কাজ, কাল আরেক কাজ করে কোনোরকমে দিন গুজরান করা মানুষ এঁরা। রেশনে চাল, গমের বরাত কমে গেলে যাঁদের রাতের ঘুম চলে যায়। বন্ধ কারখানার শ্রমিক রাজ্য সরকারের আরকেএসওয়াই রেশন কার্ডে গম বা আটা বন্ধ হয়ে গেলে অর্ধাহারে কাটান। জিটি রোডের ধারের হালফ্যাশনের দোকান বা চারিদিকের বহুতল তাঁদের জীবনে আলো এনে দিতে পারেনি।

বহুতল নির্মাণকে কেন্দ্র করে শাঁসালো হচ্ছে অপরাধ জগত। প্রোমোটিং আর অপরাধের সহবাস। বেকার যুবকদের সামনে অপরাধজগতের হাতছানি। এরাই স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্তা, শাসক দলের বড় ভরসা। আবার ধর্মীয় মৌলবাদীদেরও এরাই প্রধান ভরসা। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারের যুবকদের মাতিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভোট লুঠ থেকে ধর্মীয় মিছিলে। অপরাধজগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বিজেপি নেতাদের রামনবমীর মিছিল বা তৃণমূলের হনুমান জয়ন্তী, গঙ্গারতির প্রধান উদ্যোক্তা। ধর্ম আর রাজনীতি, সরকার মিলে মিশে গেলে এমনই হয়। রামনবমীর মিছিলে তখন বিজেপি-তৃণমূল বাহিনীর সহাবস্থান। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবও তখন চলে যায় শাসক দলের খপ্পরে। দুই মৌলবাদের আস্ফালনে বাড়ে তৃণমূল আর বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক।

তৃণমূলের আমলে শ্রীরামপুর ও রিষড়া শিল্পাঞ্চলে বিজেপির ভোট বেড়েছে। পাশাপাশি নিজেদের ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরে সংখ্যালঘু ভোট সংহত করেছে তৃণমূল। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৃণমূল আর বিজেপির বাইনারি গড়ে তুলেছে। ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি ভুলিয়ে দিচ্ছে, গুলিয়ে দিচ্ছে রুটিরুজির লড়াই। তারই সঙ্গে সংহত হচ্ছে ভাষাভিত্তিক পরিচয় সত্তার রাজনীতি। বাঙালি জাত্যভিমান দিয়ে ভাতের লড়াইকে দুর্বল করার চেষ্টা। এই প্রবণতাও কম মারাত্মক নয়। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো ছাত্রছাত্রীর অভাবে ধুঁকছে, চারিদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। অথচ বাঙালি জাত্যভিমানের রাজনীতি চলছে। এটাও হচ্ছে তৃণমূলের মদতে। ইংরেজিপ্রীতি আর হিন্দিবিদ্বেষ চলবে হাত ধরাধরি করে। এভাবেই এক সময়ে মারাঠি জাত্যভিমানের রাজনীতি মহারাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল।

আরো পড়ুন সংঘের আসাম মডেল পশ্চিমবঙ্গে আনলেন শুভাপ্রসন্ন

হাওড়া-ব্যান্ডেল মেন লাইনে রেল হকারদের মধ্যে এখন বাঙালি জাতিসত্তার উগ্রতা নিয়ে চলা ট্রেড ইউনিয়ন সক্রিয়। অতিমারীতে দীর্ঘদিন লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় হকারদের আর্থিক অবস্থা সঙ্গীন। অন্য কাজের সুযোগ যত কমছে, তত রেল হকারের সংখ্যা বাড়ছে। লোকাল ট্রেন পরিষেবা চালু হওয়ার পরেই এই ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন গজিয়ে ওঠার তাৎপর্য কম নয়। হকারদের মধ্যে বিভেদ আনলে রেলের বেসরকারিকরণ ও হকার উচ্ছেদের পথই সুগম হয়। একইভাবে রামনবমীকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার মোকাবিলাতেও বাঙালি জাত্যভিমানের ভ্রুকুটি দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ উৎসব বাংলার নয়। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের মোকাবিলা এভাবে হয় না। বরং অপরকে বিদ্বেষের রাজনীতি দাঙ্গাবাজদেরই শক্তিশালী করে।

