৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২। সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি পুরনো বাবরি মসজিদ আক্ষরিক অর্থেই ধূলিসাৎ করা হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নয় আক্রমণকারীরা। তাদের মুখে ধ্বংসকার্য শেষের পর নতুন ধ্বংসের সঙ্কল্প ঘোষিত হচ্ছে। মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে “অযোধ্যা তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়”।

ইতিহাস বিকৃত করার, হাতে-কলমে ইতিহাস ধ্বংস করার সেই প্রকল্প আজ পল্লবিত। তারই একটা ধাপ ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-র বারো ক্লাসের ইতিহাসের নতুন পাঠ্যসূচি থেকে মোগল যুগের ইতিহাস বাদ দেওয়া।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

খবরটা পড়ে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ভেবেছেন কী করে ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে এরকম গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া যায়। এর পিছনে যুক্তিই বা কী? যুক্তি একটাই – এ দেশের ইতিহাস থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী অনুষঙ্গ বাদ দেওয়া। ভারত মানে হিন্দু ভারত – একথা প্রতিষ্ঠা করা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসচর্চা আমাদের দেশের ইতিহাসকে তিনটে পর্বে ভাগ করেছিল। সেই তিনটে পর্ব ছিল হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ আর ব্রিটিশ যুগ। ব্রিটিশদের বক্তব্য ছিল, ভারতের কোনো সভ্যতার ইতিহাস নেই, তাই এই অসভ্য দেশকে সভ্য করার মহান প্রকল্প নিয়েই ব্রিটিশ শাসকের ভারতে আগমন। যে ভারতীয়রা এর বিরোধিতা করে প্রাচীন যুগের ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরতে প্রয়াসী হন, তাঁরাও পড়েন ব্রিটিশ ইতিহাসচর্চার ফাঁদে। প্রশ্ন উঠল, যদি প্রাচীন ভারতে এত অগ্রগতি ঘটে থাকে, তবে সে গতি রুদ্ধ হল কেন? দোষ গিয়ে পড়ল মধ্যযুগের ঘাড়ে। তখনকার মুসলমান শাসন নাকি সব অগ্রগতি স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ব্রিটিশরাও সেই বক্তব্যকে সামনে রেখে প্রমাণ করতে চাইল, মুসলমান শাসনের অচলায়তন থেকে এই দেশকে উদ্ধার করেছে ব্রিটিশ শাসন। সেখান থেকেই শুরু হল মধ্যযুগকে অন্ধকারময় যুগ হিসাবে প্রতিপন্ন করা।

এরপর ভারতের ইতিহাসচর্চা অনেক দূর এগিয়েছে। ইরফান হাবিব, শিরিন মুসভি, বরুণ দে, সতীশ চন্দ্র, নুরুল হাসান প্রমুখ ঐতিহাসিক প্রমাণ করেছেন যে ভারতের ইতিহাসে মধ্যযুগ আদৌ অন্ধকারময় ছিল না। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্থাপত্য-শিল্পকলা, শাসনপদ্ধতি – অনেক ক্ষেত্রেই গৌরবোজ্জ্বল অগ্রগতি ঘটেছিল। এই তত্ত্ব মেনে নিলে আজকের শাসকের বড়ই অসুবিধা। তাদের তো একটাই প্রতিপাদ্য – ভারতের ইতিহাসে যা কিছু গৌরবজনক তার সবই হিন্দুদের সৃষ্টি। তাই মধ্যযুগকে অগ্রাহ্য করতে হবে, বিকৃত করতে হবে, সবকিছুর উপর হিন্দু আধিপত্য স্থাপন করতে হবে। যদি চারদিকে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর দিকে একটু নজর রাখেন তাহলে একথা খুব ভাল করে বুঝতে পারবেন। নিশ্চয়ই মনে আছে যে জনমানস থেকে মোগল নাম মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে থেকে। ট্রেনে করে উত্তর ভারতে যাওয়ার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন মোগলসরাই আর নেই। তার নাম বদলে দেওয়া হয়েছে। নতুন নামকরণ দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর। এই দীনদয়াল সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। সেই আদর্শটি হল ভারতকে শুধুমাত্র হিন্দুদের দেশ হিসাবে দেখা, কেবল হিন্দু শাসকদের কীর্তি তুলে ধরা। উপরন্তু ভারতের ইতিহাসের তথাকথিত ‘অহিন্দু’ উপাদানগুলোকে চিহ্নিত করে মুসলমানদের বহিরাগত আখ্যা দেওয়া। কিন্তু মজা হল, পুরো ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যের উপর। ভারত এমন এক দেশ যেখানে কোনোদিনই শাসকের ধর্ম সারা দেশের ধর্ম হয়ে ওঠেনি। শাসক ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও রাজকার্যে অন্য ধর্মাবলম্বীকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনা ভারতেতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। মোগল ইতিহাসেই এমন উদাহরণের ছড়াছড়ি।

