কেন্দ্রীয় বাজেটে কী থাকছে?

এবছর ১৫ মিনিটেরও কম সময়ে কেন্দ্রীয় বাজেট ঘোষণা হয়েছে। সংসদে কাউকে আলোচনাই করতে দেওয়া হয়নি। আমরা দেখে নিই আগের বছর নির্মলা সীতারামণ কী করেছিলেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

মূল্যবৃদ্ধির সবচাইতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে খাদ্যসামগ্রীর উপরে, স্বাভাবিকভাবেই আশা ছিল গণবন্টন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ কিংবা তাকে আরও মজবুত করা সম্পর্কিত কিছু পরিকল্পনা থাকবে। কিন্তু নির্মলা বিশ্বাস করেন উপভোক্তারা যা কিছু নিজেরা ব্যবহার করেন না সেগুলো সম্পর্কে উদাসীন থাকা চলে, এমনকি তাত্ত্বিক অবস্থানের দিক থেকেও। যেহেতু তাঁকে বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কাউকেই লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন তুলতে হয় না, তাই বোধহয় গণবন্টন সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। পেট্রোল, ডিজেলের দামে ভর্তুকি তুলে দিতে এতদিন যাঁরা সবচেয়ে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরাই যখন পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে রাজস্ব হারানোর মহান কর্তব্যে ফেরত আসেন তখন বুঝতে হবে জনগণের প্রতি এহেন সহমর্মিতা আসলে শাইলকের থেকেই অনুপ্রাণিত। এতদিন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই জোর গলায় বলছিলেন পেট্রোপণ্যের দাম বাড়লে গরিব জনতার কিছু আসে যায় না কারণ তারা পেট্রোল, ডিজেল কিছুই কেনে না। নির্মলার পেঁয়াজ না খাওয়ার যুক্তি স্বাধীন ভারতের সংসদে জনবিরোধী বাজেট বক্তৃতার ইতিহাসে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। তবু ধরে নেওয়া যাক, পরিবহন খরচ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি রোধের প্রচেষ্টাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাতেও কিছু কথা রয়ে যায়।

উজ্জ্বলা যোজনায় ভর্তুকি দিতে গিয়ে ৬,১০০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন অর্থমন্ত্রী, অথচ প্রায় ১৩,৪৫০ কোটি টাকা খরচ করে সেন্ট্রাল ভিস্টা (নতুন সংসদ ভবন) বানাচ্ছে মোদী সরকার। ওই পরিমাণ টাকায় যে কোনো জনকল্যাণ প্রকল্পের উজ্জ্বলতা অনেকটাই বাড়ানো যেত। কিন্তু তাতে হয়ত নাগপুরের কর্তারা চটে যেতেন। হয়ত আরও বেশি চটতেন কর্তাদের অন্তরালে থাকা বড় ভাইরা।

২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনার অন্তর্গত ব্যাঙ্ক আমানতের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। তবু বলা হবে পেট্রোল-ডিজেলের দামে কর ছাড় দিয়ে রাজস্ব আদায় বাবদ এক লক্ষ কোটি টাকার বিশাল ক্ষতিস্বীকার করছে মোদী সরকার। সত্যিই আমাদের দেশে এহেন হিসাবনিকাশ অভূতপূর্ব। মনে রাখতে হবে, এই যোজনায় মোট আমানতকারীর সংখ্যা প্রায় ৪৪.২৩ কোটি, যার মধ্যে গ্রাম ভারতের অংশ ২৯.৫৪ কোটি। অর্থমন্ত্রী মাত্র ন কোটি পরিবারের জন্য ভর্তুকি ঘোষণা করেছে, বাকিরা কোথায় যাবে?

