উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছে এমন শিক্ষার্থীদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার কোন প্রতিষ্ঠানের নাম তারা সবচেয়ে বেশিবার শুনেছে, তাহলে শতকরা নব্বই জনেরও বেশি বোধহয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, অর্থাৎ আইআইটিগুলোর নাম করবে। আইআইটি বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বহু ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন থাকে উচ্চমাধ্যমিকের পর বাছা বাছা কতকগুলো আইআইটিতে (ছাত্র মহলে যাদের “টপ আইআইটি” বলা হয়) ভর্তি হওয়ার। সেই আইআইটিগুলোর মধ্যে একটা আইআইটি গৌহাটি, যেখানে আগামী ২০ ও ২১ মে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ন্যাশনাল কনফারেন্স অব গৌ-বিজ্ঞান ২০২৩। আয়োজনে আইআইটি গৌহাটির সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম ও ভারতীয় গোবংশ রক্ষণ সম্বর্ধন পরিষদ। “আধুনিক জীবন” ও “আধুনিক বিজ্ঞানে” গরুর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে ওই সম্মেলনে।

গৌ-বিজ্ঞান জিনিসটা কী? এটা কি আদৌ বিজ্ঞান? উক্ত কর্মসূচি প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রচারিত পিডিএফ (উপরে দেওয়া লিঙ্ক থেকে ডাউনলোড করা যাবে) পড়ে তা বিশেষ বোঝা যাবে না। কেননা সেখানে যেসব বিষয় সম্মেলনে আলোচিত হবে বলে জানানো হয়েছে, তা কৃষিবিজ্ঞান ও পশুপালন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়েন। তার জন্য গৌ-বিজ্ঞান পড়তে হবে কেন? এটা বোঝার জন্য একটু পিছিয়ে যেতে হবে। ২০২১ সালে সরকারি সংস্থা রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ এই বিষয়ে একটি সর্বভারতীয় পরীক্ষার ঘোষণা করে, যেখানে গৌ-বিজ্ঞানের সিলেবাস হিসাবে চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক তথ্য দেওয়া হয়। যেমন বলা হয় গরুর দুধে সোনা থাকে। তার আগে ২০২০ সালে এই সংস্থারই প্রধান বল্লভভাই কাথিরিয়া দাবি করেন গোবর থেকে তৈরি চিপ মোবাইল ফোনের ক্ষতিকারক বিকিরণকে প্রতিহত করবে। আগামী মে মাসে অনুষ্ঠিত হতে চলা সম্মেলনের যুগ্ম আয়োজক যে ভারতীয় গোবংশ রক্ষণ সম্বর্ধন পরিষদ, তারা দাবি করে থাকে যে সুস্বাস্থ্যের জন্য গোমূত্র সেবন করা উচিত

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

উপরের তথ্যগুলি থেকে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে অপবিজ্ঞান চাষের আয়োজন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ যদি ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে চায়, তবে বিজ্ঞানের উপর আঘাত হানা জরুরি। তাই ২০১৪ সাল থেকেই, অর্থাৎ কঙ্গনা রানাওয়াত কথিত “ভারতের স্বাধীনতার বছর” থেকেই দেশের বিজ্ঞানশিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতার উপর পরিকল্পিত সরকারি আক্রমণ চলছে। আজ এক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে প্রাক্তন) সত্যপাল সিং প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ না থাকায় ডারউইনের বিবর্তনবাদকে ভুল বলেন, তো কাল আরেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার প্রাচীন ভারতের ঋষিরা কোয়ান্টাম তত্ত্ব জানতেন বলে দাবি করেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫/০১/২০২৩)। সবাইকে ছাপিয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণেশের হাতির মাথা প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রমাণ

আরো পড়ুন বিজ্ঞান দিবসে টিভির পর্দায় বিজ্ঞানের শ্রাদ্ধবাসর রচনা

তবে দেশের বিজ্ঞানশিক্ষার উপর এই সংগঠিত আক্রমণ জোরদার হয়েছে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ তে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম চালু হওয়ার পর থেকে। দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে, যারা হিন্দুত্ববাদী প্রোপাগান্ডার যন্ত্র হিসাবে কাজ করছে। ২০২১ সালে আর এক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আইআইটি খড়্গপুর এক অবৈজ্ঞানিক ক্যালেন্ডারে আর্যরা ভারতের বাইরে থেকে আসেনি বলে প্রচার করে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে শিবপুর আইআইইএসটিতে পুরাণ বিষয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা হয় এবং সেখানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রাক্তন প্রধান এম এস গোলওয়ালকরের ছবি ও বই প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া আরও অনেক উদাহরণ দেখানো যায়, যা তথাকথিত ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের আসল উদ্দেশ্য তুলে ধরে।