তৃণমূল এই খেলাটাও খেলছে ছক কষে। হিন্দিভাষীদের বড় অংশ বিজেপি হয়ে গেলে তার একটা পাল্টা বয়ান তৈরি করা, যায় ভিত্তি ভাষাগত পরিচয় সত্তার রাজনীতি। এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে কেন্দ্র-রাজ্য তরজার রাজনীতিকে। নানা ভাষাভাষীর বাস এই শিল্পাঞ্চলে। ভোট রাজনীতিতে এই বাঙালি-অবাঙালি বয়ান তৈরি করতে পারলে তৃণমূল আর বিজেপির বাইনারি আরও জমবে। আসলে নিয়োগ দুর্নীতি, পৌরসভা, পঞ্চায়েতের দুর্নীতি, চাকরির সমস্যা নিয়ে তৃণমূলের উপর ক্ষোভ বাড়ছে। বিজেপিকে প্রাসঙ্গিক করতে না পারলে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে মদত না দিলে তৃণমূলের অসুবিধা। গত বছরের পৌরসভা নির্বাচন থেকে হালের বিধানসভা উপনির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, বিজেপির ভোট কমছে। বিজেপি জুজু না দেখালে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কেও তৃণমূলের আধিপত্য বজায় থাকবে না, উদারপন্থীরা বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূলকে ভোট দেবেন না। তাই পরিচিতি সত্তার রাজনীতির মাধ্যমে তৃণমূল-বিজেপির মধ্যে মেরুকরণ করা। সুতরাং রামনবমীসহ নানা ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে এমন অশান্তি আরও হবে। সরকারের মদতেই হবে।

গণআন্দোলনকে ভাঙতে দাঙ্গার ছক বহু পুরনো। চারের দশকে আগস্ট বিপ্লব, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীর সেনানীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন, নৌ বিদ্রোহ, শ্রমিক ধর্মঘট এক অগ্নিগর্ভ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। তারপরেই বাংলায় ছেচল্লিশের দাঙ্গা। দেশভাগের পর বাস্তুহারাদের মধ্যে বিদ্বেষের বিষ ঢোকাতে হিন্দুত্ববাদীরা কম চেষ্টা করেনি। তখনকার শ্রেণি আন্দোলন ও উদ্বাস্তু আন্দোলন তাকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে জমি তৈরি করতে দেয়নি। রুটিরুজির লড়াইকে সামনে এনে নাগরিকদেরই এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, তৈরি করতে হবে বিকল্প এক সুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশ। শ্রেণি এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলনের মেলবন্ধনই পারে এই ভয়ঙ্কর রাজনীতিকে রুখে দিতে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে পারলে ভালো হত। তথ্যগুলি যেমন গুরুত্বপুর্ন কিছু মূল্যায়ন তেমনই দুর্বল। সরকার চাইছে তাই দাঙ্গা হচ্ছে এই বক্তব্য হাস্যকর। কারণ একদিকে যেমন অবশ্যই বুর্জোয়া সরকারের শ্রেণী স্বার্থ এই দাঙ্গার পিছনে থাকা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধন যোগান দেওয়া মালিকদের শ্রেণী স্বার্থ এক, অন্যদিকে এই বুর্জোয়া সংসদে কোনো সরকারই আজকে এই দাঙ্গা আটকাতে পারবে না, কারণ সরকারের চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে না আজকের সাম্রাজ্যবাদের যুগে, বিশ্ব বাজার অর্থনীতিই নির্ধারণ করে দিচ্ছে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতিগত বিদ্বেষ কখন কীভাবে ফেটে বেরোবে এবং সংগঠিত ফ্যাসিস্ট গণআন্দোলনের রূপ নিয়ে তা শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণীসত্বা আর সংগঠন ভেঙে গুড়িয়ে দেবে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.