সরকারি আর্থিক প্যাকেজ এবং পরিষেবাসমূহকে সুলভে সাধারণ গরিব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই নাকি জন ধন যোজনার উদ্দেশ্য ছিল (“To ensure access to financial products and services at an affordable cost”)। সেই আশাতেই কোটি কোটি মানুষ ব্যাঙ্কের দরজায় লাইন দিয়েছিলেন, ঠিক নোটবন্দির মত। তাঁদের নিজস্ব আমানতের মোট অর্থটুকুও তাঁদের জন্য বরাদ্দ করছে না মোদী সরকার। তাই জানতে ইচ্ছা করে, কিসের ভর্তুকি? ভর্তুকির নামে আসলে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে।

এইসব নামমাত্র কর ছাড়ের ঘোষণার পরেও যখন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হবে না, বরং আশঙ্কা রয়েছে সংকট আরও বাড়বে, সেই পরিস্থিতিতে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও “আর কী-ই বা করা যায়” বলে আসলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার রাস্তা করে রাখছে মোদী সরকার। মনে রাখতে হবে এই সময়কালেই ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য সর্বাধিক হ্রাস পেয়েছে। পেট্রোল হোক বা ডিজেল, মোট চাহিদার তুলনায় দেশীয় জোগানে ঘাটতি থাকায় প্রতিদিন আমদানির বাড়তি বোঝা বইতেই হবে। সে হিসাব মাথায় রেখে সাগরপারের বড় ভাইরা নিজেদের জন্য সুবন্দোবস্ত করে রেখেছেন, হাড়িকাঠে গলাটুকু বাড়িয়ে দিতে হবে সাধারণ মানুষকে, এই যা। টাকার দাম আরও কমলে বাড়তি মূল্যের ধাক্কায় ঘোষিত ভর্তুকির যৎসামান্য সুবিধাটুকুও স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।

সরকার দেখাতে চাইছে বর্তমান পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম (২০০ দিনের কাজের বাড়তি দাবি সমেত), শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান কিংবা বিনামূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর গণবন্টনের মত প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণে কোনরকম বাড়তি ব্যয় বরাদ্দ করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই বারবার রাজস্ব আদায় কত কম হচ্ছে তার উল্লেখ থাকছে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে। একই উদ্দেশ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং কোভিড অতিমারীর কারণে সারা পৃথিবীতেই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে বলে অজুহাত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

ভুলে যাওয়া উচিত নয়, নির্মলা আজ যেসব দেশের কথা বলছেন, তারা প্রত্যেকেই অতিমারীর সময়ে নিজেদের দেশে জনকল্যাণসহ যাবতীয় পরিকাঠামো খাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়েছে। মোদী সরকারের পছন্দের দেশের কথাই ধরা যাক। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়েই বড় অঙ্কের (২ ট্রিলিয়ন ডলার) কোভিড সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা হয়। পরে জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে সেই বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে দেন। ভারতে মোদী সরকার করোনা অতিমারীর চূড়ান্ত সংকটেও তেমন কিছু করেনি। আয়কর সীমার বাইরে থাকা পরিবারগুলোর জন্য মাসিক ৭,৫০০ টাকার সামান্য ক্যাশ ট্রান্সফারের দাবিকেও তারা নির্মমভাবে এড়িয়ে গেছে। লকডাউনের কারণে সর্বস্বান্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরার সময়ে ট্রেনে পর্যন্ত উঠতে দেয়নি। টিকিটের দাম জোটাতে না পেরে তারা হেঁটেছিলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। পথ চলার ক্লান্তিতে রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়া শ্রমিকদের টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল ট্রেনের চাকা, শুধু কয়েকটা না খাওয়া রুটি সেই ঘটনাকে অক্ষয় করে রেখেছে।

অর্থনীতি জানেন, বোঝেন এবং বুনিয়াদি মানবিকতা হারিয়ে ফেলেননি এমন প্রত্যেকেই দাবি জানিয়েছিলেন, ধনীদের সম্পত্তি কর বাড়িয়ে এবং কর্পোরেটদের দেয় কর আদায় করে সেই অর্থে জনকল্যাণ বাবদ সংস্থান করা হোক। এর জবাবে অতিমারী চলাকালীনই মোদী সরকার কর্পোরেটদের প্রতি বছর ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছে। তাই বিশ্বমন্দার অজুহাত নতুন কিছু নয়, আসলে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকার চেষ্টা।

