ডিজিটাল ইন্ডিয়া কথাটা সরকারি ঘোষণায় সেভাবে আর শোনা যায় না। ভারতীয় হিসাবে চিহ্নিত হতে বিবিধ প্রমানপত্র দাখিল করার এবং তার একটাকে অন্যের সাথে সংযুক্ত করার যতরকম বিধি জারি হয়েছে তার জোরে আপাতত মোদী সরকার নিশ্চিন্ত, লোকজন দুদণ্ড দাঁড়ানোর সময়ই পাবে না – মিছিল, মিটিং করবে কখন?

এই হল সামাজিক বিন্যাসের সেই অংশের গপ্পো যারা কিছুটা ভাল থাকার বিনিময়ে ন্যায্যতার চিরায়ত মানদণ্ড খোয়াতে রাজি হয়ে যায়। এদেরই সহজ কথায় মধ্যবিত্ত বলে। টিভির পর্দায় সরাসরি সম্প্রচার, খবরের কাগজে উত্তর-সম্পাদকীয় পর্যালোচনা কিংবা শহুরে জীবনযাপনের ফিরিস্তি সম্বলিত শিল্প-সাহিত্য (আসলে বিজ্ঞাপন, আপাতত শিল্প-সাহিত্য বলতে তাকেই বুঝতে হবে) – সবই এঁদের জন্য নির্মিত। এই ভারত সম্পর্কে বাড়তি আশার খুব একটা জায়গা নেই। আরএসএস-বিজেপি কত খারাপ, নয়া উদারবাদ কেমন – সবই এঁরা কমবেশি জানেন। তবু চুপ করে থাকেন, চুপ করে আছেন। কারণ এখনো এঁরা ‘ওদের’ থেকে ভাল আছেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এইবার আসে ‘ওদের’ প্রসঙ্গ। ‘ওরা’ কারা? যারা কাজ করে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের পেশাদার কর্মী, চিকিৎসক, উকিল, অধ্যাপনায় নিয়োজিত কিংবা সেইসব লোকজন যাঁরা মনে করেন তাঁরাও কাজ করেন – চিৎকার জুড়তে পারেন, আমরা কি শ্রমজীবী নই? মুশকিল হল, চাকরি দিলেই যেমন কেউ বুর্জোয়া হয়ে ওঠেন না, তেমন কাজ করলেই কেউ শ্রমজীবী হয় না। জোগান দেওয়া উদ্বৃত্ত মূল্যের সঙ্গেই হিসাব করতে হয় শোষণের হার, উৎপাদিত পণ্যের সাথে উৎপাদকের বিচ্ছিন্নতার অনুপাত। এসব সেকেলে তত্ত্বকথা বলে উড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হলে বলতে হয়, কাজ করে ঘরে ফেরার সময়ে একজন শ্রমজীবী মানুষের চেতনায় ঠিক কতটা বিপন্নতা চেপে বসলে সে ও তার পরিবার পরের দিন কী খাবে বুঝতে পারে না – সেই উপলব্ধিই নির্ধারণ করে উৎপাদন শৃঙ্খলায় কে কোন জায়গায় রয়েছে। এই কারণেই ‘ওরা’ ওরাই, বাকিরা আর যাই হোন, সর্বহারা নন। এই লেখার পরবর্তী অংশে শ্রমজীবী বলতে ঠিক তাদেরই বোঝানো হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন কাজ করা (এবং প্রতিদিন একই মজুরিতে আগের চাইতে বাড়তি কাজ করা ছাড়া যাদের আর অন্য কোনো উপায় নেই।