একদিকে অপবিজ্ঞান প্রচার করে বিজ্ঞানমনস্কতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থ বরাদ্দ কম রেখে বিজ্ঞানশিক্ষার কোমর ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষের তুলনায় ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বেড়েছে সত্য, কিন্তু জিডিপির শতাংশ হিসাবে বরাদ্দ কমেছে। ২০২১-২২ সালে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩.১%, ২০২২-২৩ সালে তা হয়েছে ২.৯%। জিডিপির বৃদ্ধি ঘটায় বরাদ্দ শতাংশ কমলেও টাকার অঙ্ক বেড়েছে, কিন্তু জিডিপি হ্রাস পেতে থাকলে টাকার অঙ্কও কমতে থাকবে। সুইডেন, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার থেকেও এক্ষেত্রে পিছিয়ে “বিশ্বগুরু” ভারতবর্ষ। আগের লিঙ্কটি থেকেই দেখা যাচ্ছে, ২০১১ থেকে ২০১৪ অবধি সরকারের মোট বার্ষিক খরচের ১১ শতাংশের অধিক ব্যয় করা হত শিক্ষা খাতে, কিন্তু ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অবধি তা নেমে গেছে ১১ শতাংশের নিচে। ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে নেমে দাঁড়িয়েছে ৯.৫ শতাংশে। ২০০৮-০৯ আর্থিক বর্ষে গবেষণা খাতে জিডিপির ০.৮% ব্যয় হত, যা ২০১৭-১৮ থেকে চলতি আর্থিক বর্ষ অবধি ০.৭ শতাংশে ঘোরাফেরা করছে। গোটা বিশ্বের গড় বরাদ্দও ভারতের বরাদ্দের থেকে অনেক বেশি (১.৮%)। ভারত পিছিয়ে আছে আমেরিকা (যারা আমাদের থেকে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন নিল বলে আমাদের এত গর্ব), চিন, ইজরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশের থেকে।

অর্থাৎ দেশের বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের জন্য আজ খুব সুখের সময় নয়। আইআইটি গৌহাটিতে যে সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে তা আসলে সংঘের ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের অংশ। এখানে লক্ষণীয় ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম নামটি। এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় নাজি জার্মানির দুই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জোহানেস স্টার্ক ও ফিলিপ লেনার্ড সৃষ্ট ইহুদিবিদ্বেষী ও নাজিপন্থী ডয়েশ ফিজিক বা জার্মান বিজ্ঞানের। যাঁরা জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাপিত সূর্যের সাধনা বা নারায়ণ সান্যালের বিশ্বাসঘাতক পড়েছেন, তাঁরা জানেন সেইসময় জার্মানিতে কীভাবে বিজ্ঞানচর্চার উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শানানো হয়েছিল।‌ এই নতুন বিজ্ঞানে নানা অবৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার করা হয়েছিল, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদকে বলা হয়েছিল “ইহুদি ধাপ্পাবাজি”। বিজ্ঞান একটি আন্তর্জাতিক, সর্বজনীন বিষয়, বিশেষত আধুনিক যুগে। তাকে নির্দিষ্ট দেশের গণ্ডিতে বাঁধার চেষ্টাই ফ্যাসিবাদ। আমাদের ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম কিন্তু ডয়েশ ফিজিকের ফ্যাসিবাদী পথেই এগোচ্ছে। অবশ্য নাজি ফ্যাসিবাদের তুলনায় সংঘের ফ্যাসিবাদ ব্যাপকতর। অ্যাডলফ হিটলারকে পূর্ণ ক্ষমতা দখল করতে অগণতান্ত্রিক পথ ধরতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত, সংঘের ফ্যাসিবাদ জনতার ভোটে জয়যুক্ত। একইভাবে, তথাকথিত জার্মান বিজ্ঞান জার্মানির যে ক্ষতি করেছিল, ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম ভারতের তার থেকে বেশি ক্ষতি করতে সক্ষম। কারণ ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের প্রণেতারা অধিক চতুর। তাঁরা তথাকথিত জার্মান বিজ্ঞানের মত প্রচলিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলিকে বাতিল না করে ওসব বেদ, পুরাণ ইত্যাদিতে অনেক আগে থেকেই ছিল বলে প্রচার করতে চান। তাই এর বিরুদ্ধে লড়াইও বেশি কঠিন।

দেশের বিজ্ঞান গবেষক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে তাই আজ ভেবে দেখতে হবে, তাঁরা কি গবেষণাগারের বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে থাকবেন, নাকি বিজ্ঞানের উপর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.