ভারতে বেকারির হার গত বছরের মার্চ মাসে ছিল ৭.৬০%, এপ্রিলে হয়েছে ৭.৮৩%। প্রবণতা জানাচ্ছে চলতি মে মাসের শেষে সেই সূচক ৯.২২ শতাংশে পৌঁছতে পারে। মনে রাখতে হবে, মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারির সমস্যা একে অপরের পরিপূরক। বেকারত্বের মোকাবিলা না করা গেলে বাজারে চাহিদার ঘাটতি কিছুতেই মিটবে না। শুধু জোগান বাড়িয়ে কাজের কাজ কিছু হবে না (যে অর্থনীতিতে নির্মলারা বিশ্বাস রাখেন)। উল্টে মুনাফার ধান্দায় আরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। তাই প্রয়োজন ছিল পরিকাঠামো খাতে ব্যয়বৃদ্ধি এবং সংকটের সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর আমদানি-রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ।

ইস্পাতের ক্ষেত্রে আমদানি করে ছাড় বাড়িয়ে রপ্তানি কর বাড়িয়ে দেওয়া হল, অর্থাৎ ভারতে ইস্পাত উৎপাদন ধাক্কা খেতে চলেছে এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হ্রাসের আশঙ্কাও তৈরি হল। সারা দেশেই আবাসন শিল্পে ব্যাপক মন্দা চলছে, একইসঙ্গে পাইকারি বাজারে ভয়ানক মূল্যবৃদ্ধির সময়ে অন্য সবকিছু ফেলে রেখে শুধুমাত্র সিমেন্টের দাম কমাতে সরকারের এত মাথাব্যথার কারণ বোঝা দায়। সেন্ট্রাল ভিস্টা নির্মাণ দ্রুত শেষ করতেই কি এমন পরিকল্পনা? ব্যাপারটা ১৩,৪৫০ কোটি টাকার বলেই হয়ত।

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছেন। সারা দেশে কোথাও কোনোরকম উৎপাদন ঘাটতি নেই। অর্থাৎ বাজারে স্বাভাবিক জোগান অব্যাহত রয়েছে। তা সত্ত্বেও এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি তাঁকে ভাবতে বাধ্য করছে না চাহিদা-জোগানের স্বাভাবিক অবস্থায় বাড়তি দাম জনিত মুনাফা কোথায়, কাদের পকেটে ঢুকছে? দেশের অর্থমন্ত্রীর কিন্তু সেটা খেয়াল করাই প্রাথমিক কর্তব্য, অবশ্য তিনি যদি সেই দায়টুকু স্বীকার করেন। এই সরকারের নির্মল দালালি বিবেচনা করতে হবে এই প্রসঙ্গেই।

সরকারি ব্যয়বরাদ্দ কীভাবে বাড়ানো যায়? তাছাড়া তো দাম কমানোর অন্য উপায় নেই। অন্তত ভদ্রস্থ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নেই। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সেই আর্থিক সংস্থানের কথাতেই ফেরত আসতে হবে। অথচ সরকার এই প্রসঙ্গে কিছুতেই আসবে না, আসতে পারবে না। এর কারণ খুবই সহজ। রাজস্ব বাবদ যে প্রাপ্য সরকার নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছে, তা কর্পোরেট এবং দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশের মালিক ১% অতিধনীদের থেকে আদায় করার হিম্মত মোদী সরকারের নেই। দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের বিরাট মুনাফা (super profit) লুটে নেওয়ার সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেই এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অতএব সম্পত্তি কর বাড়ানোর ক্ষমতা তার নেই। কর্পোরেটদের থেকে বাড়তি দূরে থাক, প্রাপ্য করটুকু আদায় করার মুরোদও নেই। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির ইশারায় চলা এই সরকারের অর্থনীতির মূল কথা “এলোমেলো করে দিই, যাতে লুটে পুটে খায়”।

পরবর্তী অংশ আগামীকাল

প্রথম পর্ব

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.