ভারতে শ্রমজীবীদের অবস্থা নয়ের দশক থেকে ক্রমশ ভয়াবহ হয়েছে। সেই ফিরিস্তি এ লেখায় নেই। সমস্যার সমাধানে মূল বাধা ছিল থার্ড পার্টি ভেন্ডরশিপ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং অসংগঠিত কায়দায় ব্যাপক উৎপাদনের যে কৌশল নয়া উদারবাদী জমানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার মোকাবিলায় ‘এক হও’ ব্যাপারটা কীভাবে ঘটবে। সংগঠিত শ্রমজীবী অংশের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস ঘাড়ে চেপে বসে থাকায় আজকের ভারতে মোট শ্রমজীবীদের ৮০ শতাংশেরও বেশি অসংগঠিত ‘লেবার ফোর্স’ কীভাবে অর্থনৈতিক সংগ্রামের স্তর পেরিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের ময়দানে হাজির হবে – সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। গতকাল দিল্লির রামলীলা ময়দান সেই বাধা পেরনোর সাক্ষী রইল।

সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ এর আগেও হয়েছে। ব্লক থেকে শুরু করে রাজ্য স্তর অবধি বিবিধ সভা, সেমিনার ও ক্যালেন্ডার দিবস পালনের নানা কর্মসূচি গত দুই দশকে কম হয়নি। গতকাল রামলীলা ময়দানে যা ঘটেছে তার সাথে এই সমস্ত কর্মসূচির পার্থক্য এটাই যে এই প্রথম দেশের সমস্ত অংশের শ্রমজীবী মানুষ একে অন্যের অর্থনৈতিক সংগ্রামের দাবিগুলিকে স্পষ্ট ভাষায় সমর্থন করেছেন, সেই সমর্থন ঘোষণায় একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটাই শ্রমজীবী ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রাম। এই সংগ্রামে বিদ্যুৎ কর্মীদের লড়াইতে পাশে দাঁড়িয়েছেন কয়লা শ্রমিকরা, নির্মাণ শ্রমিকদের পেনশনের দাবিতে গলা মিলিয়েছে ব্যাঙ্ক ইউনিয়ন, মনরেগার দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৬০০টাকা করতেই হবে – এমন আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন মেটাল থেকে শুরু করে পরিবহন ক্ষেত্রের মজদুররা। উৎপাদিত ফসলের দামে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় আইন চাই, গতকালের সমাবেশে এই দাবি আর শুধুমাত্র কৃষকদের থাকেনি, সকলেই বুঝেছে ওরা না বাঁচলে আমরাও বাঁচব না। সারা দেশের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ একে অন্যের দাবিতে মাথায় রোদ মাখছে – এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য গত দুই দশকে ভারত খুব একটা দেখেনি। মোদী সরকার এর কৃতিত্ব দাবি করতেই পারত, কিন্তু ইতিহাসের পরিহাস এই যে তারাই এই সমাবেশের প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে।

মোদী জমানায় শ্রমজীবী ভারত ঠিক কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?

লকডাউনের সময় থেকে দেখলে মোটামুটি চারটি ঘটনায় চিত্রটি স্পষ্ট হয়।

 

নয়া কৃষি আইনে কী ছিল?

উন্নত দেশগুলি বহুবছর ধরেই ভারতকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে চাপ দিয়ে আসছে। বিশেষ করে সেইসব খাদ্যশস্য যেগুলো তাদের উদ্বৃত্ত। আবার যেসব খাদ্যশস্য উৎপাদনে তারা অভাবী সেক্ষেত্রে তাদের চাপ থাকে রপ্তানি বাড়ানোয়। পাঁচের দশকের শেষার্ধে এবং ছয়ের দশকের শুরুর দিকে পাবলিক ল ৪৮০ ধারার ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে খাদ্যশস্য আমদানি করা হত। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি দুবার ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে বিহারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে অবস্থাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বলা চলে ভারতের হাত মুচড়ে, খাদ্যশস্যের রপ্তানি চালিয়েছিল এবং কার্যত জাহাজ থেকে মানুষের মুখে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার মত অবস্থা হয় আমাদের। একে খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা চলে। অবস্থা এতটাই সংকটের ছিল যে দেশের তৎকালীন খাদ্য এবং কৃষিমন্ত্রী জগজীবন রামকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সবুজ বিপ্লব আয়োজন করার নির্দেশ দেন।