ঠিক সে কারণেই মোগল শাসনের ইতিহাস, সে ইতিহাস লেখার ধরন বারো ক্লাসের ইতিহাসের পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হল। যারা এ কাজ করল, সেই এনসিইআরটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি স্বশাসিত সংস্থা। কাজেই বলা হবে, এ তো স্বশাসিত সংস্থার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বিষয়টা কি আদৌ তাই? বিষয়টাকে কি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায়?

মনে রাখতে হবে, মোগল শাসকরা তাঁদের শাসনে যোগ্য ব্যক্তিদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছিলেন। ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আকবরের আমলে রাজস্বব্যবস্থা তথা অর্থনীতির ভারপ্রাপ্ত টোডরমল ছিলেন হিন্দু। তাঁকেই আকবর করেছিলেন মুন্সিফ-ই-দেওয়ান বা সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ভকিল-আস-সুলতানাত বা সম্রাটের মন্ত্রণাদাতা। কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে কাউকে প্রশাসনে এতটা গুরুত্ব দেওয়া যায় তা একবার ভেবে দেখুন। এই ইতিহাস ছাত্রছাত্রীরা শিখলে তো তাদের একথা বোঝানো যাবে না যে মুসলমান মোগল শাসকদের হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ ছিল।

ভেবে দেখুন, যে হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবর রাণা প্রতাপকে পরাজিত করেছিলেন সেই যুদ্ধে আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ। বলা বাহুল্য মানসিংহ হিন্দু। শুধু তাই নয়, যাকে মানসিংহ বা আকবর হারালেন সেই রাণা প্রতাপের সৈন্যদলের নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট আফগান শের শাহের বংশধর হাকিম খান সুরি। একথা ছাত্রছাত্রীরা জানলে তো আর আজকের শাসক বলতে পারবে না, মোগল যুগ মানেই হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ইতিহাস।

আরো পড়ুন ইতিহাস নিয়ে অমিত শাহের হুমকি ফাঁকা আওয়াজ নয়

ইতিহাসটা বরং অন্য। আকবর থেকে ঔরঙ্গজেব, কোনো মোগল শাসকের কাছেই নিজের ধর্মীয় পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আকবর ধর্মীয় বিষয়ে উলেমাদের ব্যাখ্যাকে চূড়ান্ত হিসেবে মানেননি। বরং ১৫৭৯ সালে ‘মাজহার’ বা ‘অভ্রান্ততার নির্দেশনামা’ জারি করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কোনো ধর্মীয় বিষয়ে উলেমারা যদি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন, তবে সম্রাটই তার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেবেন আর তা হবে অভ্রান্ত। ফলে সহজেই বোঝা যায়, শাসকের কাছে ধর্ম বিচার্য ছিল না, বিচার্য ছিল শাসকের সার্বভৌমত্ব। আবার যে ঔরঙ্গজেবকে হিন্দু বিদ্বেষের জন্য অভিযুক্ত করা হয়, তিনি সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রয়োজনে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের উপরও নতুন কর বসিয়েছিলেন। তিনি বহু ধর্মস্থান ধ্বংসের দায়ে অভিযুক্ত। তাৎপর্যপূর্ণ হল, তার মধ্যে মসজিদও ছিল। তিনি এই অভিযান করেছিলেন রাষ্ট্রের শাসকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আখড়া ভাঙতে। কোনো মোগল শাসকই ধর্মীয় আদর্শ অনুযায়ী সাম্রাজ্য চালাননি, প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিলেন শাসকের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকে। ঔরঙ্গজেবই এক সুন্নি ওমরাহকে লিখেছিলেন, “জাগতিক বিষয়ের সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক? প্রশাসনের কাজকর্মে ধর্মের নাক গলানোর কী অধিকার আছে! ধর্ম যার যার।” সমস্যা হল, মোগল শাসনের এই স্বরূপ যদি শিক্ষার্থীরা জানে তবে তো তাদের বলা যাবে না বহিরাগতরা এসে সব দখল করে নিয়েছে।

মোগল শাসনের ইতিহাস ধর্মীয় সমন্বয়ের ইতিহাসও, যা ছড়িয়ে রয়েছে সাহিত্য আর শিল্পের অঙ্গনে। মনে রাখতে হবে মোগল শাসকরা হিন্দুদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও স্থাপন করেছিলেন, যা আজকের ভারতে ঘটলে লাভ জিহাদ আখ্যা দেওয়া হয়, ভিনধর্মে বিয়ে করা দম্পতিদের মেরেও ফেলা হয়। মোগল ইতিহাস নবীন প্রজন্ম জানলে শাসকের অসুবিধা, কারণ তখন নতুন প্রজন্ম উপলব্ধি করবে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার বাণী “হেথায় আর্য, হেথা অনার্য/হেথায় দ্রাবিড়, চীন –/শক-হূন-দল পাঠান মোগল/এক দেহে হল লীন।” এদেশে বিভিন্ন সময়ে আগত ভিনজাতি, ভিনধর্মীদের এক দেহে লীন হওয়ার ইতিহাস ছাত্রছাত্রীরা শিখলে তাদের কাছে বহিরাগত তত্ত্ব অর্থহীন হয়ে যাবে। তার চেয়ে এই বিষয়গুলো পাঠ্য ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়াই নিরাপদ।

খেয়াল করুন, মোগল শাসনের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে বারো ক্লাসের পাঠ্য বিষয় থেকে বাদ পড়েছে স্বাধীন ভারতে গণআন্দোলনের ইতিহাস, একদলীয় আধিপত্যের (অর্থাৎ কংগ্রেস শাসনের) ইতিহাস, স্বাধীনতার পরে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসও। দশম আর একাদশ শ্রেণীর পাঠ্য বিষয় থেকে বাদ পড়েছে গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র্য, গণসংগ্রাম ও আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জের মত বিষয়। বাদ পড়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়কাল এবং বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার আধিপত্য। বর্জিত বিষয়ের তালিকায় চোখ বোলালে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বর্তমান শাসকের লক্ষ্য এ দেশের ইতিহাসের বৈচিত্র্যকে বাদ দিয়ে তাকে একমাত্রিক হিসাবে তুলে ধরা। যে কোনো গণসংগ্রামের ইতিহাসকে বাদ দেওয়া। শাসকের আসল লক্ষ্য বোধহয় প্রাচীন যুগের পরেই এক লাফে এই সরকারের শাসনকালে এসে পড়া। এবার বোধহয় পড়ানো হবে, এই শাসকের নেতৃত্বে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্যের কল্পকাহিনী। আমরা বোধহয় সেদিকেই চলেছি। শাসকের পছন্দের ইতিহাসেরই রমরমা চলবে শিক্ষার প্রাঙ্গণে আর জনপরিসরে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.