খাদ্যশস্য উৎপাদনের খরচ এবং তার বিনিময় মূল্যের মাঝের ব্যবধান মেটাতে খাদ্যে ভর্তুকি, গণবন্টন ব্যবস্থা, খাদ্যশস্য সংগ্রহের পদ্ধতি-প্রকরণ এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত করা হয় সেই সময় থেকেই। যদিও নয়া উদারবাদী জমানায় এইসব বন্দোবস্ত ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। মোদী জমানার আগে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার এই বন্দোবস্ত বাতিল করার মত পাগলামি করেনি। সবুজ বিপ্লব কতটা সফল তা নিয়ে কারোর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন যাই হোক না কেন, একথা মানতেই হবে যে বিবিধ পরিবেশগত প্রভাব সত্ত্বেও সবুজ বিপ্লবের কারণেই আমাদের দেশ খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এবং খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। অবশ্য একথাও মানতে হবে, এরই প্রভাবে জনগণের এক বড় অংশের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণের সুযোগ কমেছে, রোজগার খুঁজে পাওয়ার পক্ষে অস্বাভাবিক অবস্থাও তৈরি হয়েছে।

আরো পড়ুন আপকে জেতাল ভোটারের অন্য দলে বিতৃষ্ণা ও কৃষক আন্দোলন

খাদ্য ভাণ্ডারে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার সম্ভাবনার কথা বাদ দিলেও একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। দেশের জমিতে নিজেদের প্রয়োজনে খাদ্যশস্য উৎপাদন না করে যদি বহির্বিশ্বের সাথে চুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনে অর্থকরী ফসল ফলানো হয়, তবে সেই ব্যবস্থায় নিশ্চিতভাবেই প্রতি একরে কর্মসংস্থানের সূচক নিচে নামবে। একরের পরে একর জমিতে যদি খাদ্যশস্যের বদলি হিসাবে খাদ্য নয় এমন ফসল ফলানো চলতে থাকে, তবে কৃষিকার্যের শ্রমে নিযুক্ত হয়ে রোজগারের এবং সামগ্রিকভাবে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম হতে বাধ্য। অন্যদিকে খাদ্য নয় এমন ফসল উৎপাদনের কাজে খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজের তুলনায় প্রতি একর জমিতে অনেক কম মজুরি দিতে হবে বলে এই কাজে পাওনা মুনাফা অর্থনীতির অন্য কোনো ক্ষেত্রেও কাজের সুযোগ তৈরি করবে না। এই মুনাফা কার্যত অন্য দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদলি হিসাবে ফুল, ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হলে আসলে যা হবে তা হল সার্বিক কর্মসংস্থানের অধোগতি এবং জনগণের আরও বেশি দারিদ্র্যের কবলে চলে যাওয়া। ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসের ফলে অনাহারেও দিন কাটাতে হতে পারে।

দেশের কৃষিজমিকে খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজে ব্যবহার না করে রপ্তানির উদ্দেশ্যে অর্থকরী ফসল ফলানোর জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হলে তার ফলাফল কী হতে পারে, আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের উদাহরণ দেখলেই সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়। খাদ্যপণ্যের আমদানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার পর একের পর এক দুর্ভিক্ষ জায়গাটাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। ভারতে কৃষিজমির ব্যবহার সম্পর্কে কোনো নিয়ন্ত্রক আইন না থাকলেও কৃষিকার্যের পুরনো চেহারা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বন্দোবস্ত এবং গণবন্টন ব্যবস্থা ঘুরপথে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিশ্চয়তাটুকু দেয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, মোদী সরকার সেই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। একে রুখে দেওয়া ছাড়া কৃষক-খেতমজুরদের আর কিছুই করার নেই।

সূত্র: ১৪ অগাস্ট ২০২০ তারিখে দ্য টেলিগ্রাফ কাগজে প্রভাত পট্টনায়েকের নিবন্ধ

পরবর্তী অংশ আগামীকাল

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.